মৌনকুহর গলির মাথার ওই লজেন্সের দোকানদার হতে শুরু করে মাথার ওপর চরে বেড়ানো বৈমানিক-- কী হতে চাই নি ছোটবেলায়! স্বপ্ন তো ভাই সবাই-ই দেখে, ক্ষণে ক্ষণে আবার রং-ও বদলায় এর। বুদ্ধি হবার পর থেকে নানান রকম স্বপ্ন দেখেছি আমিও। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, সেই স্বপ্নরাজ্যের স্বপ্নিল দুনিয়ায় খুব বেশি ছোটাছুটি করার সুযোগ কপালে জোটে নি। স্বপ্ন আমার স্থিতি পেয়ে গেছে হঠাৎ করেই।
ঘটনাটা ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়কার।
আমাদের ইংরেজি পড়াতেন এক স্যার। একদিন ক্লাসে তিনি আমাকে বোর্ডে ডাকলেন, একটা Translation করতে বললেন। বিশ্বাস করুন, ঐ Translation আমি পারতাম করতে। কিন্তু স্যারের রুদ্রমূর্তি আর হাতের লিকলিকে বেতের সামনে পড়ে কীভাবে যে কী হয়ে গেল, বেমালুম ভুলে গেলাম সবকিছু! ফলাফল, বেদম পিটুনি! সে পিটুনি এমনি পিটুনি যে সপ্তাহখানেক আদুল গায়ে আর কারো সামনে পর্যন্ত যেতে পারি নি। সমস্ত পিঠে যে তখন বিচিত্র রকম জ্যামিতিক আঁকিবুঁকি! আমার স্বপ্ন স্থির হয়ে গেল ওই দিনই, আমি শিক্ষক হব।
না, ওনার মত "বেতওয়ালা" কোন শিক্ষক না। এমন শিক্ষক হব, যে শিক্ষককে দেখে ছাত্রের মনে ভয়ের বদলে ভালবাসার উদ্রেক হয়, উদ্রেক হয় অকৃত্রিম শ্রদ্ধার। এমন শিক্ষক হব, যার সামনে গিয়ে পড়া ভুলে যাওয়া তো দূরে থাক, জিন্দেগিতে না পড়া, একদম না পারা একটা বিষয়কেও পানির মত সহজ ঠেকে।
বছরখানেক আগে ভাইয়ার সাথে একবার ঈদের শপিং-এ গেলাম। প্রচণ্ড ভিড়।
এর মধ্যে বলা নেই কওয়া নেই ভাইয়া হঠাৎ দিল এক ছুট! এমন ছুট যে, আশেপাশের সবাই ভয় পেয়ে গেল, ব্যাপার কী, আগুন-টাগুন লাগল নাকি! কী হচ্ছে কিছু বুঝতে না পেরে ভিড় ঠেলে ভাইয়ার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি, ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। বৃদ্ধও চশমা খুলে হাতে নিয়েছেন, রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম, হচ্ছেটা কী! ভাইয়া-ই বলে দিল,
"আরে, ইনি আমাদের মুস্তাফিজ স্যার, এইটে ক্লাস নিতেন...."।
হ্যাঁ ভাই, শিক্ষক তো এঁরাই।
অমন শিক্ষক হবারই আমি স্বপ্ন দেখি, ছাত্রের ওপর কর্তৃত্ব অর্জনে যার বেতরূপী তলোয়ার হাতে নিয়ে টিপু সুলতান বা ঈশা খাঁ সাজার দরকার হয় না। অমন শিক্ষক হবারই আমি স্বপ্ন দেখি, যিনি কেবলি ভালবাসার জোরে ছাত্রের মনের রাজ্য জয় করে নিতে পারেন অনায়াসে, দখল করে নিতে পারেন চিরদিনের জন্য|
আশার খবর, ইদানিং এই Corporal Punishment বা শারীরিক শাস্তিতে শিক্ষার্থীদের ওপর যে ভয়াবহ প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। এর প্রতিরোধে অনেক কার্যক্রম, নীতিমালা, আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। কিন্তু ভাই, আইন করে যেখানে মতিঝিলের মত এলাকায়, একটা ম্যানহলের ঢাকনা, এত মানুষের মাঝেও চোরের হাত থেকে রক্ষা করা যায় না, সেখানে জনসমাগমহীন কোন এক ক্লাসরুমে শিক্ষকরূপী এই সব 'ডাকাত'-কে ঠেকানোর আশা আপনি কীভাবে করেন? তা যদি সম্ভব হত তবে এত কিছুর পরও দেশের নামী-দামি স্কুলগুলোকে পর্যন্ত জড়িয়ে পত্রিকার প্রথম পাতায় এই সব প্রতিবেদন আসত না। “মাইরের মইধ্যে ভাইটামিন আছে”- এই মনোভাব কি আপনি নীতিমালা তৈরি করে বদলাতে পারবেন?
শুধু আইন-ফাইনে কোনই কাজ হবে না, আনতে হবে সচেতনতা, আনতে হবে মানসিকতায় পরিবর্তন।
আর এই দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই, যার যার ক্ষেত্র থেকে যতটুকুন করা সম্ভব, করতে হবে। যদি তা পারি করতে, তখনই কেবল গড়ে তোলা যাবে একটা সুশৃঙ্খল শিক্ষা-ব্যবস্থা, তখনই কেবল আশা করা যাবে জাতির একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ।
আমি জানি, ছোটবেলায় আমার মত ওরকম বেদম পিটুনির শিকার আপনারাও অনেকেই হয়েছেন| শামিল হন না আমার এই স্বপ্নযাত্রায়? আসুন না, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অন্ততঃ রক্ষা করি এর থেকে? আসুন না, সবাই মিলে এমন একটা শিক্ষা-ব্যবস্থা এদেশে গড়ে তুলি, যেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন রোধে কোনো "নীতিমালা" প্রণয়ন করতে হয় না? কি ভাই, আসবেন??
--মৌনকুহর ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।