আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেয়ালের এই লেখাগুলো

শুচি সৈয়দ শুচি সৈয়দ আমাদের দীনতা, হীনতা আর ধিন্তার একটা দৃষ্টান্ত হয়ে গেল মুসা। হ্যাঁ, এভারেস্ট শীর্ষজয়ী মুসা এক সঙ্গে উপর্যুক্ত শব্দাবলীতে প্রমাণ তুলে ধরেছেন আমাদের জাতীয় চরিত্রের। মুসা এভারেস্ট শীর্ষে উঠেছেন এ খবর নিয়ে যখন নেটে বাংলা বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখি শুরু হয়েছে তখন অনেক ব্লগারই বিষয়টিকে নিছক উড়ো খবরের গুলতাপ্পি বিবেচনা করে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাদের এ সংশয় কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, আমাদের জাতীয় চরিত্রের সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ সংশয়। আমাদের নিজেদের ওপর নিজেদের আস্থাহীনতার খুব স্বাভাবিকতার(!)-ই প্রকাশ সেটি।

কিন্তু সত্যি সত্যি যখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে, মুসা ইব্রাহিম এভারেস্ট শীর্ষে আরোহণ করেছেন। সেই চূড়া থেকে নেমেও এসেছেন তখন বাঙালি চরিত্রের আরেক দফা স্বরূপ উšে§াচন ঘটল। খবর ছাপা হল এটি এখন খুব সহজ কাজ! শেরপারা সকালে এভারেস্টে ওঠে, দুপুরে সেখানে বিশুদ্ধ হাওয়া সেবন করে আর বিকালে সে হাওয়া ফুসফুসে জমিয়ে সন্ধ্যায় পাদদেশে নেমে আসে!! যেন এমনই সহজ এভারেস্টে ওঠা আর নামা। এ হচ্ছে হীনতার উদাহরণ। তারপর? তারপর ধিন্তা! মুসার সংবর্ধনা, মুসা বন্দনা শুরু হয়েছে, চলবে, যতদিন চালানো যায়, চালানো সম্ভব হবে।

এর পাশাপাশি আরও একটি জিনিস চোখে পড়ল তা হচ্ছে উদাসীনতা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক পত্রিকা দেশ । যার মূল বাজার বাংলাদেশ। শুনি, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে দেশের কপি বেশি বিক্রি হয় নাকি বাংলাদেশে সেই দেশ-এ দু’জন পশ্চিমবঙ্গীয় তরুণের ছবি ছাপা হয়েছে, সঙ্গে এক বিদেশী কিশোরের ছবিও। তারাও এভারেস্ট শীর্ষারোহণ করেছে।

দেশ-এ প্রকাশিত ওই খবরে বাংলাদেশের মুসার ছবি তো দূরের কথা নামও ছাপা হয়নি। একই কথা বলতে পারি ১৩ বছর বয়সী মার্কিন কিশোরের এভারেস্ট শীর্ষ আরোহণের খবর আমাদের পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি তরুণদের নাম বা খবর আমাদের পত্রপত্রিকায় স্থান পায়নি। এসব কারণেই কি বাঙালিকে নীরদ সি. চৌধুরী ‘আÍঘাতী বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন? নিমতলীতে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল সে ঘটনা থেকেও এরকম আÍঘাতী বাঙালির হাতে-কলমে উদাহরণ পাচ্ছিলাম। অগ্নিকাণ্ডের সূচনার সময় থেকেই প্রায় সব ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা ঘটনাটি কাভার করছিলেন। ঘটনার ভয়াবহতা যতই সময় গড়াচ্ছিল ততই উপলব্ধ হচ্ছিল কিন্তু কিছু সংবাদকর্মীকে দেখলাম টকশো প্রবণতায় আক্রান্ত হয়ে যেতে, তারা দমকল বাহিনীর কর্মীদের দেরিতে উপস্থিত হওয়ার জন্য তাদের বারংবার দোষারোপ করতে শুরু করলেনÑ এমন ভুল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা করেছিলেন পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের প্রথম দু’দিন।

সেই ভুল থেকে তারা কোনও শিক্ষা নেননি। ভরসা (!) করি তারা ভবিষ্যতে এ জাতীয় ভুল অব্যাহতভাবেই করে যাবেন। একই ভুল অগ্নিকাণ্ডের এ ভয়াবহ ঘটনাটিকে নিয়ে আরও ঘটছে। ঢাকা শহর যে ভবিষ্যৎ ভয়াবহতার নরককুণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে নিমতলীর এ ঘটনা তার সূচনা মাত্র। এ বিষয়টি যেন আমরা ভুলে না যাই।

কবি শামসুর রাহমান একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক গানপাউডার দিয়ে এদেশের মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার পৈশাচিকতাকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে তার সুবিখ্যাত কবিতায় লিখেছিলেন, ‘তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা আর কতবার ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায়, আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন। ’ আজ এ স্বাধীন দেশে আমরা অসহায় শিকার হচ্ছি খাণ্ডবদাহনের তবে বিদেশী বর্বরদের হাতে নয়, স্বদেশী মুনাফালোভী মানুষের দায়িত্বহীনতায়। নিমতলী ট্র্যাজেডির শিকার তিন কন্যার জননী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন স্বতঃস্ফূর্ততায় দ্রুত এগিয়ে এসেছেন এ উদ্যোগকে যদি প্রতীকী অর্থেও ধরি তবে বলতেই হবে তারও চেয়ে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে। কেবল মাত্র দুই একটি রাসায়নিকের গুদাম সীল করলেই হবে না, সব রাসায়নিক পদার্থের গুদাম পুরান ঢাকা এবং ঢাকা শহরের অন্য সব আবাসিক এলাকা থেকেও নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে যেমন সরকারিভাবে তেমনই এসব ব্যবসায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মানুষদেরও।

ব্যবসায়ী সমাজকে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গঠনে উদ্যোগী হতে হবে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থ প্রদান করে দায়িত্ব এড়ালে চলবে না। কবি হুমায়ুন আজাদ তার প্রবচনগুচ্ছের একটি প্রবচনে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতাকে তুলে ধরার জন্য লিখেছিলেন এরকম একটি বাক্য- ‘এদেশে উন্নতির অর্থ হচ্ছে উপরের দিকে পতন’। লিখেছিলেন ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’ এবং ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’-এরকম শিরোনামে দুটি বইÑ আমাদের তিলোত্তমা মহানগরীর স্ক্যাইক্যাপারগুলোয় ফাটল দেখা দিচ্ছে, উপড়ে পড়ছে সাত-আটতলা ভবন। কবি হুমায়ুন আজাদ স্থূল এবং বস্তুগত অর্থে এ প্রবচন কিংবা গ্রন্থ রচনা করেননি কিন্তু স্থূলও বস্তুগত অর্থেও সত্যি হয়ে উঠছে তাঁর আশংকা, তাঁর কথাগুলো।

আমাদের অনেক উন্নতি হচ্ছে। স্বাধীনতার ঊনচল্লিশ বছরে ঢাকা কেন্দ্রিক, ঢাকামুখীÑ যেন রাষ্ট্রের সমস্ত মধু ঢাকায় সঞ্চিত! ঢাকার জনসংখ্যা সোয়া কোটি থেকে সবার অজ্ঞাতসারেই একদিন ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে সন্দেহ নেইÑ এমন ধারার উন্নতির শেষ পরিণতি তো পতনই! মফস্বল থেকে আসা এক কিশোরের বোকাসোকা প্রশ্ন নিয়ে একটি জোক্স আমরা প্রায় বলি। সেই কিশোর দেশ থেকে এসে সদরঘাটে নেমে লঞ্চ থেকে পিলপিল করে অসংখ্য মানুষকে নামতে দেখে অবাক বিস্ময়ে সঙ্গীকে প্রশ্ন করেছিল, ‘এত্তো মানুষ? হুইবে কনে?’ সঙ্গী তার প্রশ্নের কোনও জবাব দেয় না দেখে সে আরও প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা, হুইলো নাহয়, বালিশ পাইবে কনে?’ গ্রামের কিশোর তার চেনা জীবনের অভিজ্ঞতায় যে প্রশ্ন করে সেই প্রশ্ন শুনে আমরা হাসি, তাকে বোকা ঠাঁওরাই। কিন্তু তার এ প্রশ্নের ভেতর যে আরও অসংখ্য প্রশ্ন লুকিয়ে আছে সে কথা কি আমরা কখনও ঘুণাক্ষরেও উপলব্ধি করি, ভাবি? কর্মসূত্রে আমি দেশের একটি প্রধান জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে জড়িত। মাস দুয়েক আগে আমার মেইলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এক দরদী পাঠক কিছু ছবি পাঠিয়েছিলেন।

ছবিগুলো আমি আমার পাতায় ছাপাবো কি ছাপবো না এ নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগলাম প্রায় ১৫/২০ দিন। আমার একবার মনে হয় ছবিগুলো ছাপা যায়। আরেকবার মনে হয় প্রবাসে আমাদের তরুণ শ্রমজীবী ভাইগুলোর এ ছবি ছেপে তাদের কষ্ট দেয়া ঠিক হবে না! কিন্তু দীর্ঘ অন্তর্দ্বন্দ্ব শেষে ছবিগুলো আমি এক সপ্তাহে ছেপে দিলাম ছোট করে। আমার মনে হল বড় করে ছাপলে অনেকেই কষ্ট পাবে। আর সে ছবিগুলো না ছাপলেও তাদের যে অবর্ণনীয় দুর্দশা- সেটার কারণ যে-আদম ব্যাপারীরা তাদের চৈতন্যোদয় ঘটবে না।

কিংবা তরুণদের যে প্রবাস মোহ- সেটাও কাটবে না। যেনতেন প্রকারে বিদেশ যাওয়া বন্ধ হবে নাÑ। তো কি ছিল সেই ছবি ক’টিতে? হ্যাঁ, সেই ছবি ক’টিতে ছিল উপরোল্লিখিত গ্রামের কিশোরের প্রশ্নের উত্তরের এক ফোঁটা আভাস। দুবাইতে কর্মরত আমাদের বাঙালি তরুণ শ্রমজীবীদের ঘুমানোর দৃশ্য ছিল সেই ছবি চারটিতে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভবন ‘দুবাই বুর্জ’ নির্মাণ কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিল তাদের অনেকে।

তারা ঘুমোচ্ছে বাথরুমের মেঝেতে, সিঁড়ির প্যাসেজে, স্টোর রুমে। তারা ঘুমোচ্ছে একজনের পেটে আরেকজনের মাথা, কারও পায়ের ওপর কেউ- এভাবে, যেন নিঃসাড় লাশের মিছিল! একবাক্যে এ ঘুমের দৃশ্যকে বলা যায়- মানবেতর জীবন! ‘মানবেতর’ শব্দটি লিখলে যেন বোধগম্য হয় না পরিস্থিতি-- লেখা উচিত ‘মানব+ইতর!’। আমি জানি আমাদের এ ঢাকা শহরে গ্রাম থেকে আসা অসংখ্য মানুষকেও এরকম জীবনযাপন করতে হয়, যতই আমরা পরিহাস মনে করি না কেন সরল কিশোরের প্রশ্নটিকে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য অনেক দিন আগে লিখেছিলেনÑ ‘দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা/আমি যে বেকার পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা। ’ মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমাদের এসব লেখালেখি হয়তো মনের খেয়ালে বেকারের স্বাধীনতাই কোনও কাজে আসে না মানুষের, সমাজের।

আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তোবা কিছু কাজে আসে। লেখার যে শক্তি আছে আমি সেটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করিÑ এটা আমার ব্যক্তি অভিজ্ঞতার অর্জন বলতে পারেন। অনেক দিন আগে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার পশ্চিমবঙ্গের গল্পকার স্বপ্নময় চক্রবর্তীর জীবনের একটি গল্প বলেছিলেন, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর মা শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের হাতে নানা প্রকার নিগ্রহের শিকার ছিলেন। মায়ের গোপন অশ্র“মোচনের সাক্ষী ছিলেন স্বপ্নময়। স্বপ্নময় দিনের পর দিন মায়ের সেই কান্না দেখতে দেখতে একদিন অতিষ্ঠ হয়ে দেয়ালে তার স্কুল পড়–য়া বয়সের কাঁচা হাতের অক্ষরে লিখে রাখলেন একটি ক্ষীণ প্রতিবাদ ‘মাকে কেউ কষ্ট দিও না।

’ দেয়ালে উৎকীর্ণ ছোট্ট শিশুর এই বাক্যটি লজ্জা দিল গঞ্জনাকারীদের। পাল্টে গেল তারা। নিগ্রহের হাত থেকে রক্ষা পেলেন অসহায় জননীÑ ছোট শিশুটির ছোট প্রতিবাদে। এমনটাই তো ঘটতে পারত সাংবাদিক শফিকুল কবিরের সংসারে। শিশুদের দেয়াল লিখন শুধরে দিতে পারত তাদের গোটা পরিবারটিকে কিন্তু তা ঘটেনি।

ঘটেনি বলেই সক্রেটিসের মতো বিষপান করে মায়ের সঙ্গে পৃথিবীকে সালাম জানিয়ে চলে গেল নিষ্পাপ শিশু দু’টি। ওদের মৃত্যু আমাদের বেঁচে থাকাকে ভর্ৎসনা জানাচ্ছে। নিষ্ঠুর এবং বর্বর হয়ে উঠছি আমরা ব্যক্তি পর্যায়েও। পাঠক, ওই শিশুরা কিন্তু মনের খেয়ালে লেখেনি আÍহত্যার স্বীকারোক্তি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হতে হতে শেষ পর্যন্ত তারা মূর্ত হয়েছে প্রতিবাদে।

তারা সমাধান খুঁজেছে আÍহননে। আমরাও কি সেরকম সমাধান খুঁজছি, সমবেতভাবে স্বরচিত মৃত্যুকূপ রূপে এই তিলোত্তমা নগরীকে নির্মাণ করে? নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড, মহাখালীর ভবন ধস এসব মনের খেয়ালের দেয়াল লিখন নয়। দেয়ালের এই লেখাগুলো পড়ার কি কেউ নেই? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।