১
গ্রামীন ব্যাংক থেকে ডঃ ইউনূসকে সরকারী আদেশে পদত্যাগ করানোর মধ্য দিয়ে যে সংকট তৈরী হয়েছে, তা’ মিডিয়ায় ইউনূস-হাসিনার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব হিসেবে প্রচারিত হলেও আদতে তা’র মূল ব্যক্তিগত বলয়ের থেকেও অনেক গভীরে, তারা যে যে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তা’র কাঠামোর মধ্যে; অর্থ্যাৎ এই দ্বন্দ্ব মূলতঃ তৃতীয় বিশ্বের উদীয়মান জাতি-রাষ্ট্র আর এনজিও-র মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এই পোষ্টে আমি আলোচ্য বিতর্ককে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের (State Building) প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক (institutional) দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।
বাংলাদেশে সরকারের সাথে এনজিওদের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। ২০০১ সালের আগে আওয়ামীলীগ শাসনামলে কতিপয় এনজিও-র বিরুদ্ধে জামায়াতের সাথে সম্পর্ক এবং তার ফলে সেসব এনজিও-র উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ দিয়ে শুরু, আর ২০০১ সালের নির্বাচনের পর প্রকাশ্যে এই দ্বন্দ্ব দেখা যায় বিএনপি-প্রশিকার দ্বন্দ্ব আকারে। এরপর ছোট-মাঝারি আকারের অনেক এনজিও সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা লাভ করে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এসে এই দ্বন্দ্ব আরো প্রকট আকার ধারণ করে, যা’র প্রকাশ দেখি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রশিকা থেকে কাজী ফারুকের বহিস্কারের মধ্যে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, বিশেষ করে সত্তরের দশকে ইউরোপীয়দের উপনিবেশগুলো একে একে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে এশিয়া-আফ্রিকা জুড়ে। এইসব স্বাধীন রাষ্ট্রে ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের মডেল “আরোপ” করা হলেও এগুলোর বেশিরভাগেই জাতীয়তাবোধ ছিল সবেমাত্র সূতিকাগারে, অথবা অজানা। ফলে এইসব দেশের মধ্যে গোত্র-বর্ণ-ধর্ম-অঞ্চলভেদে অন্তর্কলহ লেগে যায়, আর সেই সুযোগে দেশে দেশে সামরিক বাহিনী বা কোন বিশেষ মতবাদের আশ্রয়ে জেঁকে বসে স্বৈরতন্ত্র যা’ সত্তর ও আশির দশক পর্যন্ত মোটামুটি একাদিক্রমে শাসন চালিয়ে যায়। এই সময়কার বিশ্ব-মুরুব্বীরা- বিশেষ করে আমেরিকা এবং অন্যান্য সাবেক উপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহ- নিজেরা গণতন্ত্রের চর্চা করলেও তৃতীয় বিশ্বের এইসব উদীয়মান রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতন্ত্রকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে।
কারণ, এইসব নবীন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যিক প্রতিষ্ঠান (যেমন, স্বাধীন মিডিয়া, সুশীল সমাজ, লোকপ্রশাসন, ইত্যাদি) না থাকায় গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার নির্বাচন ও শাসনকার্য পরিচালনা কঠিন হবে, ফলে প্রায়শঃই যুদ্ধ-মারামারি-দূর্যোগ ইত্যাদিতে সাধারণ জনগণের দূর্ভোগ বাড়বে। অতএব, বেসরকারী সেক্টর এবং এনজিও (বা সুশীল সমাজ ) এর মাধ্যমে বাজারব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্ভব ও বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। – এরকম প্রেক্ষাপটে আমরা দেখি যে, এশিয়া-আফ্রিকায় স্বৈরশাসকদের ক্ষমতায় বহাল রেখে প্রথম বিশ্বের “দাতা দেশসমূহ” তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোতে নানার রকমের “উন্নয়ন অনুদান” দেওয়া শুরু করে যা’ প্রধানতঃ এনজিও-দের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে(=জনকল্যাণে) ব্যয় করা হয়। কিন্তু দুই দশকের উন্নয়ন-প্রচেষ্টার পরও দেখা যায় এইসব দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণে আশানূরূপ ফল লাভ হয়নি। এই থেকে একাডেমিক পরিমন্ডলে গবেষকরা তৃতীয় বিশ্বে উন্নয়নকে নতুনভাবে বোঝার চেষ্টা শুরু করেন।
২
বর্তমানে ষ্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক James Ferguson দক্ষিন আফ্রিকার মধ্যস্থিত রাজাশাসিত ক্ষুদ্র এবং দরিদ্র রাষ্ট্র লেসেথোর উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে গবেষণা করে প্রকাশ করেন Anti-politics Machine: Development, Depoliticization and Bureaucratic Power in Lesotho (1986)। তিনি উল্লেখ করেন যে, সত্তর এবং আশির দশক জুড়ে লেসেথোতে যে পরিমাণ অনুদানের অর্থ উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে যে, সেই অর্থ লেসেথোর জনগণকে নগদ দিলে লেসেথোর মাথাপিছু আয় মধ্যম আয়ের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যেতো। দুই দশকের যাবতীয় উন্নয়ণ প্রকল্প লেসেথোর দারিদ্র্য দূর করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, এই ক্রমাগত ব্যর্থতার পরও দাতারা একই রকম প্রকল্পে অর্থের যোগান দিয়েই চলেছে। এখান থেকে ফার্গুসন প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, দারিদ্র্য বিমোচনে ক্রমাগত ব্যর্থ এইসব প্রকল্প কেন+কিভাবে টিকে থাকছে? দারিদ্র্য দূরীকরণ ছাড়াও কি এসব উন্নয়ণ প্রকল্পের আলাদা কোন ফলাফল আছে যা’ দাতা+শাসক+সুশীল সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সাধারণতঃ অনালোচিত ?- তিন বছরের এথনোগ্রাফিক গবেষণায় তিনি এইসব উন্নয়ন প্রকল্পের এমন ফলাফল দেখলেন যা’ সাধারণতঃ উন্নয়ণ আলোচনায় উল্লেখ করা হয়না- যেমন, (১) স্থানীয়দের প্রতিরোধ এড়িয়ে রাষ্ট্রের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রশাসনিক ক্ষমতার বিস্তার, এবং (২) দারিদ্র্যকে একটি অরাজনৈতিক+টেকনিক্যাল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যা’ উন্নয়ণ সংস্থা+এক্সপার্টদের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য।
অন্যান্য প্রাক-উপনিবেশিক রাষ্ট্রের মত লেসোথো’র প্রশাসনিক (বা আমলাতান্ত্রিক) ক্ষমতা ছিল রাজধানী এবং প্রধান প্রধান শহরাঞ্চলের মাঝে সীমিত। রাষ্ট্রের অনেকাংশ কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সরাসরি ক্ষমতার বাইরে ছিল। এসব অঞ্চলে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ক্ষমতা বিস্তার ও বৃদ্ধির প্রচেষ্টা স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাঁধার মুখে অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে। এই অবস্থায় উন্নয়ণ সংস্থাগুলো দারিদ্র্যকে এমন একটা টেকনিক্যাল সমস্যা হিসেবে উপস্থাপণ করে যা’ উপযুক্ত প্রযুক্তি এবং প্রযোজনীয় মূলধনের সমন্বয়ে দূর করা সম্ভব। আর তাই, দারিদ্র্য দূর করার জন্য অতি দরকারী এইসব প্রযুক্তি এবং মূলধন নিয়ে লেসোথো’র প্রত্যন্ত অঞ্চলে নানান এনজিও আসে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ৫/৬ বছর মেয়াদী নানামুখী প্রকল্প নিয়ে।
তারা সেসব অঞ্চলে চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট বানায়, অফিস এবং আবাসনের জন্য পাকা ঘরবাড়ী বানায়, কেনাবেচার জন্য বাজার বসায়, অর্থ লেনদেনের জন্য ব্যাংক বসায়। একদা অচঞ্চল-শান্ত-স্থবির এইসব গ্রামাঞ্চল সহসাই কর্মব্যাস্ত হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের দারিদ্র্যপীড়িত এইসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে উন্নয়ণ কর্মকান্ডের জোয়ার শুরু হয়। কিন্তু যেই মাপকাঠিতে দারিদ্র্যের বিচার হয়, তা’ আগের থেকেও আরো খারাপ ধারণা দেয়, উন্নয়ণের নানান ইন্ডিকেটরে লেসোথোর মানুষের সার্বিক অবস্থা আরো দরিদ্র বলে প্রতিভাত হয়। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলে এনজিওরা চলে যায়, ফেলে যায় দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, ব্যাংক, বাজার, ইত্যাদি নানান প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো।
রাষ্ট্র তখন বিনা খরচে এবং বিনা প্রতিরোধে সেইসব নিজের আয়ত্বে নিয়ে নেয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণ করে নিজস্ব প্রশাসন (থানা, সেনা ছাউনী, সরকারী অফিস, ইত্যাদি)।
এভাবে, উন্নয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে অল্প সময়ে রাষ্ট্রের অবকাঠামো উন্নয়ণের পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ক্ষমতা ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ে রাষ্টের সর্বত্র। এভাবে উন্নয়ণ কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে মাত্র ২/৩ দশকেই তৃতীয় বিশ্বের এইসব রাষ্ট্রে সারা দেশের উপর কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ক্ষমতার বিস্তার সম্পন্ন হয়।
৩
আধূনিক জাতি-রাষ্ট্র পূর্বের সাম্রাজ্য বা রাজত্ব থেকে এই অর্থে আলাদা যে, প্রথমটির শাসনকার্যে জনগণ নিজেদের শাসক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের শাসনকার্যে অংশ নেয়, যা সাম্রাজ্য বা রাজ্যে অনুপস্থিত। তাছাড়া, জাতি-রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ক্ষমতা সাম্রাজ্য/রাজ্যের থেকেও অনেক বেশি বিস্তৃত (expansive), সমন্বিত (comprehensive)এবং শক্তিশালী (intense)।
জাতি-রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতে ইউরোপে সাম্রাজ্য (বিশেষ করে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স) এবং অন্যান্য ছোট রাজ্যসমূহ আনুমানিক দুইশ বছর ক্রমাগত আভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে (war-making) মধ্যযুগের “রাজার প্রতি প্রজাদের নিঃশর্ত আনুগত্য” আজকের থেকে “নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের বিনিময়ে রাষ্ট্রের আনুগত্য” পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পেট থেকে জন্ম নেওয়া তৃতীয় বিশ্বের এই জাতি-রাষ্ট্রসমূহ এই প্রক্রিয়ার বাইরে ছিল। ফলে এখানে সম্রাট/রাজার সাথে জনগণের কোনরূপ বোঝাপড়ার (social contract) দরকার হয়নি। এখানকার প্রজারা শুধুই প্রজা, আগে উপনিবেশের অধীনতা স্বীকার করতো, এখন করে স্থানীয় শাসকের যারা সাধারণতঃ জনগনের থেকে বিচ্ছিন্ন (অথবা ক্ষমতায় গিয়ে বিচ্ছিন্ন)।
ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্রে ক্ষমতা নির্ধারণ করে সেখানকার জনগণ বা নাগরিকরা, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের এইসব নবীন জাতি-রাষ্ট্রের স্বৈরশাসকরা ক্ষমতা অর্জন+সংহত করে সাবেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহের মদদে।
আর তাই, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ক্ষমতা জনগণের সাথে প্রায়শঃই সাংঘর্ষিক। ফলে রাষ্ট্রের প্রশাসন বিস্তারের যেকোন প্রয়াসে স্থানীয় পর্যায়ে সংঘাতের সম্ভাবনা বিদ্যমান। এই পরিপ্রেক্ষিতে দারিদ্র্য বিমোচনে ক্রমাগত ব্যর্থতা সত্ত্বেও উন্নয়ণ প্রকল্পে পরিবর্তন-পরিমার্জন না করে একই ধারা বজায় রাখার কারণটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
এখানে লক্ষ্যনীয় যে, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ণ মহাযজ্ঞে সাধারণভাবে তিনটি পক্ষ দৃশ্যমানঃ (১) জনসাধারণ যারা প্রধানতঃ দরিদ্র এবং সাহায্যের মুখাপেক্ষী, (২) দেশীয় শাসক যারা ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং স্থায়ী করতে আগ্রহী, এবং (৩) বিদেশী প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহ যারা নিজ নিজ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা ও সম্প্রসারণে আগ্রহী।
বিদেশী রাষ্ট্রসমূহ, যাদেরকে আমরা সাধারণভাবে “দাতা দেশ” বলে জানি, তারা নানা রকম অনুদানের মাধ্যমে দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে।
ফলশ্রুতিতে সেইসব দেশের তাদের পণ্যের বাজার তৈরী+বিস্তৃতি ঘটে। ,যেমন- ইন্দোনেশিয়ায় জাপানীজ ইলেক্ট্রনিক ও অটোমোবাইল ইন্ডাষ্ট্রি এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে ইন্দোনেশিয়া কর্তৃক জাপানকে সমর্থন। ইন্দোনেশিয়ার স্বৈরশাসক জেনারেল সুহার্তো জাপান (এবং অন্যান্য প্রভাবশালী দাতা দেশসমূহ) এর আর্থিক ও রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা পেয়ে সত্তর ও আশির দশকে সুদীর্ঘকাল ক্ষমতায় টিকে থাকে। এই সময়ে ইন্দোনেশিয়ায় উন্নয়ন প্রকল্প ও অনুদানের ব্যাপক প্রবেশ সত্বেও এখানকার দরিদ্র সাধারণ জনগণ দরিদ্রই থেকে যায়। [ফিলিপাইনের মার্কোস,পাকিস্তানের জিয়াউল হক, আমাদের এরশাদ এরা সবাই একই দলের]।
৪
নব্বইয়ের দশকে এসে পুরো তৃতীয় বিশ্ব জুড়েই পরিবর্তনের ঢেউ লাগে। দেশের দেশে স্বৈরাচারের পতন শুরু হয়, তাদের স্থলে ক্ষমতায় আসে জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলসমূহ এবং তাদের জনপ্রিয় নের্তৃবৃন্দ। পুর্বের শাসকদের মতো প্রশাসনিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না করে এরা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেয়। পাশাপাশি শিল্প ও অর্থনীতি থেকে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ কমিয়ে বেসরকারী উদ্যোগকে উৎসাহিত করার নীতি অবলম্বন করে যা’কে আমরা জানি “মুক্ত বাজার অর্থনীতি” হিসেবে। বেসরকারী বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্পায়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নানা রকম ইন্সেনটিভ দিয়ে জাতীয় অর্থিনীতিকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
এই সময়কে প্রধানতঃ বিশ্বায়নের যুগ বলে অভিহিত করা হয়। বিশ্বপুঁজির অবাধ চলাচল অর্থনীতি, রাজনীতি,সমাজনীতি সহ সর্বক্ষেত্রে এতটাই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যে, কেউ কেউ বিশ্বপূঁজির কাছে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা দূর্বল হয়ে যাচ্ছে বলে মত প্রকাশ করেন (Appadurai, 1996)। কারণ, পুঁজির প্রয়োজনে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র নতুন আইন প্রনয়ণ করে (যেমন, কপিরাইট আইন, পরিবেশ আইন, ইত্যাদি), বিদ্যমান আইন সংশোধন করে (যেমন, সম্পত্তি আইন, শরীয়া আইন, ইত্যাদি), নতুন শিল্পনীতি, বানিজ্যনীতি, ইত্যাদি তৈরী করে। কিন্তু বিশ্বপুঁজির এই প্রবাহ স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
উদাহরণস্বরূপ, ক্রমাগত শিল্পায়ণ ও বানিজ্যিকীকরণের ফলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে যা’ স্থানীয় জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে, যেমন ভারতের ‘নর্মদা বাঁধ বিরোধী আন্দোলন’, আমাজানের রাবার সংগ্রাহকদের আন্দোলন, ইত্যাদি। স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠিত এইসব প্রতিরোধ আন্দোলনকে আপাদুরাই বলেছেন Grassroot Globalization (2001)।
উন্নয়ণ প্রকল্পের একটা প্রধান সেক্টর হল গণশিক্ষা যা’ সাধারণ জনগণকে তাদের রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নানান অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। গণভোটে তাদের অংশগ্রহন এবং এর ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন বৃদ্ধির ফলে সরকারের সাথে জনগণের দূরত্ব পূর্বের থেকে হ্রাস পায়। নিয়মিত ভাবে ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনের ফলে জনগণের কাছে শাসকদের জওয়াবদিহীতার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়।
এ’ অবস্থায় জনগণকে পাশ কাটিয়ে স্বৈরশাসকদের ন্যায় ইচ্ছেমত আইন করা এবং সরকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে যা’ বিশ্বপুঁজির স্বার্থের জন্য সময় সময় ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। [যেমন বাংলাদেশে ফুলবাড়ি কয়লাখনিতে বিনিয়োগ, পশ্চিমবঙ্গে টাটার বিনিয়োগ, ইত্যাদিতে সরকারের ইচ্ছে থাকা সত্বেও স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের মুখে পুঁজি পিছু হটে]।
এরফলে তৃতীয় বিশ্বে শাসন ক্ষমতায় জনগণের কাছে মুখাপেক্ষী সরকারের বদলে এমন ধরণের শাসক/শাসন দরকার হয়ে পড়ে যারা জনগণের ভোটের উপর নির্ভরশীল নয়। এই পর্যায়ে বিশ্বপুঁজির পেছনের শক্তিসমূহ তৃতীয় বিশ্বে গণমুখী রাজনৈতিক দলের শাসনকে অস্থিতিশীল করে তোলে (বিভিন্ন দেশে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমেরিকা আর ব্যক্তিপর্যায়ে জর্জ সোরসের ভূমিকা স্মর্তব্য), আর বিকল্প হিসেবে সুশীল সমাজকে শক্তিশালী করার প্রয়াস পায় যারা জনগণের মধ্যে ক্ষমতাবান অথচ তাদের মুখাপেক্ষি নয়।
তৃতীয় বিশ্বব্যাপী চলমান উন্নয়ণ প্রকল্পে ক্ষুদ্রঋণের নতুন ভূমিকার শুরু এই সময়।
ক্ষুদ্রঋণ মূলতঃ অলাভজনক; কারণ, একে টিকিয়ে রাখার জন্য বাইরে থেকে ভর্তুকি দিতে হয় (ডেনিয়েল পার্ল এই বিষয়টি সর্বপ্রথম ২০০১ সালে মিডিয়ায় নিয়ে আসেন)। এর মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অধীনে নিয়ে আসে যা’র ফলে তারা সম্মিলিত ভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা হারায়। এই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাই ফুকোর বর্ণীত Disciplinary Power (1974)। এই ক্ষমতা সমগ্র সমাজের (society as a whole) উপর খবরদারীর বদলে ব্যক্তির (individual) ছোটবড় সমস্ত কাজকর্ম, চলাফেরা, আচার-আচরণ, গতি-প্রকৃতি, ইত্যাদির উপর খবরদারী করে (যেমন, ক্ষুদ্রঋণ সমিতির একেকজন সদস্যদের সকল কার্যক্রমে খবরদারী করে- সদস্যদের জন্য গ্রামীনের নির্ধারিত ১৬টি নীতি স্মর্তব্য যা’ তারা প্রতি সপ্তাহে একত্রে মুখস্ত করে ও বলে); এই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য ব্যক্তির বিচার (ভালো ব্যক্তি/মন্দ ব্যাক্তি) থেকে সড়ে গিয়ে ক্ষমতা চর্চাকারী সংস্থার কার্যক্রম, সফলতা/ব্যর্থতার উপর নিবদ্ধ হয় (যেমন, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহিতার আর্থিক সাফল্য/ব্যর্থতার বদলে ঋণ প্রদানকারী সংস্থার লাভ-ক্ষতির হিসাবঅকে গুরুত্ব দেয়); এই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কি ফলাফল লাভ করা হচ্ছে তা বিবেচনার বদলে ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াকে মূখ্য ধরে নেয় (ক্ষুদ্রঋণ প্রধানকারী সংস্থাগুলো সদস্যদের নানান কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের ফলে কি কি লাভ করলো সেই হিসাবে কখনোই মনোনিবেশ করে না, কিন্তু সেইসব নিয়ন্ত্রণ যাতে নীরবচ্ছিন্ন ভাবে চলে তা’ নিশ্চিত করে)।
এই ক্ষমতা ব্যক্তির জন্য শোষণমূলক হলেও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক; কারণ, প্রতিষ্ঠান নিত্য নতুন পদ্ধতি আরোপে করার মাধ্যমে ব্যক্তির শরীর থেকে সর্বোচ্চ ব্যবহারযোগ্যতা (utility) আদায় করে নিতে পারে ব্যক্তির কোন প্রকার প্রতিরোধ ছাড়াই।
Disciplinary Power অধীনস্ত ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে কিছু অদৃশ্য, কিন্তু উপলদ্ধিযোগ্য (objective) পদ্ধতির মাধ্যমে যা’কে ফুকো বলেছেন mechanics of power; বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামাজিক প্রক্রিয়া এবং অবস্থানের মধ্য থেকে এদের উদ্ভব হয়, ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে বিকাশের নানা পর্যায়ে এদের কার্যক্ষেত্র+পদ্ধতি একে অপরের মধ্যে মিশে (support, overlap, repeat, imitate) গিয়ে একটা সমন্বিত ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতার জন্ম দেয় যা’র কাছে প্রত্যেক ব্যক্তিই অধীনস্ত। এই ক্ষমতা এমন এক ব্যক্তিস্বত্ত্বার জন্ম দেয় যে শুধুমাত্র ক্ষমতার আদেশই মান্য করে না, বরং সেই আদেশ কি কি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে হবে, কোন গতিতে করতে হবে, শরীরের কোন অংগকে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, ইত্যাদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়েও নির্দেশনা মেনে নেয়। এরফলে অধীনস্ত ব্যক্তির স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতার পাশাপাশি স্বাধীন চিন্তা+মতপ্রকাশও অসম্ভব হয়ে পড়ে। [আমেরিকায় কাউকে পুলিশ প্রথমবারের মত ক্রিমিনাল অফেনসে ধরলে তাকে কারেকশনের জন্য একটা সিডি দেয় যেখানে আমেরিকার জেলখানার অভ্যন্তরের অবস্থা এবং সেখান থেকে বের হয়ে আসা কয়েকজনের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তাদের জেলের অভিজ্ঞতা দেখানো হয়েছে। পরিচিত একজনের কাছ থেকে দেখেছিলাম একটা।
আমার কাছে মনে হয়, ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা বোঝার জন্য এর থেকে সহজ+কার্যকরী আর কিছু নেই]।
৫
বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের ব্যাপক বিস্তারের শুরু মূলতঃ ১৯৯০-এর দশকে। অল্প সময়ের মধ্যে দেশ কতগুলো প্রাকৃতিক দূর্যোগের শিকার হয়, যেমন- ১৮৮৮, ১৯৯৬ ও ৯৮ এর ব্যাপক বন্যা। এসময় বাংলাদেশে বেশ কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়ঃ বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে, নারী শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহন করে, গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মাঠপর্যায়ে বিস্তৃত করে। নতুন নতুন এইসব কর্মসূচীতে সরকারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনের বদলে বেসরকারী পর্যায়ের অংশগ্রহন প্রধান হয়ে ওঠে, সরকার থাকে তাদের সহযোগীর ভূমিকায়।
এই পর্যায়ে দেখি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এনজিও ‘ব্যবসা’র প্রসারঃ অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় ব্র্যাক স্কুল (আসলে ছোটবড় সকল এনজিও), সেনিটেশন কার্যক্রমে ব্র্যাক (এবং অন্যান্য এনজিও), ক্ষুদ্রঋণে গ্রামীন (সেই সাথে আশা এবং অন্যান্য এনজিও)।
এইসব গণমুখী কার্যক্রমে শুরুতে জনসেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসলেও সকল এনজিও কার্যক্রমেই মুনাফা লাভের বিষয়টা অবিচ্ছেদ্যভাবে বিদ্যমান, যা’ এনজিওদের ক্রমবর্ধমান “নিজস্ব সম্পত্তি” এবং উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জীবনযাপনে দৃশ্যমান (যদিও কাগজে-কলমে এটা কোন এনজিও স্বীকার করে না)। এসময় বিদেশী রাষ্ট্র এবং দেশীয় সরকার নিজ নিজ স্বার্থে এনজিওদেরকে সকলপ্রকার সমর্থন দিয়ে যায়। বিদেশী রাষ্ট্র উন্নয়ন অনুদান প্রদানের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব জারি রাখতে চায়, দেশীয় সরকার জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য নানান খাতে ব্যয় করা থেকে রেহাই পায়। সরকারসমূহের পাশাপাশি এই সময় বিশ্বপুঁজির আরেক শক্তিশালী পক্ষকে দেখা যায়, এটা হলো জায়ান্ট কর্পোরেট যাকে সংক্ষেপে MNC বলা হয়।
আলোচ্য এনজিও কার্যক্রমে এদের স্বার্থটা হচ্ছে নিজ নিজ পণ্যের (প্রযুক্তি, ভোগ্যপণ্য, ইত্যাদি) বাজারের বিস্তার। যেমন, এনজিওদের সেনিটেশন কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণকে প্রথমে শেখানো হলো টয়লেট এবং খাবার গ্রহনের আগে+পরে ভালো করে (ছাই দিয়ে) হাত পরিস্কার করতে হবে, এখন এসেছে ‘বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস’ যেখানে শেখানো হচ্ছে লাইফবয় সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। একইভাবে আর্সেনিক সম্পর্কিত গবেষণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি প্রকল্পের মাধ্যমে বোতলজাত পানির বাজার তৈরী করা হয়েছে।
এনজিও কার্যক্রমের পরিধি দিন দিন বেড়েই চলেছে, সাথে সাথে জীবনের নানান ক্ষেত্রে তাদের “পরামর্শ+নির্দেশনা+সহায়তা” ইত্যাদির ব্যাপ্তিও বেড়েই চলেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লেনদেন, যৌনতা, সামাজিকতা, নারীপুরুষের সম্পর্ক, বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক, শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক, ইত্যকার দৈনন্দিন বিষয়াদিও ক্রমাগত এনজিও কার্যক্রমের মাধমে এক ধরণের নজরদারী+নিয়ন্ত্রনের আওতায় আসছে।
জনসাধারণের উপর এই যে নিয়ন্ত্রন, এটা দেশীয় সরকার, বিদেশী রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট পুঁজি- সকলের জন্যই উপকারী। এই নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকলে জনগণ নানান ক্ষেত্রে সরকারের ক্রমাগত ব্যর্থতা (আমাদের সরকারের ব্যর্থতার তালিকা সীমাহীন), বিদেশী রাষ্ট্র অযথাই আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো (আমাদের দেশে আমেরিকা বা ভারতের ভূমিকা), বা কর্পোরেট পুঁজির নগ্ন মুনাফা লোভের (আমাদের দেশের মোবাইল ফোন, খাদ্য ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট) বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ তৈরী করতে পারেনা।
বেসরকারী সেক্টরে প্রধানতঃ এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত উন্নয়ণ কার্যক্রমের এই যে অনুল্লিখিত কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবনে প্রভাব- অর্থ্যাৎ, ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা- এর ফলাফল বিচারে কিন্তু কখনোই এইসব কার্যক্রমে ব্যক্তি মানুষ কি অর্জন করলো তা’ মূখ্য নয়, বরং সামগ্রিক ভাবে এই কার্যক্রম অবিরাম ভাবে চলছে কি না, এইসব কার্যক্রমকে আরো এফিসিয়েন্ট ভাবে চালানোর জন্য বিদ্যমান পদ্ধতিতে কি কি পরিবর্তন আনতে হবে, আরো কি কি নতুন পদ্ধতি সম্পৃক্ত করতে হবে, ইত্যাদি বিষয় গুরুত্ব পায়; অর্থ্যাৎ, ব্যক্তি মানুষের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হলেও এই কার্যক্রমের পর্যালোচনায় ব্যক্তির ভালো-মন্দের বদলে চলে আসে কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থার সাফল্য/ব্যর্থতা এবং কিভাবে সংস্থাকে আরো এফিসিয়েন্ট করা যায়!
৬
তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রে উন্নয়ণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা বিস্তারের এই যে প্রক্রিয়া, এখানে দেশীয় সরকার, দাতা রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট পুঁজি একসাথে কাজ করলেও তাদের স্বার্থ আলাদা। একারণে, কখনো কোন পক্ষের স্বার্থ আরেক পক্ষের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হলে স্বভাবতই এই “তিন পাগলের মেলা” ভেঙ্গে পড়ে। আসুন, দেশে চলমান হাসিনা-ইউনূস দ্বৈরথকে উপরে বর্ণিত তাত্ত্বিক কাঠামোর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে দেখি কি পাওয়া যায়ঃ
বিদ্যমান বিতর্কে হাসিনা দেশীয় সরকার প্রধান যে বাংলাদেশের নিজস্ব ভূখন্ডের মধ্যে রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, আমেরিকা অন্যতম দাতা রাষ্ট্র, এবং ডঃ ইউনূস এনজিও সেক্টরের প্রধান মুখপাত্র।
হাসিনা বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনের বলে ডঃ ইউনূসকে গ্রামীন ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছে। ডঃ ইউনূস সেই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আপীল করেছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি ক্ষমতাশালী বিদেশী বন্ধুদের স্মরণাপন্ন হয়েছেন। এর ফলে আমেরিকা আর বৃটেনের সংসদ সদস্যদের কয়েকজন হাসিনার এই পদক্ষেপকে সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছেন এবং ইউনূসের সাথে সমঝোতা করতে বলেছেন (১৮ মার্চের ডেইলী ষ্টার ও ইত্তেফাক দ্রষ্টব্য); এমনকি আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে গিয়ে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন। পাশাপাশি প্রথম বিশ্বে আরো কিছু সরকার প্রধান এবং কর্পোরেট সংস্থা যারা ডঃ ইউনূসকে নানা সময় পুরস্কার ও পুঁজি দিয়ে ক্ষুদ্রঋণকে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে তারা “ফ্রেন্ডস অব গ্রামীণ” নামের এক সংস্থার মাধ্যমে সমবেত হয়ে অবিরাম প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে ডঃ ইউনূসের পক্ষে।
অতএব, এই দ্বন্দ্ব প্রকৃতপক্ষে আমাদের সরকার, দাতাদেশসমূহ এবং এনজিওদের মধ্যকার নিজ নিজ স্বার্থের (তথা, ক্ষমতার) দ্বন্দ্ব।
হাসিনার, তথা দেশীয় সরকারের স্বার্থ হচ্ছে এনজিওদের উপরে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, যা’ ক্ষুদ্রঋণ সম্প্রতি রেগুলেটরী সংস্থা স্থাপন এবং এর মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম তদন্ত করার ঘোষনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। এতদিন এনজিওদের সাথে একত্রে কাজ করলেও এখন কেন সরকার এনজিওদের উপর আরো নিয়ন্ত্রণ চাইছে? – এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ২০০৬ সালের ১/১১ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উপর তার পরবর্তী ফলাফলের মধ্যে। সেই সময় এনজিও কার্যক্রমের প্রত্যক্ষ ফলাফল সুশীল সমাজ রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার প্রতি শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। তাদের মুখপাত্র হিসেবে ডঃ ইউনূসকেও রাজনীতিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল।
ফলে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এনজিও+সুশীল সমাজ একটা অন্যতম প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা দেয়। অতএব, নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতা আর বিদ্যমান আইনের বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডঃ ইউনূসকে পদত্যাগ করার নির্দেশ জারি করেছেন এবং এর মাধ্যমে সুশীল সমাজকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন।
ডঃ ইউনূস দেশের আইন মেনে পদত্যাগ না করে কেন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইছেন? বলা হচ্ছে, তিনি ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি না থাকলে ক্ষুদ্রঋণের আইকন গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতএব, দেশের আইনকে পাশ কাটিয়ে তাকে গ্রামীনের ক্ষমতায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশীদের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য দেশপ্রেম এবং দেশের ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করছেন।
পাশাপাশি তার শক্তিমান বিদেশী বন্ধুদের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন তাকে দেশের আইনের আওতার বাইরে রাখার জন্য। একজন “নোবেল শান্তি” বিজয়ী শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ক্ষমতার মোহে নিজে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, এটা আমি বিশ্বাস করিনা। আমার মতে, ডঃ ইউনূসের অনড় অবস্থান প্রকৃতপক্ষে গ্রামীন ক্ষুদ্রঋণের প্রাতিষ্ঠানিক অস্তিত্বকে সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা।
বিদেশী রাষ্ট্র এবং কর্পোরেটগুলো ডঃ ইউনূসের পক্ষে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে এই বলে যে, ডঃ ইউনূসের মতো একজন বিশ্বব্যক্তিত্ব এবং গ্রামীনের মত একটা দারিদ্র্য বিমোচনকারী সংস্থা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত রোষের কবলে পড়েছে। এই পক্ষ ক্ষুদ্রঋণ (তথা সমগ্র এনজিও) সেক্টরকে সরকারের বিরুদ্ধে সমর্থন করছে তাদের নিজ স্বার্থে; আর এই স্বার্থ কখনো রাজনৈতিক (যেমন, ইসলামের রাজনীতিকরণ এবং বিশ্বব্যাপী ইসলাম তথা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ), কখনো অর্থনৈতিক (যেমন, ব্র্যাকের সদস্যের ‘সুফলা ধান’ নামক হাই ব্রীড কিনতে বাধ্য করা)।
তাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ এখন রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা প্রায়শঃই সম্ভব নয়। একারণে তারা চায় তৃতীয় বিশ্বে একটা অরাজনৈতিক সহযোগী পক্ষ (এনজিও) যারা জনগণের কাছ থেকে কোন প্রকার রাজনৈতিক প্রতিরোধ ছাড়াই তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারবে। অতএব, তৃতীয় বিশ্বের সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতার বিরুদ্ধে গিয়েও এনজিও সেক্টরকে তারা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
পুরো ব্যাপারটিতে তিন পক্ষের নিজ নিজ স্বার্থ এবং এর ভিত্তিতে তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিরুদ্ধতা ও সহযোগিতার প্যাটার্ন আলোচনার মাধ্যমে আরো একটা বিষয় পরিস্কার হয় যে, তারা কেউই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গ্রহিতাদের কি কি লাভ/ক্ষতি হচ্ছে তা’ নিয়ে মনোযোগী নয়, ফলে ক্ষুদ্রঋণের পক্ষে/বিপক্ষে কোন আলোচনাও নেই। মূল ফোকাস হচ্ছে, গ্রামীন ব্যাংক তথা ক্ষুদ্রঋণের নিয়ন্ত্রন এবং এর মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতার পরিধি পুণঃনির্ধারণ, অর্থ্যাৎ, শিল্পক্ষেত্রে সরকার নিয়ন্ত্রনমুক্ত ইপিজেড এর মতো আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও সরকারী নিয়ন্ত্রনমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ (এবং পরবরতীতে এনজিওদের অন্যান্য অন্যান্য সেক্টর) সরকার তার সমস্ত শক্তি (প্রশাসনিক এবং দলীয়), ডঃ ইউনূস তথা গ্রামীন ব্যাংক তথা এনজিও তার সমস্ত শক্তি (বিদেশী বন্ধু সরকার+সংস্থা+ব্যক্তি, গ্রামীন ব্যাংকের কর্মকর্তা+কর্মচারী এবং প্রতিষ্ঠাতার ব্যক্তি-ইমেজ) এবং দাতা দেশসমূহ তাদের সমস্ত শক্তি (কূটনৈতিক প্রভাব) নিয়ে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ নামের তৃতীয় বিশ্বের একটা রাষ্ট্রের সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতার পরিধি ভাগাভাগির লড়াইয়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।