আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেয়ালের ওপারের প্রেম

সত্যিকারের প্রেমের অনুপম নিদর্শন পাইরামাস-থিসবি'র প্রেম। গ্রিক পুরাণের প্রেম কাহিনীগুলোর মধ্যে এটি সময়কে জয় করেছে দারুণভাবে। এই যুগলের প্রেমাখ্যানের করুণ পরিণতি পাঠককে অশ্রুসজল করে তোলে। বহু প্রাচীনকাল থেকেই পাইরামাস-থিসবির প্রেম লোকমুখে প্রচলিত হয়েছে। এই যুগলের অনবদ্য প্রেম কাহিনী বিখ্যাত নাট্যকার ও সাহিত্যিক উইলিয়াম শেকসপিয়রকে অনুপ্রাণিত করেছিল নতুনভাবে সাহিত্যে উপস্থাপনার জন্য।

পশ্চিম এশিয়ার বেশ বড় অঞ্চলজুড়ে লোকমুখে এই কাহিনী যুগ যুগ ধরে গল্পাকারে বলা হতো। গ্রিক পুরাণের এই দুই চরিত্র প্রেমকে নতুন আঙ্গিকে রূপায়ণ করেছিল তাদের প্রেম দিয়ে। তাদের এই প্রেম কাহিনী রোমান কবি ওভিদ তুলে ধরেছিলেন অনন্য লেখনি দিয়ে। এই বিখ্যাত কবি তার ১৫ খণ্ডে মেটাফরমোসিজে স্থান দিয়েছিলেন গ্রিক পুরাণের বহু প্রেম কাহিনী।

সেখানেও পাইরামাস ও থিসবির প্রেমের গল্প গ্রন্থিত হয়েছে নিপুণ দক্ষতায়।

এ যুগলের প্রেম কাহিনীর ভূমি ছিল প্রাচীন ব্যাবিলন শহরে। সেই শহরে রানী ছিলেন সামিরামিস। তার সময়েই পাইরামাস-থিসবি চরিত্রের উপস্থাপন। পাইরামাস ছিল প্রাচ্যের সবচেয়ে সুদর্শন তরুণ। অন্যদিকে রূপে-গুণে থিসবি ছিল পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় নারী।

তারা থাকত পাশাপাশি দুটো বাড়িতে। ছোটবেলা থেকেই একে অপরকে জেনে এসেছে। সাধারণ যা হয়। সবার অলক্ষ্যেই প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে এই যুগল। মন দেওয়া-নেওয়া শুরু হয় কৈশোরেই।

তাদের ভালোবাসার গাঁথুনি পরিপক্ব হয় অল্প সময়ের ব্যবধানেই। কিন্তু অপরিণত নয় পাইরামাস-থিসবি। পারিবারিক সম্মতিতেই বিয়ে করে সারাটা জীবন একে অন্যের পাশে কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু সুখের স্বপ্নে কাঁটা হয়ে দেখা দিল তাদের বাবা-মা। কোনোভাবেই পাইরামাস-থিসবি তাদের বোঝাতে পারল না।

ধীরে ধীরে প্রেম বিয়েতে এই অমত দুজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরির জন্য কাল হয়ে দেখা দিল। সুন্দর, সুখে কাটানো দিনগুলো বিষাদে ছেয়ে গেল। তাই বলে কি আর মন আটকে রাখা যায়। প্রেমের সৌন্দর্য যে দুটি নর-নারীর মনের গভীরেই গাঁথা থাকে। সেটা বোধহয় ভুলে গিয়েছিল তাদের অভিভাবকরা।

কিন্তু বাস্তবতা আরও কঠিন হতে লাগল। পাইরামাস ও থিসবির মা-বাবা দুটি বাড়ির মাঝখানে সীমানা প্রাচীর তুলে দিল। এখন একটি প্রেমের মাঝখানে শুধু একটি দেয়ালের বাধা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু প্রেমকে তো নিষিদ্ধ করে বা দেয়াল তুলে দিয়ে আটকে রাখা যায় না। এই যুগলের বিষাদকালে মন ঠিকই পড়ে থাকত মনের মানুষের কাছে।

সবকিছু যখন অসহ্য হয়ে যেতে লাগল থিসবির কোমল মন তখন কাঁদে অসহায়ভাবে। ভালোবাসার আগুনে জ্বলছে দেয়ালের ওপারে পাইরামাসও। থিসবি প্রায়ই সেই দেয়ালের এপার থেকে কথা বলে যায় আপন মনে। কখনো মনের কথাগুলো শোনায় মূক দেয়ালকেই। কিন্তু দেয়াল যে উত্তর দেয় না।

বিষণ্নতায় থিসবি এক দিন দেয়ালের কাছেই অনুযোগ করে, মনের মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে থাকার এই কষ্ট, এই অসহ্য বিচ্ছেদের কিছুই কি মূক দেয়াল বোঝে না? অবশ্য মেঘে ঢাকা সূর্য এক দিন ঠিকই দেখা দেয়। দুজনের বাড়ির মাঝে ছিল ছোট্ট একটি ফোকর। সেখান দিয়ে সূর্যের আলো এসে থিসবিকে জানান দিয়ে যায় ভালোবাসার কথা মনের মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে। প্রেমিক-প্রেমিকার চোখ এড়ায়নি সেটি। পাইরামাস আর থিসবি সেই ফোকর দিয়েই ফিস্ ফিস্ করে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে।

এতদিন এই দেয়ালই ছিল মনের মানুষের কাছ থেকে আড়াল করে রাখার বাধা, আজ সেটি বদলে গেল পুরোপুরি। এখন এই দেয়ালের ফোকর দিয়ে মনের কথা উড়ে যায় প্রেয়সীর কাছে। পাইরামাস থিসবিকে শোনায় তাকে সারা জীবন পাশে রাখার আকাঙ্ক্ষার কথা। থিসবি শোনায়, বিচ্ছেদের এই অসহ্য বেদনার কথা। গোপনে দেয়ালের ওপার থেকেই ভালোবাসা বিনিময় হতে থাকে।

সারাদিন একে অন্যের সঙ্গে দেয়ালের দুই পাশ থেকে গল্প করত। বলত ভালোবাসার অগণিত কথা। বিচিত্র সব অনুযোগ তুলত থিসবি। মান ভাঙাত পাইরামাস। সারাটি দিন এভাবে তারা কথা বলত।

দুজন ফিরত সন্ধ্যা নামলেই। সূর্যাস্তের আভা এসে হাজির হলে তারা দেয়ালের দুই ধারে চুম্বন করে দুই দিকে বিদায় নিত। এভাবে প্রেমবিনিময় হতে থাকল। কিন্তু দেয়ালের এই বাধা আর সহ্য হচ্ছিল না কারোরই। থিসবি একদিকে অসহ্য বেদনার ভাষায় কাতর করে তুলত পাইরামাসকে।

অন্যদিকে প্রাণভরে ভালোবাসার নিদারুণ আকাঙ্ক্ষায় পাইরামাসকে আকুল করে তুলত থিসবিকে। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি যে কোনোকিছুই বদলাচ্ছে না, নিজেদের দুর্ভাগ্য নিয়ে হতাশায় ডুবে যেত প্রতিটি দিন। পাইরামাস লুকিয়ে থিসবির জন্য একটি ওড়না কিনেছিল।

সেই ওড়না দেয়ালের ওধারে ছুড়ে ফেলল সে। ওড়না পেয়ে খুব খুশি হল থিসবি।

কিন্তু আনন্দও বিষাদে রূপ নিল। আকুল হয়ে পাইরামাসকে বলল এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি চাই তার। পাইরামাসও যেন সেটাই ভাবছিল। অবশেষে সেদিন তারা ঠিক করল সেই রাতেই তারা নগরী থেকে পালিয়ে গোপনে পালিয়ে যাবে। এই বন্দীদশার ভালোবাসাকে স্বাধীনতার স্বাদ দেবে।

তারা ঠিক করল নাইনসের সমাধি মন্দিরের পাশে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করবে। এই জায়গাটির বিশেষত্ব ছিল লম্বা একটি মালবেরি গাছ। এই গাছে বরফের মতো শুভ্র ফল হতো। এর কাছেই ছিল একটি শীতল জলের ঝর্ণা। সব যখন ঠিক তখন শুধু অপেক্ষার পালা কখন সন্ধ্যা নামতে।

সে দিনটি যেন দীর্ঘায়িত হতে লাগল। অবশেষে সূর্য অস্ত গেল। পরিকল্পনা মতোই থিসবি ঘর থেকে বেরিয়ে সমাধিস্থলে গিয়ে আগে পেঁৗছাল। তার পরনে পোশাকের ওপর জড়িয়ে নিল প্রিয়তমার দেওয়া সেই ওড়নাটি। সেখানে পৌছে থিসবির অভিমান হলো।

এখনো যে পাইরামাস আসেনি। সে অপেক্ষা করতে থাকল। এদিকে চারদিকে সুনসান নিরবতা। মৃদু আওয়াজও কানে বাজে থিসবির। হঠাৎ চাঁদের আলোতে সে দেখতে পেল একটি সিংহ।

আলো-আধারিতে সিংহটিকে দেখে আতঙ্কে হিম হয়ে গেল সে। সিংহটির চোয়াল রক্তমাখা। পাশেই স্বচ্ছ জলের ঝর্ণা। পানি পান করতে এদিকেই আসতে লাগল সিংহটি। থিসবি দ্রুত সিংহর হাত থেকে বাঁচতে দৌড় লাগালো বনের দিকে।

সমাধিসৌধের পিছনে নিবিড় সিডার বন। সে নিবিড় সিডার বনে দেবী ইশতারের গুহা। সে গুহায় আশ্রয় নিতে পিছন ফিরে প্রাণপন ছুটল থিসবি। কিন্তু অসচেতনভাবেই জঙ্গলের ঝাড়গুলোতে জড়িয়ে গেল তার লম্বা ওড়নাটি। সে দিকে খেয়াল নেই তার।

সিংহটি থিসবিকে তাড়া করল না। ঝর্ণা থেকে পানি পান করে বনের দিকেই পা বাড়াল সিংহটি। ফেরার পথে ওড়নাটি দেখে মুখে তুলে নিল। রক্তমাখা মুখে ওড়নাটি জড়িয়ে যাওয়ায় সিংহটি টানাহেচঁড়া করতে লাগল। ওড়নাটি ছিড়ে টুকরো টুকরো করে বনের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল সিংহটি।

যাওয়ার পথে গর্জন করতে লাগল সিংহটি। পাইরামাস তখন সমাধিসৌধের কাছেই এসে পৌছেছে। সিংহের গর্জন শুনে আতঙ্কিত হলো সে। থিসবির কিছু হলো কিনা সেই দুশ্চিন্তায় দ্রুত দৌড় লাগালো সে।

কিছুক্ষণ পরই পিরামস এসে দেখে থিসবির রক্তমাখা, টুকরো টুকরো ওড়নাটি পড়ে রয়েছে কাছেই।

মাটিতে সিংহের পায়ের ছাপ দেখে আর বুঝতে বাকি রইল না অজানা আশংকাই সত্যি হয়েছে। আশেপাশে থিসবিকে না পেয়ে সে ভাবল থিসবিকে সিংহ খেয়ে ফেলেছে। এই বিপজ্জনক স্থানে থিসবিকে আসতে বলেছিল সে আর তার এই মৃত্যুর জন্য সে নিজে ছাড়া আর কেউ দায়ি নয়।

'আমিই তোমাকে খুন করেছি'- এমন বিলাপ করতে করতে থিসবির রক্তাক্ত ওড়নাটি মাটি থেকে তুলে নিজের তরবারি বের করে নিজের বুকেই বসিয়ে দিল। এমন সময় সিংহ পালিয়ে গেছে বুঝতে পেরে থিসবিও ফিরে এলো।

কিন্তু তখন যে খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে। অন্ধকারের মধ্যেও সে দেখল, মুমূর্ষু, সারা শরীর রক্তে মাখামাখি পাইরামাস। থিসবি আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো পাইরামাসকে। বারবার কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, দেখো, আমি এসেছি। আমি থিসবি, তোমার প্রিয়তমা।

কিন্তু নির্জনতায় মৃত্যুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করল পাইরামাস। নিথর পাইরামাসের দেহ কোলে নিয়ে থিসবি ভাবল পাইরামাস ছাড়া তার এ জীবন অর্থহীন। হঠাৎই পাইরামাসের বুক থেকে রক্তাক্ত তরবারি নিয়ে খুলে নিয়ে নিজের বুকে বসিয়ে দিল থিসবি। তার রক্ত ছিটকে লাগল মালবেরি গাছে। এই যুগলের করুণ পরিণতি দেখল দেবতারাও।

সেই অনবদ্য প্রেমের নিদর্শন হিসেবে দেবতারা মালবেরির সাদা ফলের বর্ণকে করে দিল লাল টকটকে ।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।