আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুর্বল তত্ত্বাবধায়ক বনাম সবল নির্বাচন কমিশন

ব্লগার পাঠক হিসেবেই বেশী আনন্দে আছি। সুপ্রীমকোর্ট ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে 'অসাংবিধানিক' এবং 'অবৈধ' বলে রায় দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দেশে যে ধরনের চিন্তা-ভাবনা হওয়া উচিত ছিল তেমনটি খুব একটা হয়নি। বিরোধী দল সরকার এবং আদালতকে একাকার করে বিষয়টি দেখছে, প্রচারও করছে। মিডিয়াগুলোতে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পর্যবেৰণ তুলে আনা হয়নি।

সরকার এবং সংবিধান সংশোধন কমিটি সর্বশেষ সুপ্রীমকোর্টের রায় অনুযায়ী জাতীয় সংসদেই বিষয়টির ফয়সালার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং জামায়াত 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলে কঠোর আন্দোলনের' কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩১ মে সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছেন যা গভীরভাবে বিবেচনায় নেওয়ার দাবি রাখে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, সুপ্রীমকের্টের রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার কোন সুযোগ নেই। সে ৰেত্রে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেই এগুতে হবে।

জানি বিষয়টি নিয়ে অনেকেরই মনে নানা দ্বিধা-সংশয়, আশঙ্কা, অবিশ্বাস ও সন্দেহ রয়েছে। সন্দেহগুলো একেবারেই অমূলক নয়। তবে কেউই এখন আর ১৯৯৬ সালের মতো বিশ্বাস নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হিসেবে দাবি করতে পারছে না। সেখানেও সঙ্কট তৈরি হয়েছে, আস্থার জায়গা নষ্ট হয়ে গেছে। একটি উভয় সঙ্কটের মধ্যে সমগ্র জাতি রয়েছে।

সরকার যে জায়গায় জাতিকে নিয়ে যেতে চায়_সেটি সংসদীয় গণতন্ত্রের আসল জায়গা। এতেও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল সরকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে যতই অনড় অবস্থান দেখাক না কেন, সংবিধান মতো আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা নিয়ে এখনই কঠোর অবস্থানের কথাই বলে রেখেছে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পৰে অনড় অবস্থা নেয়া বিরোধী শিবিরের মধ্যে ২০১৪ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোন আস্থা নেই, দেশে ২০০৬ সালের পরিস্থিতি সৃষ্টির একটি সম্ভাবনা অনুমান করা যাচ্ছে। বিষয়টি একদিকে বেশ গুরম্নতর, অন্যদিকে সকল পৰ আনত্মরিক হলে, আলোচনার টেবিলে বসলে ততটা জটিল কিছু নয়।

মূল বিষয় হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেৰ করার, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার দায়িত্ব কার হাতে অর্পিত থাকবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি নির্বাচন কমিশনের ওপর। পৃথিবীর সব দেশেই নির্বাচন কমিশনের ওপর সেই দায়িত্ব অর্পিত আছে। তাদের নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন এবং শক্তিশালী তা আমরা দেখে আসছি বহু বছর থেকেই। সম্প্রতি ভারতে বিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সেখানে ৰমতাসীন সরকারের ভরাডুবি ঘটেছে। নির্বাচন কমিশনের বিরম্নদ্ধে কোন পৰেরই কোন অভিযোগ উঠতে শোনা যায়নি। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হতে কোন বাধা নেই এটি প্রমাণিত হচ্ছে। পৃথিবীর উন্নতদেশগুলোতে এ নিয়ে তেমন কোন সমস্যা হতে শোনা যায় না, সমস্যা হচ্ছে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। এখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, করার মতো কাজ অনেকেই করে না, জোর-জবরদসত্মির অনেক ঘটনাই প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে হয়ে থাকে।

এর থেকে পরিত্রাণ পেতে বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের' ধারণা সংবিধানে অনত্মভর্ুক্ত করা হয়। তখন ভাবা হয়েছিল, ৯০ দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে বিদায় নেবে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে তেমন কোন সমস্যা হয়নি, তবে সরকার পরিচালিত হওয়া নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ৫ বছর ৰমতাহীন থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিন তিনি বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠেন এমন নজিরই বেশি। ১৯৯৬ সালে গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটি সামরিক অভু্যত্থানের চেষ্টা হয়, দু'দিন দেশে ভিন্নতর পরিস্থিতি ছিল।

তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার প্রজ্ঞা এবং রাজনীতির ভেতরের একটি দায়িত্বশীল অংশের চেষ্টায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেছে। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এক পৰের আস্থা ছিল, অন্য পৰের তা ছিল না। একপৰ দাবি করার সঙ্গে সঙ্গেই সামরিক বাহিনীকে নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল, অন্যপৰ এটিকেই সন্দেহ করার কারণ হিসেবে দেখেছে। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়েই ৰমতাসীনদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন ঢেলে সাজানোর বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন তা নিয়ে দেশে যে ধরনের ছলচাতুরি, জোর-জবরদসত্মির আশ্রয় নেয়া হয়েছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য।

শেষ পর্যনত্ম বিদায়ী সরকারের ইচ্ছেমতোই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মনোনীত হন, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান গোটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেই 'ঠুঁটো জগন্নাথ' বানিয়ে এককভাবে চলতে থাকেন তবে নিজের বুদ্ধি ও শক্তিতে নয়, বিশেষ ভবন ও বিশেষ ব্যক্তিদের শক্তিতে। দেশ সংঘাতের দিকে গেল, ২২ জানুয়ারি একটি 'এক দলীয় নির্বাচন' দেখানোর আয়োজনও সম্পন্ন করা হয়েছিল। ১/১১-এর কারণে তা সম্পন্ন করা গেল না। সবারই মনে আছে, কেমন নির্বাচন কমিশন তখন দেশে ছিল। লজ্জায় গোটা জাতির মাথা হেট হওয়ার অবস্থা।

প্রশাসনও অনেকটা তাই ছিল। এই যদি একটি দেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের অবস্থা হয়, তা হলে সে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কীভাবে সম্ভব হবে_তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। ওয়ান ইলেভেনের সরকারের অনেক কাজই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে তারা দেশে নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলোকে অস্বীকার করার উপায় নেই। নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠিত করা, ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা, প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো এবং অবধা ও সুষ্ঠু নির্বাচনে আইন ও বিধি প্রবর্তন করাসহ বেশ কিছু পদৰেপ নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করেছে যার সুফল গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন ও পৌর নির্বাচনে আমরা প্রত্যৰ করেছি।

এখন যে সব ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেগুলোতেও আমরা নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন অবস্থান লৰ্য করছি। বলা যেতে পারে, আমাদের নির্বাচন কমিশন গত চার বছরে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তি, অভিজ্ঞতা ও চিনত্মা-ভাবনা সঞ্চয় করতে সৰম হয়েছে। এটি একটি নতুন উপাদান যা আমাদের বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এটিকে ধরেই বাংলাদেশ আসলে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মঞ্জিলে পেঁৗছতে পারে। অর্জনের এই অংশকে বাদ দিয়ে চললে শেষ পর্যনত্ম আমাদের নতুন করে অর্জন করার সুযোগই হবে না।

বস্তুত বাংলাদেশ যে চিনত্মা-ভাবনা থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল সেটি সফল হয়নি। অধিকন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান কে হবেন তা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে দেশে যা চলে তাও খুব একটা শোভনীয় নয়। সে সরকারও শক্ত নৈতিক ও আইনগত অবস্থানে থেকে কোন কাজ করতে পারছে না। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ ধরনের জোড়াতালি লাগানো সরকার মোটেও রাষ্ট্রের জন্য শুভ হতে পারে না_সেটি গত তিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতায় যেমন বোঝা গেল, আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েও দেশে নৈরাজ্য, মাঠ দখল, হানাহানির সম্ভাবনা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।

ভবিষ্যতে আর একটি ১/১১ তৈরি হবে না এমন আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তখন কারও কিছু করার থাকবে না। এবার ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেষ পর্যনত্ম নির্বাচন দিয়ে ৰমতা থেকে চলে গেছে, ভবিষ্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলে যাবেন সেই নিশ্চয়তা আছে কি? তা হলে উপায় কী? উপায় অবশ্যই আছে। সেটি সংসদীয় সরকার পদ্ধতির নিয়মের মধ্যে আছে, সেখানে সেটিকে খুঁজতে হবে। সে ৰেত্রে সরকার এবং বিরোধী সব পৰকে বিষয়টির গুরম্নত্ব উপলব্ধি করতে হবে।

এখানে এককভাবে কোন দলের কৃতিত্ব নেওয়ারও কিছু নেই, অন্যদের হারাবারও কিছু নেই। হঁ্যা, মনে হচ্ছে ৪ দলীয় জোটের শারিক দলগুলো বিষয়টি আন্দোলন করার মাধ্যমে মাঠ গরম করার অবস্থানে থাকবে। তবে সে ৰেত্রে সরকার দলের করণীয় কী হবে সেটি অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়। জনগণকে বিষয়টি মহাজোট যদি আনত্মরিকতা ও সততার সঙ্গে বোঝাতে পারে যেমনটি সেদিন সংসদ নেতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সরল সহজভাবে বলেছেন, মুখের অবয়বে তাঁর ফুটে উঠেছে, সেটি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে করা গেলে জনমনে বর্তমানে যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, অজ্ঞানতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব জড়িয়ে আছে তা কাটতে শুরম্ন করবে, জনমত যদি নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা, প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীকে নীরবে রাখার ব্যাপারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে যুক্ত করার সরকারী উদ্যোগকে বিশ্বাস করতে পারে, আস্থায় নিতে পারে তা হলে বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইসু্যতে যে কোন আন্দোলন মাঠে মারা যাবে। এৰেত্রে সরকারকে সচেতন হতে হবে, মিডিয়ার সম্মুখে আতিপাতি সব নেতাই যেন বক্তৃতা ও জ্ঞানদানের বাঙ্ খুলে বসে না যান।

এই ইসু্যতে প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, সংবিধান সংশোধনী কমিটির কো-চেয়ারম্যান, দু'একজন সম্মানিত সদস্যের বাইরে কেউ কথা না বলেন, যারা বলবেন তাদেরও হোমওয়ার্ক করে বুঝে শুনে এবং সংবিধান মতোই বলতে হবে। জনগণ যদি দেখে বর্তমান সরকার নির্বাচন কমিশনকে আৰরিক অর্থেই স্বাধীন, শক্তিশালী ও সবল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য সংবিধানে প্রয়োজনে সংশোধনী আনছে, মেয়াদ শেষে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে কোন ব্যাপারে হসত্মৰেপ করার সরকারের সুযোগ থাকছে না, নির্বাচন কমিশন সে লৰ্যেই পরিগঠিত হচ্ছে, আইন বিধি-বিধান স্বাধীন, সবল, নিরপেৰ নির্বাচন কমিশনের চাহিদা মতো হচ্ছে_তা হলে যে অবস্থার সঙ্কট এতদিন সকল মহলে ছিল তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। সেটি করা গেলেই বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের ৰেত্রে অসম্পূর্ণতার এমন একটি বিষয়কে অতিক্রম ও অর্জন করতে সৰম হবে। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি তেমন অর্জনকেই ধরতে চাইবো, পেতে চাইবো। দেশের বেশিরভাগ মানুষই হয়ত এমনটিই চাচ্ছে।

এৰেত্রে সরকারকে আন্তরিকতা ও সততার পরীৰায় উত্তীর্ণ হতে হবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.