এরকমই, আমি এরকমই
“হাসান!” অবিশ্বাস আর সংশয়, সাথে মেশানো কেমন একটা ভয়-আতঙ্ক, আমি মুঠোফোন হাতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি ঝুল বারান্দাটাতে। ওপাশে রানা আরও কি সব বলে থেমে থেমে, অপরিচিত গলায়, আমি শুনতে পাই না কিংবা শুনলেও কথাগুলো আমার উপর নতুন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।
হাসান এ কাজ করতে পারে না, কখনও না! ওকে আমি তো খুব ভাল করেই চিনি, প্রায় নিজেকে চেনার মত করে। তার মানে কি আমি আসলে নিজেকেও পুরোপুরি চিনি না, জানি না আমার পক্ষে কি ঘটানো সম্ভব! মানুষ মাত্রেই বোধহয় এমন, না? নিজেকেই চেনে না, আরেকজকে বুঝতে যায়। নিজে কানা, পথ চেনে না, পরকে… কী সব ভাবছি! আমার মাথা খালি খালি লাগছে, প্রচন্ড পিপাসা পাচ্ছে।
মা কোথায়? একটু খোঁজ নেয় না কেন এসে আমার?
“ও মা। মা। ” আমি ফিসফিস করে ডাকতে ডাকতে মেঝেতে বসে পড়লাম। মোবাইল ফোনটা হাত থেকে ছুটে একটা ধাতব শব্দে বারান্দায় গড়িয়ে পড়ল।
হাসান কত ভালো ছেলে, না মা? না? তুমিও তো ওকে সেই ছোটবেলা থেকে চেন।
কত মিষ্টি একটা ছেলে, একই সাথে কি দারুন পাজী। মনে আছে মা, সেই যে প্রাইমারী তে পড়ি যখন, ফুটবল খেলার সময় পরে গিয়ে আমার কপাল কেটে গেলো, হাসান প্রায় কোলে করে এনে আমাকে তোমার কাছে দিয়ে গেলো? অথচ তুমি এমন বকাবকি করলে ওকে, বেচারা ভয়ে আর এমুখোই হত না। পরে ওকে কদিন না দেখে তোমার কি উদ্বেগ! খালি “হাসান আসে না কেন রে”, “হাসানকে আসতে বলিস” শুনতে শুনতে আমারই কি রাগ। হা হা।
তারপর যখন কলেজে উঠে দুজন দুই কলেজে চলে গেলাম, মা, তোমারই সবচে বেশি মন খারাপ হয়েছিল, ঠিক না বল? ও তো হোস্টেলে চলে গেল, আমাদের বাড়িতে প্রায় আসতই না।
মনে আছে ঈদে ওকে পেয়ে তোমার কি খুশি, আর আমি ঈর্ষায় লাল হয়ে গেলাম? তুমি আমার কান মলে দিলে, বিটকেলটা কেমন দাঁত বের করে হাসছিলো তখন! হা হা।
তারপর, তারপরের গল্প তো তুমি জানো না মা। জানো তমা’র কথা? তুমি কোত্থেকে জানবে? আমাকেই তো বলেনি ও, আমি জানলাম ইমনের না কার কাছ থেকে যেন। শুনে এমন কষ্ট হয়েছিলো, খুব রাগ লাগছিলো ওর উপর। আমাকে জানায়নি কেন ও! প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ওর সাথে কথাই বলব না আর।
রাখতে পারি নি প্রতিজ্ঞাটা। হা হা।
তমাটা খুব বোকা, খুব খুব বোকা মেয়েটা। নইলে হাসান এভাবে নষ্ট হয়, সেই হাসান! অসম্ভব, কিছুতেই হাসানের এই দশা হয় না, এইভাবে…! উঁহু।
কত কষ্ট পেয়েছে ও বেচারা, তুমি জানো, তমা? জানো না।
তোমরা জানো না, জানতে চাও না। কতদিন হাসানকে আমি হাসতে দেখি নি, জানো? যে হাসান কথায় কথায় প্রাণ খুলে হেসে উঠত, বিটকেলে কথা বলে হাসিয়ে মারত আমাদের! তোমার সাথে আমাকে যেদিন পরিচয় করিয়ে দিল, সেদিন আমার থতমত অবস্থা দেখে ওর সেই অট্টহাসির কথা মনে আছে? ওর হাসি সব তোমার কাছে ফুরিয়ে গেছে, তমা।
একদিন, বহুদিন পরে, ওর বিরস চেহারা সহ্য না করতে পেরে বললাম, “এই ব্যাটা, তোর সমস্যা কি? অ্যামনে থাকিস ক্যান?”
ও কিছু না বলে শুধু চোখ তুলে তাকালো। উফ, সেই চোখ যে কি গভীর, কি দূর্ভেদ্য অন্ধকার সেখানে, তমা! আমি জানতাম না, সেদিনই তোমার বাড়িতে সানাই বাজছিলো, বোকার মত হাসার চেষ্টা করে আবার বললাম, “কোনো সমস্যা থাকলে সমাধান করে ফেল। ”
“আমি নিজেই একটা সমস্যা।
” ও বলল মুখ ফিরিয়ে।
“এটারও সমাধান করে ফেল। ” মরিয়া হয়ে আমি ওকে সহজ করার চেষ্টা করি।
“পারি না রে। ” কি করুণ আর হতাশ গলায় যে কথাগুলো বলছিলো ও, তোমার বাড়ির সানাই এর মত, আমি জানতাম না, কিন্তু ও তো ঠিকই শুনতে পাচ্ছিল।
হায় বোকা আমি! ব্যার্থ চেষ্টা করতে দাঁত বের করে বললাম, “অঙ্ক না পারলে মনমত একটা উত্তর বসিয়ে দে, স্কুলে সেই যে করতাম। ”
“উত্তর তো মিলবে না তাহলে!” ও মাথা নাড়ে। নাহ হাসান, এখনও সেই স্যারদের প্রিয় ভাল ছাত্রটাই রয়ে গেলি, মানুষ হলি না!
“শোন, পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে উত্তর মেলাতে নেই, ওতে লাভ হয় না, দুঃখ বাড়ে, একবারে নম্বরপত্র দেখতে হয়। তুই নিজের মত করে একটা উত্তর দিয়ে দে নিজেকে, সময় যাক, নম্বরপত্রে দেখবি অনেক ভালো রেজাল্ট!” আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বলি।
হাসান একবার আকাশের দিকে তাকালো, মনে হল কাকে যেন খুঁজছে ও, যাকে ডেকে কিছু জবাব চাওয়া যায়, পাওয়া যাবে না জেনেও।
তারপর ধীরে ধিরে আমার দিকে মুখ ফেরায়। মৃদুস্বরে বলে, “উত্তর না মিললে হল থেকে বের হতে দেয় না যে!” একটা হাত ও মাথায় ঠেকায়, অন্য হাতটা বুকে।
আমি পাল্টা কিছু বলতে যেয়ে আর কথা খুঁজে পেলাম না। তাই তো! যতক্ষণ না অঙ্কের উত্তর মিলবে ততক্ষন পরীক্ষার হলের কঠিন দোযখে বসে থাকতে হবে, এমন যদি হয়, আর আমি যদি কিছুতেই অঙ্ক মেলাতে না পারি! কি করার আছে তখন!
পাশাপাশি বসে লেকের পানিতে ঢিল ছুড়তে লাগলাম দুজনে, দুজনেই সমাধান খুঁজছি।
কয়েকদিন পর, আমি হাসানের মেসেজ পেলাম একটা, “অঙ্কের সমাধান না পারলে হলে বসেই ঘুম দিতে হবে বুঝলি! বের হতে দেবে না বলছে, ঘুমাতে দেবে না তো বলে নাই।
হা হা!”
হাসান হাসছে, হাসান ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠছে, কী যে ভাল লাগলো আমার, তমা। কিন্তু এটা এ কী করল ও, ও তো এরকম না, এরকম ছিল না তো ও!
উফ! কে লাইট জ্বালে! মা!
“কি রে, এখানে অন্ধকারে মেঝেতে বসে আছিস কেন? মোবাইল পড়ল কিভাবে, ভেঙ্গেছে না কি?”
আমার মুখের দিকে তাকাও, মা। চমকে ওঠ। জিজ্ঞেস কর কি হয়েছে।
“কি হয়েছে বাবা!” মা চমকায়, তাঁর মুখ সাদা হয়ে যায়।
আমি কি এক প্রচন্ড বিস্ফোরণের ধাক্কায় বাঁকা হয়ে যাই, ডুকরে কেঁদে উঠি, “ও মা!হাসান ঘুমিয়ে পড়েছে, মা! ও অঙ্কটা মেলাতে পারছে না বলে ঘুমিয়ে পড়েছে রে মা!”
বোধহয়, কয়েকটা রাতজাগা পাখি পাখা ঝাপটে উড়ে গেল। না? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।