আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুখের মতো কান্না-২৭

কথা হচ্ছিলো রুহান ও বাবার মধ্যে। রুহান বললো, ‘বাবা, তাহলে আপনাকে আমি যে ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করতে বলি, আপনি যে কথাগুলো ব্যাখ্যা করেন, সেগুলোও তাহলে আপনার ব্যাখ্যা নয়?’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন রায়হান সাহেব । তারপর বললেন, ‘রুহান, আমাদের কোনো কথাই আসলে আমাদের নিজের কথা নয়। আমি যখন ‘আমি’ উচ্চারণ করার জন্য ‘আ’ বলি, তখন কেউ একজন যদি আর ‘মি’ বলার ক্ষমতা না দেন, তাহলে তো আর ‘আমি’ আমি হতে পারবো না। এছাড়া আমাদের ভেতরে যখন কোনো ভাবের জন্ম হয়, তখন সেই ভাব প্রকাশিত হবার জন্য উস-খুস করতে থাকে।

সে তখন বাইরে বেরুনের অনুমতি চায় ব্রেইনের কাছে। ব্রেইন থেকে অনুমতি পাওয়ার পর মনের ভাবটি কন্ঠনালী দাঁত, তালু এবং আরো কিছু জায়গায় ঠক্কর খেয়ে খেয়ে আওয়াজে পরিণত হয়। মূল কাজটি করে জিহ্বা। জিহ্বা সেই আওয়াজটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে একটি অর্থবোধক শব্দে পরিণত করে। এই কাজগুলো সেকেন্ডের এক ভগ্নাংশ সময়ের ভেতরেই সংগঠিত হয়ে যায়।

আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি কন্ট্রোল করেন একজন মহা নিয়ন্ত্রক। রিমোট তাঁর হাতে। মূলতঃ তার ইচ্ছায়ই আমাদের সবকিছু। ’ রুহান বললো, ‘আচ্ছা বাবা, এই মহা নিয়ন্ত্রক কে? তিনিই কি স্রষ্টা?’ রায়হান বললেন, ‘হ্যাঁ, হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’ ‘কারণ আছে বাবা। ’ ‘বলো, খুলে বলো সবকিছু।

’ রুহান বললো, ‘কারণটি একটু পরে বলছি বাবা। তার আগে আমাকে একটু বলেন, স্রষ্টা একাধিক নন কেন? কী যুক্তি থাকতে পারে স্রষ্টার অদ্বিতীয়তার পক্ষে?’ ভুরু কুচকে এবং বিরক্তির চোখে ছেলের দিকে তাকালেন মিষ্টার রায়হান। বললেন, ‘রুহান, এটা কেমন প্রশ্ন হলো? তোমার ভেতরে সেই ছোটবেলায় আমি যে বিশ্বাসের বীজ বুনে দিয়েছি, সেটাই কি স্রষ্টার একত্ববাদের জন্য যথেষ্ট নয়?’ রুহান বললো, ‘আসলে বাবা, ব্যাপারটি সেরকম নয়। আমি সব সময় সবকিছুকে যুক্তি দিয়ে যাচাই করতে ভালবাসি। আমি বিশ্বাস করি স্রষ্টা বা সৃষ্টি রহস্যে যুক্তির বাইরে কিছু নেই।

’ রায়হান বললেন, ‘তাহলে স্রষ্টার কোনো কথা যদি তোমার যুক্তিতে যৌক্তিক মনে না হয়, তাহলে এক্ষেত্রে তুমি কি সেটা অস্বীকার করবে?’ রুহান বললো, ‘না বাবা। অস্বীকার করবো না। এমন কিছু সামনে আসলে আমি ধরে নেব এই বিষয়ে আমার যুক্তি এখনো পরিপক্ষ হয় নি। অথবা আমি এখানে সঠিক যুক্তিতে পৌছাতে পারি নি। ’ রায়হান বললেন, ‘এটা কেন মনে করবে? বিশ্বাসের কারণে?’ রুহান বললো, ‘না বাবা।

বিশ্বাসের কারণে না। যৌক্তিক কারণে। এক্ষেত্রে আমার যুক্তি হলো, আমরা বিবেক খাঁটিয়ে, মাথা খাঁটিয়ে যুক্তি ব্যবহার করি। আর স্রষ্টা হলেন এই বিবেকের উৎস এবং দাতা। আমরা তাঁর দেয়া বিবেক দিয়ে যদি তাঁর কোনো সিদ্ধান্তকে বুঝতে না পারি, তাহলে ধরে নিতে হবে-এই ব্যাপারে বুঝবার জন্য যথেষ্ট বিবেক আমাদের দেননি তিনি।

কখনো প্রয়োজন মনে করলে হয়ত দেবেন। ’ খুশি হলেন রায়হান সাহেব। ছেলেটি সঠিক পথেই এগুচ্ছে। এই ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যেতেই পারে। তবে সমস্যা হচ্ছে ছেলেটি বেঁচে আছে কি না- এখনো তিনি সেটা নিশ্চিত করে জানেন না।

‘বাবা, অই ব্যাপারে আমি এখনো কোনো যুক্তি খোঁজে পাচ্ছি না। ’ রায়হান বললেন, ‘কোন্ ব্যাপারে?’ রুহান বললো, ‘অই যে বললাম। স্রষ্টার অদ্বিতীয়বার পক্ষে কী যুক্তি রয়েছে। আমরা কেন মনে করতে পারবো না একাধিক স্রষ্টা থাকতে পারেন?’ রায়হান বললেন, ‘এটা তুমি জানতে চাও কেন?’ রুহান বললো, ‘কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো। আমি তাকে জবাব দিতে পারি নি।

’ ‘সেই কেউ একজনটা কে রুহান?’ ‘বলতে চাচ্ছি না বাবা। ’ ‘ঠিক আছে। নাম বলতে না চাইলে বলতে হবে না। ব্যাপারটি তোমাকে ব্যাখ্যা করছি। তবে আমার হাতে আজ আর খুব বেশি সময় নেই।

খুব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে হবে। ’ রুহান বললো, ‘মূল টপিকটি আমাকে দিয়ে দিলেই চলবে বাবা। বাকীটা আমিই দাঁড় করিয়ে নেব। ’ রায়হান বললেন, ‘সেটা আমি জানি রুহান। তোমার প্রতি এই ভরসা আমার আছে।

’ একটু জিরিয়ে নিলেন রায়হান সাহেব। কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। বয়স হয়েছে। তাই আগের মত উদ্যম নেই শরীরে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে তিনি বললেন, ‘একাধিক স্রষ্টা হলে, কবেই ঝগড়া-ঝাটি করে আকাশ ভেঙে চুরমার করে ফেলতেন।

হয়তো দেখা যেতো একজন বলছেন আজ পৃথিবীতে রোদ দেয়া হউক, অন্যজন বলছেন, কৃষকের জমি পানির জন্য খা খা করছে। এই অবস্থায় রোদ দেয়ার প্রশ্নই আসে না। আজ সারাদিন প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করতে হবে। আর এ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হতো এবং সেটা থেকে সংঘাত। ’ রুহান বললো, ‘কিন্তু বাবা, যেহেতু তাঁরা স্রষ্টা, আমাদের মতো সংকীর্ণ মানসিকতা থেকেও মুক্ত।

তাই এমনও তো হতে পারে যে, তাঁরা পরস্পর ভাগাভাগি করে জগৎ পরিচালনা করছেন। একদিন একজন, পরের দিন অন্যজন...’ একটু হাসলেন রায়হান। বললেন, ‘নাও ধরে নিচ্ছি স্রষ্টা একাধিক। অন্তত দুই জন। এবারে প্রশ্ন হলো, তাদের উভয়ের ক্ষমতা কি সমান? নাকি কম-বেশি আছে? যদি ধরে নেয়া হয় একজনের কম অন্যজনের বেশি, তাহলে যার বেশি, তিনি ঠিকই আছেন।

কিন্তু যার ক্ষমতা তুলনামূলক কম, তিনি আর স্রষ্টা হতে পারেন না। কারণ, স্রষ্টা এমন সত্ত্বার নাম, যার ক্ষমতা সবচে’ বেশি। তারচে’ বেশি ক্ষমতা আর কারো নেই। সঙ্গত কারণেই এক স্রষ্টাই নির্ধারিত হয়ে যান। আর যদি মনে করা হয় উভয় স্রষ্টার ক্ষমতা সমান।

কেউ কারো থেকে কমও না আবার বেশিও না। তাহলে এবারে প্রশ্ন হচ্ছে তাদের একজনের আদেশ বা ক্ষমতা অন্যজনের উপর প্রয়োগ করা যাবে কি না। যদি একজনের ক্ষমতা অন্যজনের উপর প্রয়োগ করার ক্ষমতা থাকে, তাহলে যিনি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারলেন, তিনি ঠিকই আছেন কিন্তু যার উপর প্রয়োগ করা হলো, তিনি আর স্রষ্টা থাকতে পারলেন না। কারণ, স্রষ্টাকে এমন সত্ত্বা হতে হবে, যার উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করার মত বা যার উপর খবরদারী করার মত আর কেউ থাকেন না। আর যদি ধরে নেয়া হয় তাঁরা শুধু তাদের সৃষ্টি জগতের উপরই ক্ষমতাবান।

কিন্তু পারস্পরিক ক্ষেত্রে তাঁরা একজন অন্যজনের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখেন না। তাহলে দুঃখজনক হলেও তাদের উভয়ের স্রষ্টাত্বই বাতিল হয়ে যাবে। কারণ, স্রষ্টাকে এমন সত্ত্বা হতে হয়, তিনি নিজে ছাড়া বাকী সবার উপর যার ক্ষমতা প্রয়োগ করার ক্ষমতাও রয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে এমন কাউকে পাওয়া গেল, যার উপর স্রষ্টার স্রষ্টাত্ব প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। সুতরাং যৌক্তিকভাবেই গ্রহণ করে নিতে হবে স্রষ্টা একজনই।

’ রুহান বললো, ‘থ্যাংক য়্যূ বাবা। আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি। বাবা আবার কখন দেখা হবে?’ রায়হান সাহেব দুঃখি দুঃখি ভাব নিয়ে বললেন, ‘সেটা তো আমি জানিনারে বাবা। আগামীকালও হতে পারে, একমাস পরেও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, এই দেখাই শেষ দেখা।

’ রুহানের চোখে পানি এসে গেলো। রায়হান সাহেব অদৃশ্য হয়ে গেলেন। দীর্ঘক্ষণ নিরবে বসে থাকলো রুহান। *** *** *** *** *** *** মিসেস জলির মানসিক পরিবর্তনটা ইদানিং তাঁর নিজেকেও ভাবাচ্ছে। তাঁর সকল চিন্তা-চেতনা এক বিন্দুতে এসে জমা হয় রুহানকে ঘিরে।

তিনি মাঝে-মধ্যে নিজেও অবাক হয়ে যান। কেমন মহিলা তিনি! এত নোংরা চিন্তা-ভাবনা তাঁর মাথায় আসে কী করে? কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাঁর সুন্দর বোধটুকুও হারিয়ে যেতে থাকে। সেটা দখল করে নেয় অসুন্দর কিছু। তিনি চেষ্টা করতে থাকেন নিজেকে ফেরাতে। তিনি চেষ্টা করতে থাকেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখোমুখি হন তিনি। নিজকে প্রশ্ন করেন, ‘জলি, তোমার লজ্জা করে না? এত নীচ চিন্তা করতে তোমার বিবেকে বাধে না? ছিঃ! তোমাকে ঘৃণা করতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। ’ মিসেস জলি স্পষ্ট শুনতে পান আয়নার ভেতরে ভেসে উঠা তাঁর প্রতিচ্ছবি থেকে আওয়াজ আসছে। তিনি বুঝতে পারেন এটা তাঁর অবচেতন মনের কল্পনা। তবুও তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন আয়না মানবীর সাথে।

তার সাথে কথা চালাতে থাকেন। ‘জলি?’ ‘বলো। ’ ‘তোমার লজ্জা করা উচিৎ। যে ছেলেটিকে অনেকটা সন্তান আদরে বড় করলে, তাকে নিয়ে নোংরা পরিকল্পনা করছো তুমি। তোমার তো লজ্জায় মরে যাওয়া উচিৎ।

’ জলি বললেন, ‘লজ্জা তো তোমারও পাওয়া উচিৎ। ’ আয়না মানবী বললো, ‘কেন? আমারও লজ্জা পাওয়া উচিৎ কেন?’ ‘কারণ তুমি কেউ না। তুমিই আমি। ’ ‘ভুল বললে মিসেস জলি। ’ ‘ভুল বলেছি?’ ‘হ্যাঁ।

’ ‘তুমি আমি না?’ ‘না। ’ ‘তাহলে কে তুমি?’ ‘আমি তোমার শুদ্ধ বিবেক। ’ মিসেস জলি বললেন, ‘তোমার অস্তিত্ব আমাকে ছাড়া কল্পনা করা যায়?’ ‘না, তা হয়ত যায় না। তবুও আমি তুমি নই। ’ ‘তাহলে তুমি কেমন?’ ‘বললাম তো, আমি তোমার শুদ্ধ বিবেক।

’ কপট রাগ দেখালেন মিসেস জলি। বললেন, ‘দেখো, আমি জানি তুমি কেউ না। You are nobody আমাকে কেন বিরক্ত করছো?’ ‘বিরক্ত করছি? কই! আমি তো কেবল জেগে উঠার চেষ্টা করছি। ’ ‘তুমি জেগে উঠার চেষ্টা করছো মানে কী?’ ‘মানে হচ্ছে, আমি এতদিন তোমার ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি ঘুমিয়ে যাবার সুযোগে তুমি খেই হারিয়ে ফেলেছো।

এখন আমি চাইছি জেগে উঠি। তোমার নোংরা পরিকল্পনার দিকে আগানো থেকে রক্ষা করি। ’ ‘তুমি আমাকে নোংরা বলছো?’ ‘না, তোমাকে নোংরা বলছি না। নোংরা বলছি তোমার পরিকল্পনাকে। ’ ‘তুমি পারবে?’ ‘কী?’ ‘আমাকে ফেরাতে?’ ‘পারবো।

তবে এ জন্য আমাকে তোমার সাহায্য করতে লাগবে। ’ ‘আমি তোমাকে সাহায্য করবো কেন?’ ‘তুমি সাহায্য করবে তোমার নিজের জন্য। ’ ‘নিজের জন্য?’ ‘হ্যাঁ, নিজের জন্য। কারণ আমি আলাদা কেউ নই। আমি বাস করি তোমার ভেতরে।

’ মিসেস জলি বললেন, ‘আমাকে এখন কী করতে হবে?’ ‘রুহানকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে। ’ রেগে গেলেন মিসেস জলি। ধমক দিয়ে বললেন, ‘এ্যাই মেয়ে! এ্যাই! ফাজলামো করো, না? রুহানকে বাড়ি থেকে বের করে দেব?’ আয়না মানবী রাগলো না। আগের চেয়ে আরো স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘দেখো জলি। তুমি শুধু শুধুই রেগে যাচ্ছ।

রুহানকে বের করে দেয়া বলতে আমি বুঝাতে চাইছি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে তোমার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে। সে তোমার দৃষ্টি সীমানার বাইরে থাকলে তাকে নিয়ে তুমি হাবিজাবি ভাববারও সুযোগ পাবে না। ’ জলি বললেন, ‘আমি তো সেটা করবো না। সতের বছর থেকে রুহানকে আমি আদরে মমতায় ভালবাসায় বড় করে তুলেছি। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, একদিন ওকে না দেখলে আমি পাগল হয়ে যাবো।

’ ‘তোমার কি পাগল হতে বাকি আছে?’ মিসেস জলি আর কোনো কথা বললেন না। আয়নার সামনে থেকে সরে আসলেন। মাথায় ভোতা ধরণের যন্ত্রণা করছে। কিছুক্ষণ লাইট নিভিয়ে শুয়ে থাকতে হবে। সব'চে ভাল হতো ঘন্টা দু'য়েক ঘুমিয়ে নিতে পারলে।

সেটা সম্ভব হবে না। হাজার চেষ্টা করেও দিনের বেলা ঘুমুতে পারেন না তিনি। এই মহান অভ্যাসটি এখনও তিনি রপ্ত করতে পারেন নি। চলবে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।