যা লিখি, হয়ত কিছুই লিখি না। যা লিখব হয়ত অনেককিছুই লিখব। আসল কথা হলো, গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না ১। ।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি,আমার বাবা হারিয়ে গেছেন।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা প্রায় বলেন,যে হারিয়ে যেতে চায় তাকে হারিয়ে যেতে দেয়া উচিত,আটকানোর চেষ্টা বৃথা। কিন্তু এখানে আমার কী দোষ?এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি,অথচ ছোট থেকে বড় সব মানুষ আমার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকায়। মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলে তারা জিজ্ঞেস করে,তোমার বাবা কি করেন? আমি নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেই,বাবা হারিয়ে গেছেন। জবাব শুনে প্রশ্নকারীর চোখ গোলগোল হয়ে যায়। আমি থোড়াই এর কেয়ার করি।
আমি তাদের খাই,পড়ি না। কিন্তু আজ যখন রবিন জিজ্ঞেস করল,দীঘি তোর বাবা কোথায় আছেন? আমি মুহূর্তের জন্য উদাস হয়ে গেলাম। বাবা বেঁচে আছেন কিনা জানি না। কিভাবে হারালেন,কোথায় হারালেন,কেন হারালেন সে খবর পর্যন্ত আমার কাছে নেই।
রবিনকে বললাম,জাহান্নামে ।
সে পাত্তা দিল না। বলল,ঠিক করে বল। আমি হাসিমুখে বললাম,ঘোড়ার ঘাস কাটেন। রবিনের চোখেমুখে বিরক্তি খেলে গেল,ফাজলামি বাদ দে। আর কত? বলতে ইচ্ছে হল,আমার বাবা আমাকে ভদ্রতা শেখায়নি যে তোদের মতো ভদ্র হব! কিন্ত বললাম না।
মিষ্টি করে একটু হাসি দিলাম। রবিন আমার খুব ভালো বন্ধু। আসলে ও ছাড়া আমার কোনো বন্ধু নেই। তবু আমার হৃদয় খুঁড়ে বেদনা দেখাতে ইচ্ছে করে না। কী দরকার করুণার?এইতো বেশ আছি।
আমি ছোট থেকে এখন পর্যন্ত অনেক প্রপোজাল পেয়েছি। এর কারণ নিশ্চয় আমার রূপ। নাহলে,মানুষ প্রথম দেখাতে কেন বলে,আমি তোমার প্রেমে পড়েছি! মাঝে মাঝে খুব ভাল লাগে। আহা!আমি কত সুন্দর। কতজন আমাকে নিয়ে ভাবছে,স্বপ্ন দেখছে,এমন ভাবনায় ডুবে থাকতে খারাপ লাগে না।
যদিও না মিশে কিভাবে ভালবাসা যায়,আমি বুঝি না। অবশ্য,যে মেয়ে বাবার পরিচয় জানে না,তার এত কিছু বোঝার কথাও না!
আমার মা রাহেলা মমতাজ সারাদিন চেঁচামেচি করেন। স্বামী থাকলে হয়ত তার সঙ্গে চেঁচাতেন। এখন এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় আমাকে। এই একটি সময়ে বাবাকে খুব মিস করি!কী দরকার ছিল তার হারিয়ে যাওয়ার?মা এমনিতে নিপাট ভদ্র মহিলা।
এক সময় সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায়। নাহলে,আমি সুন্দরী হলাম কী করে?বাবা দেখতে কেমন ছিলেন?বাবাও কি সুদর্শন ছিলেন?মাকে জিজ্ঞেস করি করি করেও করা হয় না।
সকালে ভার্সিটি যাবার পথে মা আটকিয়ে বললেন,আজ বাসায় তাড়াতাড়ি আসবি। চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,ঘটনা কী?
ঘটনা আবার কী? আমি তোকে তাড়াতাড়ি আসতে বলতে পারি না?
মুখের হাসি দু কান পর্যন্ত বিস্তৃত করে বললাম,অবশ্যই বলতে পারবে। কিন্তু ঘটনা স্বাভাবিক হলে তুমি ধমক দিয়ে বলতে,দেরী করে ফিরলে থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব।
মা এবার হেসে ফেললেন,কষ্ট মাখা হাসি।
আমার মন খারাপ হয়ে গেল। বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে মা আমাকে একা মানুষ করেছেন। যা চেয়েছি,তাই এনে দিতে চেষ্টা করেছেন। এখন আমার বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।
নিশ্চয় আজ বিকেলে কেউ আমাকে দেখতে আসবে।
মাকে বলে বসলাম,আমাকে এভাবে দেখিয়ে কী লাভ বলবে? বাবা নেই,দেখতে সুন্দরী তবে চরিত্রে সমস্যা থাকতে পারে-কত অভিযোগ মানুষের। বিয়ে শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যাবে;অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে আমাদের কাঁদানোর জন্য। ঝরঝর করে মা কেঁদে ফেললেন আর আমি স্বার্থপরের মতো বের হয়ে আসলাম।
আমি জানি,বুঝি অবিবাহিত মেয়েদের নিয়ে মা-দের অনেক চিন্তা থাকে।
সেই চিন্তার কারণে আমার ঝামেলাবিহীন জীবনে কোনো গর্ত খুঁড়তে চাই না। বাসা থেকে বের হয়ে রবিনকে ফোন দিলাম। ঘুম ঘুম কন্ঠে সে বলল,সুন্দরী এত সকালে কী মনে করে?
এত সকাল কই?সাড়ে ন’টা বাজে। ক্লাসে যাবি না?
যাব না। ইচ্ছে করছে না,তবে অন্যকিছু পেতে মন চাইছে।
আমি নিশ্চিত,যদি জিজ্ঞেস করি,তবে এমন কোনো উত্তর শুনব যে রাগে আমার গা জ্বলে যাবে। তবু জানতে চাইলাম।
তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন রেখে দিলাম। বিস্মিত হয়ে খেয়াল করলাম,আমার লজ্জা লাগছে,ভীষণ লজ্জা! যেখানে রাগ হবার কথা,সেখানে লজ্জা!
রবিন একদিন বলেছিল,যেদিন আমার কথায় রাগ করতে পারবি না সেদিন বুঝবি তোর মনে এই অধমের জন্য ভালবাসার সৃষ্টি হয়েছে।
হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম,তোর মাঝে এমন কি আছে?রবিন জবাব দেয়নি। রবিনের মাঝে কিছু না থাকলেও আমার জন্য মমতা আছে। চোখের জল মুছে দেবার ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমার নাম যে দীঘি,জল মুছলে কতটুকুই বা মুছতে পারবে?
বাসায় এসে আর কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সামনে পড়তে হয়নি ।
রবিনের সঙ্গে দেখাও হয়নি,তাই মন কিছুটা খারাপ। ও আমার শুধুই বন্ধু,তারপরেও কেন মন খারাপ হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
মানুষের মন খারাপ থাকলে কেউ উদাস হয়ে আকাশ দেখে,কেউ কবিতা লেখে, কেউ মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে- আর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আমার ঘুমের ঔষধ হল,বিষন্নতা। আমার মন খুব কম সময়ে খারাপ থাকে,হাজার দুঃখ দূরে সরিয়ে অবলীলায় হাসতে পারি-তাই প্রায় রাতেই আমি নির্ঘুম বসে কালো আকাশ দেখি,বাড়ির পাশে ফুটপাতে গৃহহীন মানুষের নিশ্চিন্ত ঘুম দেখি,বেওয়ারিশ কুকুরের ক্লান্ত চলন দেখি।
কিন্তু আজ রাতে ঘুম পেয়ে গেল। বাসার পাশে ফুটপাতে একটা ছোট ছেলে থাকত। কদিন ধরে দেখছি না ছেলেটিকে। চিন্তা হচ্ছিল; যদিও জানি যার গৃহ নেই,তার গৃহহীন হবার ভয় নেই। তবু ঘুম আটকে রাখতে পারিনি।
অনেক বড় কিছুর মাঝে জড়িয়ে থাকলেও ক্ষুদ্র চেতনার খোঁচা রক্তাক্ত করে বেশি;বাবা না থাকার চেয়ে তাই রবিনের গরহাজিরতাই চোখে ঘুম এনে দিল আমার।
সকাল বেলা আমাকে অবাক করে দিয়ে রবিন এসে হাজির। জিজ্ঞেস করলাম,কীরে সূর্য আজ মাটির তলা দিয়ে উঠল নাকি?
না,তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। এক সঙ্গে বের হব।
আমি রবিনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।
চোখ লাল হয়ে আছে,বোঝা যাচ্ছে রাতে ভালো ঘুম হয়নি। তবে আজ-কী সে আমাকে ভালবাসার কথা বলবে ? বাহির বলে দূরে থাকুক,ভেতর বলে আসুক না-এই দোটানায় পড়ে গেলাম। দ্রুত রেডি হয়ে আসলাম। মা আজকেও পথ আটকালেন। তোর ওড়না এভাবে গলায় পেঁচিয়ে রেখেছিস কেন?
গরম লাগে।
উত্তর দিয়ে বের হয়ে আসতে চাইলাম। পারলে আমাকে মেরে বসেন মা। শেষ পর্যন্ত ওড়না ঠিক করেই বের হতে হয়। গরম লাগলেও বস্তা পড়ে বসে থাকতে হবে,নাহলে লোকে খারাপ বলবে! কী আর করা,আমার পক্ষে সমাজ বদলানও সম্ভব না-তাই এভাবেই চলি,চলতে হবে।
রিকশায় রবিনের পাশে স্বস্তি নিয়ে বসতে পারলাম না।
শিরশিরে অনুভূতি বয়ে যেতে থাকে, এই অনুভূতির সঙ্গে পূর্ব পরিচয় নেই আমার।
রবিন নীরবতা ভেঙে বলল,কিছু টাকা দিতে পারবি?
টাকা! কেন?তুই কী আমার অবস্থা জানিস না?যা শুনব ভেবেছিলাম,তা না শোনাতে মেজাজ ধরে রাখতে পারলাম না। বেশ রুঢ় স্বরে উত্তর দিলাম।
জানি। আসলে খুব দরকার ছিল।
তুই প্লিজ মাইন্ড করিস না।
নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হল। এত স্বার্থপর কেন আমি?বন্ধুর বিপদ হতে পারে এটা না ভেবে,নিজের চাওয়ার কথায় ভাবলাম!মন খারাপ হয়ে গেল আবার। পুরো রাস্তায় আর একটি কথাও হল না।
( চলবে)
কিছু কথাঃ আমার বর্তমান লেখার স্টাইলের সাথে এটার তেমন কোনো মিল নেই।
এটি ছিল আমার জীবনের লেখা প্রথম গল্প গুলোর একটি। বিরক্তির জন্য আগাম ক্ষমাপ্রার্থী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।