আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যে ধর্ম একধরনের পরমতসহিষ্ণুতা অনুসরণ করে এসেছে, সেই ধর্ম কিছু মৌলবাদীর দ্বারা ছিনতাই হতে দেখে আমি লজ্জিত। (একটি চমৎকার আর্টিকেল, সবারই পড়া উচিৎ)

পাওয়ার অব পিপল স্ট্রংগার দেন দি পিপল ইন পাওয়ার। http://mhcairo.blogspot.com/ আমার দেশের এক গর্বিত ও বিশিষ্ট সন্তান মকবুল ফিদা হুসেন দেশের মাটিতে মরারও সুযোগ পেলেন না। এতে একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমি লজ্জা বোধ করছি। তিনি ভারতের মাটিতে মৃত্যুকে বরণ করতে চেয়েছিলেন। আর আমি দ্বিগুণ লজ্জিত হিন্দু হিসেবে।

যে ধর্ম একধরনের পরমতসহিষ্ণুতা অনুসরণ করে এসেছে, সেই ধর্ম কিছু মৌলবাদীর দ্বারা ছিনতাই হতে দেখে আমি লজ্জিত। এই মৌলবাদীরাই ফিদা হুসেনের চিত্রকর্মকে ধর্মদ্রোহী বলে রায় দিয়েছে। তারা মনে করে, দেব-দেবীকে এমনভাবে চিত্রিত করতে হবে, যা তাদের বিবেচনায় পবিত্র চিত্রায়ণ। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা কে দেয়—কালী পণ্ডিতেরা কিংবা কেরালার নাম্বুদরিপাড়রা না, কিংবা সুশিক্ষিত কাণ্ডজ্ঞানীরাও না; বরং এ সিদ্ধান্ত দেয় একদল সন্ত্রাসী, যারা বজরং দলের ছত্রচ্ছায়ায় সক্রিয়। এরা ধর্মান্ধ; শিল্পী ও লেখকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী।

তাদের লালসা রাজনৈতিক। নিজেদের তারা ধর্মরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে জাহির করে। ফিদা হুসেনের মৃত্যুতে বজরং দল, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) শোক প্রকাশ করে একটা কথাও বলেনি। এতে আমি একদম আশ্চর্য হইনি। ফিদার মৃত্যু জাতীয় ক্ষতি।

কিন্তু এদের জাতির ধারণা ভিন্ন রকমের। বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা, তা সে এল কে আদভানি, সুষমা স্বরাজ কিংবা গডকড়ী, যে-ই হোক না কেন, কোনো দিন ফিদা হুসেনকে পছন্দ করত না। তাদের অপছন্দের কারণ শুধু ফিদার ধর্মীয় পরিচয় মুসলমান হওয়াই নয়, বরং কারণ হলো, তিনি ভিন্নভাবে ভাবতেন। তাদের হিন্দুত্বের ছাঁচে শিল্পীর অথবা লেখকের স্বাধীনতা নামক কোনো বস্তু নেই। ফিদা হুসেনের দাফন ভারতের মাটিতে করার জন্য তাঁর কফিন নিয়ে আসার মাধ্যমে কিছুটা মর্মপীড়া প্রদর্শন করা উচিত ছিল বিজেপি নেতৃত্ব ও তাদের স্বগোত্রীয়দের।

জীবনকালে তাঁকে যা থেকে এরা বঞ্চিত করেছে, অবশেষে তাঁর মৃত্যুর পর সেটার কিছুটা কমানো উচিত ছিল। শেষকৃত্যগুলো পালিত হয়েছে লন্ডনে। সমাহিতও করা হলো ইংল্যান্ডের মাটিতে। ভারতীয় জনগণের উচিত ছিল ভারতের গর্ব ফিদা হুসেনের কফিন ভারতে নিয়ে এসে দিল্লির জামে মসজিদের পাশে কবর দেওয়ার দাবি তোলা। সেখানে সমাহিত আছেন ভারতের এক বড় নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ, যার কবরের স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু ।

সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফিদা হুসেনকে সরকার থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এ কথা বলেই নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ থেকে সরকার খালাস পাবে না। রাজনৈতিক দ্বিধা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারে অতিরিক্ত শঙ্কার পাকে নিমজ্জিত থেকেছে সরকার। একবারও ধেড়ে ইঁদুরদের চ্যালেঞ্জ করেনি, বরং নগণ্য প্রতিরোধের পথে গেছে। এমনকি জাতীয় প্রদর্শনী থেকে তাঁর চিত্রকর্ম সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ওদের কাছে নতি স্বীকার করেছে।

এর ফলে ফিদা হুসেনের উচ্চতা বেড়েছে, আর কমেছে সরকারের। শিল্পীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উঠলে জাতিকে দৃঢ় অবস্থান নিতে হয়। আমরা গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের দাবিদার, অথচ আমাদের এই দাবি কত মিথ্যা—কেননা নিরাপদ ফেরার জন্য ফিদা হুসেন বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও আমরা তাঁকে দেশে নিয়ে আসতে পারলাম না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটারের অজ্ঞতা সবার নিরাপত্তাহানি করে। ফিদা হুসেনের নিরাপত্তায় দায় ছিল সবার।

আমরা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও, যারা ভারতকে মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ধারক এক রাষ্ট্র মনে করে। সমাজ পরিচিত হয় তার সংস্কৃতির দ্বারা। কিন্তু কী সেই সংস্কৃতি, যেখানে ফিদা হুসেনের মতো শিল্পী, যিনি ছবি আঁকতেন নিজের অনুভূতি দিয়ে, তাঁরও জায়গা হয় না। ফিদা হুসেনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখার সময় তাঁর সাইকেলের ক্যারিয়ারে ছিল কয়েকটি ক্যানভাস।

তিনি সাইকেলে না চড়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এতগুলো চিত্রকর্ম বহন করে সাইকেলের ভারসাম্য রক্ষা করা যেত না। তিনি চেয়েছিলেন, আমি যেন অন্তত একটা চিত্রকর্ম কিনি। কিন্তু আমার তো ছবি কেনার সামর্থ্য ছিল না। মনে পড়ছে, একটা ছবির দাম ছিল কয়েক হাজার রুপি।

শিল্পকলা সম্পর্কে তখন জানতামও না কিছুই। অল্প কয়েকজন শিল্পীর কাজ বাদে (যাঁর মধ্যে ফিদা পড়েন) আজও জানি না। ফিদা হুসেন এমন একজন শিল্পী, যিনি আমার বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন; আলো, মুক্তি ও স্বচ্ছতার অনুভব পেতে সূর্যের নিচে এসে দাঁড়াতে বলেন। মাঝেমধ্যে আমাদের দেখা হতে লাগল। সম্পর্কটা টিকে থাকল।

ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে আমি দায়িত্ব পালনকালে ফিদা এসেছিলেন হাইকমিশন দপ্তরে আমার সঙ্গে দেখা করতে। মওলানা আজাদের একটা প্রতিকৃতি আঁকতে তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম। মিশনের দেয়ালে সব জাতীয় নেতার জায়গা হয়েছিল, শুধু মওলানা আজাদ ছাড়া। তারপর আর দেখা হয়নি দীর্ঘ ২০ বছর। তবে সরকারের গতিহীনতা ও জাতির অবহেলা নিয়ে আমার লেখায় প্রচণ্ড রাগ ঝেড়েছিলাম।

জাতি হিসেবে তখন আমরা যে ভুল করেছিলাম, ফিদা হুসেন মারা যাওয়ার পর আমরা কি আর পারব সেই ভুল শোধরাতে! তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আশ্চর্য, প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ জানিয়ে সুশীল সমাজের কেউ একবারও বলেননি, ‘হুসেন আমাদেরই লোক, আমাদের দেশে তাঁর সর্বোচ্চ মর্যাদা পাওয়ার কথা। ’ যে সরকার এখন কুমিরের অশ্রু বিসর্জন করছে, সে তো শুধু তাঁকে পদ্মশ্রী খেতাব দিয়েছে। তাঁকে ভারতরত্ন পুরস্কার দেওয়ার সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি। ইংরেজি থেকে অনূদিত কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.