একজন মৃত কবি বাংলাদেশের উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তুলনামুলকভাবে কম আলোচিত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিক। ১৯৭৬ থেকে শুরু করে ২০১০ পর্যন্ত এদেশের প্রায় ৬৭ লক্ষ মানুষ জীবন জীবিকার তাগিদে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছে। মরুভূমির তপ্ত বালি কিংবা হিমাংকের নিচে ভয়ংকর ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে তারা পরিশ্রমের ফসল জমিয়ে দেশে পাঠাচ্ছে।
কিছু উপাত্ত উপস্থাপন করলেই আমাদের অর্থনীতিতে তাদের গুরুত্ব কতো বেশি তা উপলব্ধি করা যাবে। শুধু ২০১০ সালেই প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমান ছিল ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি যা ছিল জিডিপির ১১ ভাগ।
দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ১৩ ভাগ হচ্ছে প্রবাসী কর্মী। অপরদিকে, যে সাহায্যের জন্য আমরা বিদেশীদের দ্বারে দ্বারে প্রতিনিয়ত ধর্না দিই আর তাদের সামনে মাথা নত করে থাকি, তা ছিলো ওই সময়ে মাত্র ১৫ হাজার কোটি টাকা। যদিও বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে তা ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। এই বৈদেশিক সাহায্য শুধু নামেই সাহায্য। এর উল্লেখযোগ্য অংশ ঋণ।
আর এসব সাহায্য দিয়ে উন্নয়নকাজ করার সময় তাদের কারখানা চালু রাখার জন্য আমদানি করতে হয় তাদের পন্য, তাদের বেকারেরা এদেশের প্রকৌশলীদের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি বেতন নিয়ে হয়ে যায় ‘পরামর্শক’।
২০০৯-১০ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার অপর প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এর একটা অংশ চলে যায় পন্যের কাঁচামাল কিনতে। শ্রমিকদের শোষণ করে যে বিশাল লভ্যাংশ পাওয়া যায় তার সিংহভাগ বিনিয়োগকারী বিদেশী কোম্পানি গুলো নিয়ে যায়। আর দেশীয় গার্মেন্টস মালিকরা নিশ্চয়ই বিলাসিতা করে বিদেশে ছুটি কাটানোর জন্য,বিদেশী দামি গাড়ি আর পন্য কেনার জন্য তাদের অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খরচ করে না।
এবার আসা যাক প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের বিষয়ে। তারা তাদের পুরো অর্থ বিনা শর্তে দেশের অর্থনীতিতে যোগান দেই। সরকার তাদেরকে সি আই পি মর্যাদা দেয় না, তাদের ঋণ মওকুফ করে না কিংবা বিদেশি ঋণদাতা এবং বিনিয়োগকারীদের মতো রাজকীয় সম্মান দেখায় না। আসলে এসব তারা আশাও করে না।
তারা আশা করে তাদের টাকায় চলা দূতাবাস কর্মকর্তারা সাদা চামড়ার সাথে যতটুক ভদ্রতা করে তাদের সাথে ও ততটুক করুক।
তারা আশা করে বিপদের সময় তাদের সরকার তাদের পাশে এসে দাঁড়াক। তারা জানতে চায় কেন সরকার নির্ধারিত পরিমানের চেয়ে ৫-১০ গুন বেশি অর্থ দিয়ে অর্থ দিয়ে বিদেশে যেতে হয়?
মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে যাওয়ার জন্য একজন শ্রমিককে গুনতে হয় ২-৪ লক্ষ টাকা আর ইউরোপ বা উন্নত দেশে যাওয়ার জন্য ৬-১৫ লক্ষ টাকা। জমি বিক্রি করে, গোয়ালের গাভী বিক্রি করে, ঋণ নিয়ে দালালের হাত ধরে বিদেশের মাটিতে এসে দেখে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা প্রতারিত হয়েছে। হয়তো যে কোম্পানিতে চাকরি করতে এসেছে তার অস্তিত্বই নেই। থাকলেও দেখা যায় দোকানের সেলসম্যানের চাকরি দেয়ার কথা বলে দিয়েছে বহুতল ভবনে রাজমিস্ত্রির কাজ।
এমনও দেখা গেছে গ্রামের স্কুলশিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম বিদেশে গিয়ে রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজ করতে গিয়ে পরস্পরকে দেখে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলেছে। কিন্তু যাই হোক না কেনো; ভাষা না জানা পরদেশে অধিকারহীন শ্রমিক হয়ে, মাথায় ঋণের বোঝা নিয়ে বিকল্প চিন্তা করার বিলাসিতা তাদের থাকে না।
যেসব শ্রমিক কাজ না পেয়ে কিংবা অত্যাচারী মালিকের কাজ ছেড়ে অন্য কোম্পানিতে কাজ নেয় তারা ওই দেশে আইনের চোখে অপরাধী হয়ে যেতে হয়। পুলিশি ধাওয়ার মুখে তাদেরকে দিনরাত খাটতে হয়। বিদেশে যারা যায় তারা সাধারণত, ২০-৪০ বছর বয়সের কর্মক্ষম ব্যাক্তি।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, অতি কাজের চাপ এবংনিরাপত্তাহীনতার কারনে প্রধানত হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগ এবং দুর্ঘটনার কারনে গত ৫ বছরে ৮ হাজারের বেশি প্রবাসীর লাশ ফিরে এসেছে।
এটা মনে রাখা উচিত, বিদেশীরা দয়া দেখিয়ে আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে যায় না। তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিক না গেলে তাদের অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাবে। যেমন, সৌদি আরবের মোট শ্রমশক্তির ৫০ ভাগের বেশি অভিবাসী কর্মী।
তবে সারা বিশ্বে দক্ষ শ্রমিকের যে চাহিদা তা পূরণ করতে বাংলাদেশ অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে।
এ জন্য সরকারের গাফিলতিই প্রধান কারন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকারদের কর্মউপযোগী প্রশিক্ষণ দিয়ে সরকারি ঋণ দিয়ে বিদেশে পাঠালে রেমিটেন্স আরো পাঁচ গুণ বাড়ানো সম্ভব। আমাদের শিক্ষা, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি প্রনয়নে প্রবাসে শ্রমিক রুপ্তানি এবং তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয় অন্যতম প্রধান বিবেচনায় রাখা উচিত। কারন, এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলে তা সুদে-আসলে উঠে আসতে বেশি দিন লাগবে না।
উন্নত দেশগুলোতে জনগণের গড় আয়ু দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে এবং পরিবার গঠন ও সন্তান জন্মদানে অনীহার কারনে জনসংখ্যার অধিকাংশই হয়ে যাচ্ছে অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।
একদিন দেখা যাবে, এসব দেশে প্রশাসন থেকে কল কারখানা সবকিছু চালানোর জন্য এশিয়া-আফ্রিকার বিশাল জনগোষ্ঠীর বিকল্প নেই। সে সুযোগ নেয়ার জন্য আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।