মাইরের শেষ লাথি
বছরের শেষ কাতি
পুরু ভাটি অঞ্চল বর্ষায় জলমগ্ন। ছোট ছোট বাড়িগুলি যেন সমুদ্রে ভেসে উঠা দ্বীপ। অনেক সময় কোন কোন বাড়ির আঙ্গিনায় বাচ্চারা জলকেলি করে। নৌকাই একমাত্র বাহন। গৃহস্তের বাড়িতে কাজ-কর্মও তেমন থাকেনা।
গবাদি পশুর পরিচর্যার পাশাপাশি কোষা নৌকায় আমনের ক্ষেতে অতি বারন্ত ধানের পাতা কেটে, খরের পাশাপাশি হালের বলদের জন্য একটু সবুজ ঘাসের ব্যাবস্থা করা। হাটবারে পাট, মরিচ এসব বিক্রি করে সংসারের জন্য তেল নূন কিনে আনা। ভূমিহীন কৃষকরা মালবাহী নৌকায় দাড়, গুন টেনে পেট চালিয়ে নেয়। ছৌয়ল পাড়ায় বাশ-বেতের ঘর-গৃহস্থালির জিনিস যেমন কুলা, ডুলা, চালুন, ডালা ইত্যাদি তৈরীর কাজ হয়। জেলেপাড়ায় মাছ মরার চেয়ে, মাছ মারতে যাওয়ার প্রস্তুতিই বেশী।
ছেড়া জ্বাল ও পালে জোড়াতালি আর গাব দেয়া। কদাচিৎ দুএকজন মাছ মারার চেষ্টা করে। তাও শুধু পেটের দায়ে। তবে বেশীর ভাগ সময় তা চেষ্টাতেই সীমাব্দ থাকে। বৈশাখের শেষে মেঘের গর্জণে পানি ফুলতে থাকে আর মাছগুলি অথৈ জল ছেড়ে নব প্লাবিত মাঠ-ঘাটে ডিম ছাড়তে আসে।
নদীতে এসময় হু মাছ ডিগবাজী খায়। কুমার পাড়ায় মাটির কলসীতে রং-তুলি দিয়ে মেয়েরা আলপনা আঁকছে। পুরুষরা সে সব নৌকায় তুলে ধাণ পাটের বদলে বিক্রি করছে। হজলু গাওল্লা ছৌয়া নৌকা ঘাটে ভেরার আগেই হাক দিচ্ছে। লইবা নিগো পান-সুবারী, বুট-মুড়ালী ! জৈষ্ঠ মাসেই পাট কাটা, পচানো এবং পাট-খড়ি থেকে পাট লওয়া শেষ।
কিন্তু এখনো তার রেস পুড়োপুড়ি কাটেনি। পানিতে পাটের পঁচা গন্ধ। বাতাসে, রোদ্রে শুকোতে দেয়া পাটের আদ্র নিঃস্বাস। ক্ষেতের আইল আর পাটের জমি আমনের সবুজ গালিচায় জল রং-এর নক্সা আঁকে।
ভূমিহীন কৃষি কর্মিরা ক্রিকেট খেলার অল রাউন্ডারের মত।
জীবনের প্রায় সব কাজ তাদের জানতে হয়। ছনের চালা, মাটির দেয়াল তৈরী থেকে শুরুকরে গবাদি পশুর চিকিৎসা পর্যন্ত। তিন ফসলী জমি ভাটি অঞ্চলে নেই বললেই চলে। রবি শষ্যের ফসল তোলার পর আমনের বীজ বোনা হলেই বর্ষার বাকী দিনগুলি তাদের মাঝি মল্লার কাজ করেই কাঁটে। কাল বৈশাখির তান্ডব থেকে মাথা গোজার ঠাঁই টুকু রক্ষা করতে ছনের চালা মাটির দেয়াল মেরামতের কাজ গুলি এ সময় সেরে নেয়।
উজানে তখন বোরো কাটার মৌসম। বেপারী মানে নৌকার মালিক, পাড়ার শক্ত সমর্থ পুরুষদের নিয়ে কুড়ি জনের দল বাধে। তার মধ্যে একজন বাবুর্চিও থাকে। এক মাসের খোরাকী, মিষ্টি আলু আর মরিচ নিয়ে দোগন্ডী বাদাম বাতাসে মেলে দেয়। যেন দিগ্বিজয়ের অভিযাত্রী।
বেপারী মিষ্টি আলু আর মরিচের বিনিময়ে ধান তুলছে নৌকায়। উজানে এসবের আবাদ হয়না। বছরে একটাই ফসল, বোর ধান। তাই ধান কাটার সাথে একটু বারতি আয়। উজানের সহজ সরল মানুষেরা এসব পেয়ে খূশীই হয়।
মহাজন, জমির মালিক সাত ভাগে ধান কাটায়। এক ভাগ বেপারীর ছয় ভাগ মালিকের। আজকাল মহাজনরা খুব দর কষাকষি করে। এমন দিন ছিল যখন আধা আধি ভাগে ধান কাটা হত। এখন লোক বেশী তাই মহাজন ভাগ কমিয়ে দিচ্ছে।
জমি থেকে ধান কাটা শেষ করতে হয় আগে, কারণ এ সময় জল খুব দ্রুত বারে। ধান কাটার কাজটাই পরিশ্রমের। মাড়ানোর কাজটা তত কষ্টের নয়। দূর দূরান্তের জমি থেকে ধান কেটে মাথায় করে মালিকের বাড়ি পর্যন্ত আনতে হয়। এ কাজটাই কঠিন বেশী।
আগে মাড়াইয়ের সময় মহাজনই খোরাক দিত। কিন্তু এখন সে সব আর নেই। তিনবেলা নৌকায় খেতে হয়। তবুও সাত ভাগের এক ভাগ সোনার ধানে নৌকা বোঝাই হয়। প্রসব কৃত সন্তানের মুখ পানে চেয়ে মায়ের আনন্দ-অহংকারে প্রসব বেদনার রেস মাত্র থাকেনা।
সোনালী ধান গুলি এমনি এদের রোদে পোড়া ঘামে ভেজা মুখে তৃপ্তির আমেজ ছড়ায়।
পাল তুলে হাল ধরে ভাটিয়ালী গেতে গেতে সোনার ধানে ভরা তরী একদিন ঘাটে ফেরে। পাড়ায় একটা উৎসব লেগে যায়। মালিক একটা খাশী দেয় রেওয়াজ মত। নৌকা ঘাটে ভেরার দিন আগে থেকেই রান্না-বান্না করা থাকে।
পাড়ার ছেলেমেয়েরা তরী কূলে ভেরার আগেই সাতরে নৌকায় উঠে যায়। খাশীর ঝোলে আতপ চাউলের ভাতের লোভে। বলাই বাহল্য, ছোটরা কেউই নিরাশ হয়না। নৌকার এতদিনের যাত্রীরা গন্তব্যের এসকল বেদাওয়াতী মেজবানদের জন্য প্রস্তুত হয়েই থাকে।
শুরু হয় ধানের ভাগ।
বেপারীর একভাগ, নৌকার একভাগ, খোরাকী অগ্রিম ছিল তার একভাগ, চালানের (মূলধন) একভাগ এভাবে বেশীর ভাগ ধান বেপারীর বাড়িতেই থেকে যায়। মাল্লারা মাথাপিছু আড়াইমন ধান পেল। সে ভাবে কেরামত মাওলা ঘরে আনল পাঁচমন। রতন, আমার বড় ভাই এবার প্রথম উজান গেল। সে এখন আর ছেলে নয়, পুরুষ সুপুরুষ।
বাবা হুকো নিজের হাতেই রতনকে এগীয়ে দেন। এত উৎসবেও শেরালীর শান্তি নেই। আগে শুধু বাবার ফাইল-ফরমাশ খাটলেই চলত। কিন্তু এখন রতনের কথাও শুনতে হয়। কিন্তু পাঁচমন ধান বেশ কদিনের নিশ্চিন্ত খোরাক।
পেটের চিন্তা একেবারেই নেই। তাই শেরালীও খূশী।
বাবা খুব জ্ঞানী মানুষ। বইসা খাইলে রাজার ভান্ডার হুরায়া যায়। তাই ভাগে বালুর নাও ঠিক করে এসেছেন।
কিন্তু এখন শুধু ছয়ভাগ। নাওয়ের ভাগ, মালিকের ভাগ আর চার মাল্লার চার ভাগ। মালিক নাওয়ে কাজ করতে হবেনা। বালি নিয়ে নাও ফিরলে। গজ ফুটের হিসাবে তা শুধু কন্ট্রাকটরের কাছে বিক্রি করবে।
তার পর সে বালি শহরে যাবে, গাড়ী চরে। ইটের পরে ইট বসবে, বালি আর বিলাতী মাটির (সিমেন্ট) ভাজে ভাজে। সাহেব বিবিরা সেসব দালানে কবুতরের খোপের মত বাসা বাঁধবে।
মা আপত্তি করলেন।
পোলাডা হাসরের মাডের থেইকা আইল।
কয়ডা দিন জিরাউক। কামতো হাঙ্গে জীবনই করব।
বাবা নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে, গালে ঘষে হুকোটা রতনের হাতে দিয়ে, মায়ের দিকে ফিরে বললেন:
মাগী আর ছাগী, তুই বুজবি কিলা। তুফানে আম টোকাইতে অয়। আর কয়দিন বাদে আইয়া ফরব আষির্ণ মাস।
ফানি যাইবগা কইম্মা। বালু বোজাই নাই গাট তক যাইতোনা। আদামাইল আইট্টা, তয় বালু টেরাকে তুলতে অইব। এক ক্ষেপ দিতে লাগব একমাস। খোরাকী চাইরডবল।
বাবার কথায় যুক্তি আছে। মা চিন্তিত মুখে রতনের হাত থেকে হুকোটা নিয়ে একটা লম্বা টান দিলেন।
মায়ের ভাবনাটা বুঝতে পেরেই বোধ হয়, বাবা বললেন:
চান্দু মরছে নিজের দোষে। এক ডুবে নাও বরে? ওরা (বাঁশের ঝুরি) কি ফানির লগে বাইসা জাইব? দোম না থাকলে, উঠ্ঠা যাবি। জিরাইয়া হাফাইয়া আবার ডুব দিবি।
এক দিনে নাও না বরলে দুই দিন লাগব। এল্লাগি বাফের কাইল্লা জান খুয়াবি? বেশী খাইতে গিয়া অহন বউজিয়েরে রারি করলি।
মায়ের প্রবল আপত্তিকে বাবার উদাসীন্য আর আমার আগ্রহ পারজিত করল। চান্দু ছাড়া আমরা দুই ভাই এবং বাবা। মায়ের অশ্রুপ্লাবিত আঁখি সাগরের ঢেইয়ের মত পিঠে আছড়ে পরছে।
কিন্তু শেরালী এবার পুরুষ হইছে। মেয়েদের মায়া কান্না শোনার সময় তার এখন আর নেই। পটু হাতে চটপট মাস্তুলে গুন বেঁধে নেমে পড়ল তীরে। আষারের জোয়ারে খালি নৌকা খড়-কুটার মত ভেসে যায়। শক্ত হাতে গুন না ধরলে সালদায় নামতে হাপ্তা লেগে যাবে।
শেরালীর পিছু পিছু ঝরে বেকে যাওয়া তাল গাছের মত চান্দু কাকুও গুন টানছে। অনেক লম্বা চিকন দড়ি নাটাইয়ের মত করে এক হাত লম্বা বাঁশের মাথায় বাঁধা। রশিটা ঘাড়ের উপর দিয়ে পেছনের নৌকার মাস্তলে বাঁধা। আমাদের পেছনে নৌকাটা অবাধ্য ছাগলের মত একান্ত অনিচ্ছায় গন্তব্যের দিকে একটু একটু করে এগুচ্ছে। রতন লগি ঠেলছে যাতে নাও পাড়ে লেগে না যায়।
বাবা হাল ধরে বসে আছেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। জোয়ারের ঠেলা অনেকটা কমেছে। কিন্তু ভাটি এখনো পড়েনি। লোকে বলে আষারে ভাটি নাই কর্তিকে জোয়ার নাই।
জলের যাতায়ত স্থির হয় কেবল। এতটুকুই যথেষ্ট। নাও খুব দ্রুত চলছে। গুনে আছি আমি আর রতন। চান্দু কাকু রান্নায়।
বাবা আরামে গলুইয়ে হেলান দিয়ে এক হাতে হাল ধরে আরেক হাতে হুকো টানছে।
ঢেও উঠল সাগরে রে
কেইমনে পারি ধরিরে
হায় মাঝিরে। ।
ও মাঝিরে
যারা ছিল চতুর নাইয়া
তারাই গেল বাইয়া রে মাঝি
তারাই গেল বাইয়া।
আমি অধম রইলাম বইয়া, হায় হায়
আমি অধম রইলাম বইয়া
আমার ভাঙ্গা তরী লইয়া রে
নদীর কূলে বইয়া।
ঢেও উঠল সাগরে রে
কেইমনে পারি ধরিরে
হায় মাঝি রে। ।
চান্দু কাকুর উদাস সুর বাতাস ভারী করে দিল। সূর্য্য সেই সুরে ক্লান্ত হয়েই কিনা জানিনা, রক্ত ঝড়িয়ে আঁকাশ লাল করে দিল। আমরা গুন ঘুটিয়ে নাও পারা (নোঙ্গর) দিলাম।
তীরের মত নেমে আসছে জলের ধারা। সালদা এখন নদী নয়। মনে হয় হিমালয়ের বরফ গলে ২৯২৮ ফুট উচু থেকে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। একটানা শোঁ শোঁ শব্দ। এই স্রোতে নাও বাধতে হবে আরা আরি ভাবে।
চার কোনায় লগি গেড়ে নাও স্থির রাখতে হয়। অনেক নীচে যেখানে স্রোতের টান এত বেশী নেই সেখানে সব কিছুই একটু সহজ। কিন্তু সে জলে বালি থাকে কম। কষ্ট করে এখানে নাও বাধলে অল্প সময়েই বালিতে নাও বোঝাই হয়। মাত্র ৮/১০ হাত পানি।
একটার জায়গায় দুটো লগি কোপা হল। ওরায় চার দড়ি, শিকার মত অনেকটা। বর্মের মত ওরাটা বুকে ঠেকিয়ে লম্বা দম নিয়ে বালির সন্ধানে জলে ডুবলাম। দুই লগিতে পিঠ ঠেকিয়ে স্রোতের মুখে ওরা ধরলাম। মূহুর্তের মধ্যে ওরা বালি ভর্তি।
দড়িতে টান দিতেই বাবা আর চান্দু কাকু বালি ভর্তি ওরা টেনে তুলল নৌকায়। রতন হেয়তি। বালিতে প্রচুর পানি থাকে। সে পানি নাও থেকে সেচে ফেলতে হয়। তেমন কঠিন কাজ নয়।
রতন সে কাজটা করছে। যে যন্ত্র দিয়ে কাজটা সম্পন্ন হয় তার নাম হেয়ত। যে করে সে হেয়তি। তবে ডুবুরির কাজটাই সবচেয়ে কঠিন এবং ঝুকি পূর্ণ। শেরালী কঠিন কাজেই আগ্রহী।
এক রাজ্যের মানু(ষ) আরেক রাজ্যে গেছেগা। আর তুই আহন তরি ঘুমাছ।
মায়ের ক্ষিচুনীতে স্বপ্নটা আমার বালুচরে বাঁধা ঘরের মতই ভেঙ্গে গেল। ভোর রাতেই বাবা আর রতন বালির নাওয়ে চলে গেছে।
ক্রমশ....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।