যা লিখি, হয়ত কিছুই লিখি না। যা লিখব হয়ত অনেককিছুই লিখব। আসল কথা হলো, গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুণ
রিকশা থেকে নেমে ক্লাসে চলে আসি। আজ সবুজ স্যারের ক্লাস নেবার কথা। সৌম্যদর্শন এক ভদ্রলোক।
বয়স দেখে বোঝার উপায় নেই। মনে হয় সবেমাত্র চল্লিশ হয়েছে।
আজ দেরী হয়ে গেছে। ঝুঁকি নিয়ে ঢুকে পড়লাম। স্যার অসম্ভব ভালো ক্লাস নেন।
এই ক্লাস তাই মিস করার কোন মানে নেই। স্যার পড়ানোর বাইরেও এত সুন্দর করে কথা, বলেন মন জুড়িয়ে যায়। দূরে কোথায় ভ্রমণে গেলে রাস্তার দু’পাশের সবুজ যেমন মন ভরিয়ে দেয়, স্যারের আশেপাশে থাকলেও অজানা কোন সূত্রে পবিত্রতা এসে ছুঁয়ে যায় মনকে। এমন হতে পারে না,স্যার আমার বাবা?গিয়ে জিজ্ঞেস করব? স্যার,আপনার প্রথম স্ত্রীর নাম কি রাহেলা মমতাজ?
কথাটা মনে হতেই বেশ শব্দ করে হেসে ফেললাম। হুশ ফিরলে দেখলাম,সমস্ত ক্লাস আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
বুঝতে পারছি ভুল করে ফেলেছি। তবে ভয় পেলাম না। স্যার ভাল মানুষ,অকারণে কাউকে শাস্তি দেন না। আমাকে তাহলে কেন দেবেন?তবে,আমার বিশ্বাসে ধাক্কা লাগল যখন দেখলাম,স্যার আমাকে তার রুম এ ডেকে পাঠিয়েছেন।
আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
স্যার ইশারা করে বসতে বলার পরও সাহস পেলাম না। রুমে এসি চলছে,তারপরও ঘামছি,কপাল বেয়ে ঘাম একটু একটু করে নেমে আসছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাবার চেষ্টা করলাম,ভারি পর্দায় দৃষ্টি আটকে গেল।
স্যার বললেন,ঘামছ কেন? আমি কী বাঘ না ভাল্লুক? আমি অবাক হয়ে স্যারের দিকে তাকালাম। এমন রসিকতার সুরে ওনাকে কখনো কথা বলতে শুনিনি।
মনে হল,আমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছি-বাবার সঙ্গে আছি,ভয় কিসের?
স্যার জিজ্ঞেস করলেন,তুমি কী কোন কারণে ডিস্টার্ব?
আমি মাথা নাড়লাম। বলতে ইচ্ছে করছে,আমার হারানো বাবাকে কখনো খুঁজে ফিরি না,আজ হঠাৎ ইচ্ছে করছে তাকে কাছে পেতে। আমার বাবা থাকলে আপনার মত করে হয়ত আমাকে শাসন করত,বোঝাত।
কোন সমস্যা হলে আমাকে বলবে। এই প্রথম কাউকে আমার ক্লাসে অমনোযোগী দেখলাম,সমস্যা অবশ্যই আছে।
এখন যেতে পার।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এক ছুটে বের হয়ে আসলাম।
আকাশে মেঘ করেছে। রাস্তাঘাটে মানুষজন নেই,সবাই এক সঙ্গে কোথায় গেল? আমার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করছে,আনন্দের গান-আজ বাবাকে যে খুঁজে পেলাম! এমন কিছু বলেননি,তবু মনে হচ্ছে কত আপন।
২। ।
পরদিন থেকে স্যারের সঙ্গে সম্পর্ক সহজে হতে থাকল। রবিন পর্যন্ত টিটকারি দিয়ে বলল,বুড়া লোকের সঙ্গে প্রেমের সুবিধা একটাই-তারা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
একে এতদিন বন্ধু ভেবেছি!
একটি কথায় কখনো সম্পর্ক তৈরি না হলেও,ভেঙ্গে যেতে পারে। আমার তিন বছরের অনুভূতিগুলো তিন সেকেন্ডে তিন খন্ড হয়ে গেল। আমি কখনো স্তব্ধ হই না,হলেও বুঝতে দিই না। রবিন কি বুঝল জানি না। সে এবার ঠান্ডা স্বরে বলল,নিজেকে হারিয়ে ফেলিস না।
তুই কা্রও সম্পত্তি না,যে কেউ তোকে নিজ গরযে খুঁজে আনবে। আমি ঠান্ডা স্বরে বললাম,কারও এত যোগ্যতা হয়নি যে আমাকে খুঁজে পাবে! রবিন আমার কাঁধে হাত দিল। আমি এক ঝটকায় সরিয়ে দিলাম। রবিনের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল,দানব এসে ভর করেছে। রেগে গিয়ে রবিন বলল,আমি তোকে ভালবাসি,তাই বোঝাতে চাচ্ছিলাম;অবশ্য এখন আর স্যার ছাড়া...।
আমি কথা শেষ করতে না দিয়ে এক ছুটে স্যারের রুমে গিয়ে হাজির হলাম। আমার চোখ ভরা জল,ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। বিব্রত হয়ে স্যার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,কী হয়েছে?
প্রশ্ন শুনে জলের ধারা আরও বেড়ে গেল।
আমি স্যারের কাছে গিয়ে দাড়ালাম। নিজের অজান্তেই কাঁধে মাথা রাখলাম।
বাবার কাঁধে মেয়ে মাথা রাখতেই পারে,যে যাই বলুক।
স্যার কিছু বলছিলেন,আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। শক্ত হাত দিয়ে আমার মাথায়,চুলে পরম মমতায় ছুয়ে যাচ্ছিলেন । বাবাকে কখনো কাছে পাই নি;অন্যরকম এক ভাললাগা বোধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি যেন। হাত যখন আমার পিঠে,তখন মনে হল-মেয়ের কষ্টে বাবাই প্রকৃত বন্ধু!
বাংলায় আমি চিরকাল দুর্বল;ভাব-সম্প্রসারণ,ব্যাখ্যা মুখস্ত করে লিখতাম।
জীবনের বিশ্লেষণ মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে করা যায় না। করা গেলে হয়ত এরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা দিতে পারতাম। বাবার মত যাকে ভাবলাম এক মুহূর্ত আগে,উনি কি করে আমার নারীসত্তার প্রতি লোভী হয়ে উঠলেন? যে স্নেহের হাতকে মনে হচ্ছিল বাবার-তা কী করে পুরুষের হাতে পরিণত হয়ে গেল? উনি যখন দরজা লাগিয়ে এলেন,আমি তাকিয়ে শুধু দেখলাম। উনি যখন ঠোঁট ছোঁয়ালেন,আমি পাথরের মত দাড়িঁয়ে রইলাম।
মানুষ এত নীচ হতে পারে!চেহারার সামনে এত পুরু মুখোশ থাকতে পারে! রবিন কী আমাকে সাবধান করতে চেয়েছিল? আমি কেন বুঝতে পারিনি?
এরপর টানা পাঁচদিন ক্লাসে আসিনি।
তবে সেজন্য পৃথিবী থেমে থাকেনি,সবাই ক্লাস করেছে;দীঘি এল কি এল না-কেউ খোঁজ নেয় নি। আমি নিজে অসময়ে,অদরকারে কার খোঁজ নিই? আসলে আমরা সবাই একা-এ সত্যটা আমি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছি।
এখন আর ভুলেও মা’কে বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় না । ভয় লাগে মা যদি বলে সবুজ স্যার-ই তোর বাবা!
ইদানীং বদলে যাচ্ছি,নিজের ভেতর বদলে যাওয়াতা টের পাই। কার মাঝে আর বাবার ছায়া খুঁজে বেড়াই না।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে মা’কে প্রায় কাঁদতে দেখি। মা’র বোকামীতে আমার হাসি পায়। আজ যদি বাবা থাকত আর সবুজ স্যারের মত করত?
ক’দিন পর রবিনের টাকা চাওয়ার আসল কাহিনি জানতে পারলাম। ছাত্রীকে প্রেগনেন্ট বানিয়ে ফেলেছিল-সেই পাপ মোচনের জন্য দরকার সস্তা ক্লিনিক আর দরকার টাকা।
জানার পর আবার চোখ দিয়ে দু’ফোটা জল বের হয়ে এল।
আর কাঁদব না আমি,কারও জন্য না,কোন কিছুর জন্য না। ভালো হয়েছে আমার বাবা নেই,ভালো হয়েছে রবিন আমকে ভালবাসে না,এই তো বেশ আছি । আমার কাউকেই দরকার নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখি,আজ রাস্তায় অনেকগুলো পোশাক পড়া কুকুর-অন্ধকারেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে;এমন কুকুরদের কেবল অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখা যায়।
সমাপ্ত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।