মনের জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবনাগুলোর মিলিয়ে যাওয়া দেখি। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ হয়ে, ঐ দূর দিগন্ত পানে... তারিখ দিয়ে লেখাটা শুরু করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মনে করতে পারছিনা আজ কই তারিখ। আষাঢ়ের ৫ তারিখ সেটা মনে আছে কিন্তু ইংরেজী সালের কই তারিখ, হুম! যাক ভালোই হল তারিখ ভুলে। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হারিয়ে যেতে চলেছি, তারিখ মনে রেখে কি হবে? ট্রেনে বসা এখন, ঝাঁকুনি খেতে খেতে একটা পেপার টাওয়ালে লিখছি। গন্তব্য একটা আছে অবশ্য।
কিছু কথা মনে পড়ছিল, সেগুলো লিখতে যেয়েই এই পেপার টাওয়াল বের করা কিন্তু এখন আর সেই কথা ধরা দিচ্ছে না। কি যে অবস্থা...যখন যেটা মনে করতে চাই সেইটাই মনে পড়ে না।
একটা স্প্যানিশ বাচ্চাকে স্ট্রলারে করে তার মা এসে বসেছিলেন আমার সামনের সীটে। বাচ্চাটা এমন গুল্লুস গাবলুস দেখতে যে ইচ্ছে করে গাল ঠেনে দিই। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক করে বাচ্চাটা আমার দিকে তাকালো।
আমি তার দিকে চেয়ে হাসলাম একটু। সে থাকিয়ে থাকলো আমার দিকে চোখ রেখে। একটা কথা মনে পড়ছিল...বাচ্চাদের সাথে staring competition এর কথা বলছিল একটা সাইটে, নির্মল আনন্দ পাওয়ার জন্য। তো আমি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছি আর সেও তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ফিক ফিক করে হাসতে লাগলো। মায়ের পাশের সীটে এক ভদ্রমহিলা ম্যাগাজিন পড়ছিলেন।
একসময় সেই মহিলাও দেখি যোগ দিয়েছেন বাচ্চাটাকে হাসানোর কাজে। ম্যাগাজিনের পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে বাচ্চাটাকে দেখাচ্ছেন। পুরো ব্যাপারটার মাঝে এমন এক স্বর্গীয় উপলব্ধি ছিল যে মুহূর্তেই পরিবেশটা কেমন যেন সুন্দর হয়ে উঠলো। আমার নিশ্চিত মনে হয়, এই নিষ্পাপ দেবশিশু গুলো রয়েছে বলে পৃথিবীটা আজও বাসযোগ্য হয়ে আছে।
হেডফোনে গান বাজছে।
তার ছন্দের সাথে মনে মনে সুরের ফানুস উড়াচ্ছি। পছন্দের গান বাজছে। মনটা আজ একটু বেশীই ভালো। কাল সারাদিন অমন ঝড়-বাদলের পর সূর্যিমামা আজ হাস্য-কল্লোলে মেতে উঠেছে। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীকে নিজের সূর্যরশ্মির ভাণ্ডার অবমুক্ত করে দিয়ে চোখে গগলস একটা লাগিয়ে মামা আজ আয়েশ করছে।
কেমন ফুর্তি ফুর্তি উৎসব উৎসব ভাব চারদিকে...
হয়তো এই সব আমার মনেই...কে যেন বলছিলেন, আমরা যখন যেমন থাকি তেমনি করেই আমরা আমাদের চারপাশটাকে দেখি।
...
তখন হঠাৎ করে ট্রেন থেকে নেমে পড়াতে লেখা বন্ধ করতে হল। যে ট্রেনে উঠেছিলাম শুরুতে সেটি আমার গন্তব্যে যাবে না। অন্য ট্রেন ধরতে হল। সেই ট্রেন নিয়ে অনেক ঘুরপথ পেড়িয়ে তবেই গন্তব্যে পৌঁছেছি।
অবশ্য তার আগে অন্য একটা জায়গায়ও উঠে পড়েছিলাম। সেই কথায় পড়ে আসছি। এখন বসে আছি একটা ফেরীতে। যাচ্ছি একটা আইল্যান্ডে। ফেরীতে উঠতে যাওয়ার পথিমধ্যে এক জায়গায় দেখি শ্যুটিং চলছে।
আমি ক্যামেরাটা বের করতে করতে শ্যুটিং এর দিকে যাব ভাবছি এমন সময় দেখি আমার আশেপাশের মানুষজন চেঁচাতে শুরু করেছে। ব্যাপার কি। দেখি কালো একজন, মানুষজনের দিকে থাকিয়ে হাত নাড়ছে। আর্রে উইল স্মিথ! আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল অথচ ছবি উঠাতে পারিনি :-(। তার পিছু নিব ভাবছি দেখি সিকিউরিটি মানুষজন আর সামনে যেতে দিবে না।
কি আর করা, শব্দের ফ্রেমে না হয় এইখানেই বন্দী করে রাখি মুহূর্তটা। দূর থেকে একটা ছবি উঠিয়েছিলাম যদিও বা, কিন্তু তাকে বোঝা যাচ্ছে না। দেখে তো মন হল বুঝি ম্যান ইন ব্ল্যাক এর কোন সিকিউওল এর শ্যুটিং চলছে।
এইবার বলি তখন কোথায় উঠে পড়েছিলাম। উঠেছি হ্যালিকপ্টারে ।
জ্বী না একটুও মজা করছিনা। সত্যি সত্যি। এই কাজটা করতে আমার দারুণ মজা লাগে। এই যে, হয়তো যাচ্ছি কোথাও বা করছি কিছু মাঝখানে অন্য কোথাও বা ভিন্ন কিছু করা। দারুণ এই নিয়ম ভাঙ্গার এক একটা মুহূর্তগুলো :-)।
আর আমিতো চলেইছিলাম উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে কোথাও হারিয়ে যেতে। ঠিকই যাচ্ছিলাম গন্তব্যের দিকে। মানে ফেরীতে উঠতে। যেতে যেতে দূর থেকে দেখি একটা লোক কজনের একটা গ্রুফকে বলছে হ্যালিকপ্টারে চড়ার কথা। আমি দূর থেকে তাদের দেখছিলাম আর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম তার হাতে ধরা ব্রাউচারটার দিকে।
আমি আমার মত তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। ক-কদম যেয়ে দূর থেকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কত ডলার। জানা ছিল হ্যালিপ্যাডটা পাশেই। এমনকি ঐ হ্যালিপ্যাডে যেয়ে চপারে চড়ার বাসনাও মনে পুষে রেখেছিলাম বেশ অনেকদিন থেকে। হাডসন নদীর উপড়েই হ্যালিপ্যাডটা।
তো দামটা যুক্তিযুক্তি মনে হওয়ায় তাকে বললাম, যাওয়া যাক।
সিকিউরিটি চেক সেরে ছবি উঠিয়ে নিয়ে, গ্রাউন্ড ক্রু আমি একা দেখে আমাকে বসতে বললো একেবারে পাইলটের পাশের সীটেই। আমাদের সাথে পেছনের সীটে ছিল সুইডিশ এক ফ্যামিলি। সুইডিশ জানি কারণ পাইলট কথাচ্ছলে জানতে চাইছিল তারা কোত্থেকে এসেছে। আর তারা হ্যাডসেটে উত্তর দিয়েছিল।
পাইলট মশায় আমাদের হেন তেন উপদেশ দিতে লাগলেন। আমার মনে তখন কোন ভাবোদয় হচ্ছিল না দেখে একটু অবাকই হচ্ছিলাম। উত্তেজিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু মন ভাবলেশহীন। যেন বলছে এ আর এমন কি। অভিভূত হওয়ার ক্ষমতা দিনে দিনে লোপ পাচ্ছে কিনা ভেবে একটু শঙ্কিতই হলাম।
পরে মনে হল মন হয়তো আরো অভিনব কিছু খুঁজছে উত্তেজিত হওয়ার জন্য। হ্যালিকপ্টার আস্তে আস্তে উপড়ে উঠছিল আর আমিও ক্যামেরাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ছবি উঠানোর কাজে।
এত্তগুলো বছর যে শহরে কাটিয়েছি সেই শহরটাকে ভিন্ন আঙ্গিকে, নতুন রূপে দেখার এমন সুযোগ হয়তো বারে বারে আসবেনা। স্মরণীয় হয়ে থাকবে উপড়ে কাটানো মুহূর্তগুলো। ভাষায় বর্ণনা করার চাইতে উঠানো ছবিগুলোই হয়ে থাক সেই মূহুর্তগুলোর সাক্ষী হয়ে।
সে যাক, এখন উপভোগ করি ফেরী ভ্রমণ। গান শুনতে শুনতে।
গভর্ণস আইল্যান্ডে নদীর পাড়ে একটা বেঞ্চিতে বসা এখন। বসে বসে মনের পালে হাওয়া লাগাচ্ছি...
"তোমার খোলা হাওয়া, লাগিয়ে পালে, তোমার খোলা হাওয়া...
টুকরো করে কাছি, ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি॥"
ডুবতে রাজী কিনে বলতে পারছিনা তবে হাওয়াটা লাগছে মন্দ না। নদীর ঢেউ আইল্যান্ডের দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে খেয়ে ফিরছে।
গানবাজনার আওয়াজ পাচ্ছি আমার পেছনে। বোধহয় কনসার্ট হচ্ছে। উঠে দেখতে হয়...
...
ফিরে যাচ্ছি। ফেরীতে বসা। মনটা কেন যেন হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল।
আসার সময় আকাশে কোন মেঘ ছিল না এখন দেখি থোকা থোকা গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ। মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা হাসি মেঘকে দিয়ে বললাম যেন পৌঁছে দেয়, যেখানে মেঘের প্রেয়সী রয়েছে, দূর সুদূরের সেই অলকাপুর, নাকি...:-)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।