এখন আমি আর আমাকে আগের মতো করে ভাবতে পাড়ি না । সবসময় মনে হয় কেউ একজন আমাকে ঘিরে রেখেছে , আমার চারপাশে তার বাহু বিস্তার করে রেখেছে । দিন যায় –রাত যায় রিয়াকে নিয়ে আমার কল্পনা শেষ হয় না, তাকে পাওয়ার বাসনা সামান্যও মলিন হয় না । আমি আমার আজান্তেই রিয়াকে অনেক বেশি ভালবেসি ফেলেছি । অথচ আমি জানি এর কোন যুক্তি হয় না, মাত্রা হয় না ।
চাতক পাখি আকাশে মেঘ দেখার জন্য যেমন করে আনমনা হয়ে উঠে , তেমনি আমিও মাঝে মাঝে রিয়াকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠি । কিন্তু কাউকে বলতে না পারার কষ্টে কিংবা রিয়াকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় আমি বিষণ্ণতার চরম অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি । কিন্তু আমি কি পারি না রিয়া নামের ঐ অদেখা –অচেনা মেয়েটাকে ভুলে যেতে ? নিজের এই প্রশ্নের উত্তর আমি কখনো দিতে পারি না । না পারার পিছনের গল্পটা বার বার মনে আসে । মনটা কেবলই পালাই পালাই করে কিন্তু আমি অনেকটা জোর করেই তাকে আটকে রাখি ।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন? যে রিয়া আমার সমস্ত চিন্তা- চেতনার মাঝে খুব সহজেই স্থায়ী আসন করে নিয়েছে তার নাম আমি দিয়েছি রাজকুমারী রিয়া । যদিও সে রাজকুমারী নয় , তবুও আমার কাছে মনে হয় রিয়াই সেই রাজকুমারী রিয়া যার সাথে আমার আজন্ম বসবাস, অনবরত পথচলা । মনে মনে আমি যে নারীর কল্পনা করি , যে আমার মাঝে ভাললাগার ভালবাসার উদ্রেক সৃষ্টি করে সেই রাজকুমারী রিয়া । প্রকৃতি তাকে হয়ত তিল তিল করে সৌন্দর্য দিয়ে তিলোত্তমা করে গড়ে তুলেনি । তবে সত্যিকারের পরম মানবী করে গড়ে তুলেছে ।
বিশুদ্ধতার মুকুট তার মাতায় স্ব-ইচ্ছায় পরিয়ে দিয়েছে । আর আমিও রাজকুমারী রিয়ার বিশুদ্ধতার সরবোরে অবগাহন করে নিজেকে পরিপূর্ণতার স্বাদ দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর । তবে তার নাম রিয়া না হয়ে ঊর্মিলা কিংবা নির্জরা হলেও পারত । তবে তা হয় নি । এই না হওয়ার পিছনের গল্পটা আমি কাউকে বলতে চাই না ,খুব অস্বস্তি বোধ করি ।
আমাদের সবারই কিছু না কিছু পছন্দের বিষয় থাকে- যা কাউকে বলা যায় না । এই গল্পটাও এমনই একটা বিষয় । তাই তা বলতে অপারগতা প্রকাশ করা ছাড়া আমার কোন উপায় জানা নেই ।
রিয়া বলেছিল তাকে মুক্তি দিতে । উপায়ও বলেছিল, তাকে ভালবাসতে হবে ।
হ্যাঁ, আমি তো তাকে সত্যিই ভালবাসি । কিন্তু তাতে কি রিয়া সত্যি সত্যিই অদৃষ্টের অসঙ্গায়িত কারাগার ভেদ করে আমার কাছে চলে আসবে ! নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করি । কিন্তু কোন কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না । আগামীকাল পূর্ণিমা । কাল অবশ্যই রিয়া অন্ধকারের জগত থেকে বের হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে ।
ভাবতেই ভীষণ আনন্দ হচ্ছে ।
সময় কাটছে না দেখে আজ আগেই চলে আসলাম দিঘির পাড়ে । কিন্তু কোথাও কেউ নেই । চারিদিকে পিনপতন নীরবতা । বাসায় সবাই হয়ত এখনো ঘুমাই নি।
তবুও চলে এলাম। কিন্তু আজ খুব ভয় ভয় লাগছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে মা বোধ হয় আড়াল থেকে আমাকে দেখছে । কিন্তু মা তো আমাকে এভাবে ছেড়ে দিত না । এত রাতে দিঘির ধারে কি কাজ করছি, তা না জেনে মা আমাকে কিছুতেই ছেড়ে দিত না ।
মাকে আমি এমনিতেই ভয় পাই । তবে ভয় বলা ঠিক হচ্ছে না। এখানে অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করা দরকার কিন্তু এই মুহূর্তে আমার এমন কোন শব্দ মাথায় আসছে না । আসলে জানাই নেই, আসবে কোথা থেকে? আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি । রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছি ।
মাঝ রাত পাড় হয়ে গেছে । আজ দিঘির জলে কোন আলোক জলকানি নেই , ঢেউ এর জলের খেলা নেই । সবকিছুকেই কেন জানি বিষণ্ণ মনে হচ্ছে! আমি হঠাৎ ডেকে উঠলাম রিয়া তোমার কি হয়েছে? তুমি কি আজ আসবে না। আমি তোমার জন্য – তোমাকে দেখার জন্য কত রাত এখানে এসেছি তা কি তুমি জানো না ? দিনের আকাশে তুমি উড়ে বেড়াও । আকাশের কাছে কত বার করে তোমার ঠিকানা চেয়েছি তাও কি তোমার জানা নেই? রিয়া তুমি ফিরে আস , ফিরে আস হৃদয়ে আমার ।
আমি তো তোমাকেই ভালবাসি। এই ভালোবাসা যে মানুষকে এতোটা আসহায় করে দিতে পাড়ে তা তোমাকে দেখার আগ পর্যন্তও আমার জানা ছিল না । তুমি ফিরে আস রিয়া , তোমাকেযে আসতেই হবে । আমার কথা আস্তে আস্তে শূন্যে মিলিয়ে যায় । কোন উত্তর আসে না।
হঠাৎ শুনতে পেলাম পিছন থেকে মা আমাকে ডাকছে । আস্তে আস্তে আমিত আমিত বলে মা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে । তবে মার কণ্ঠটা খুব ভারী মনে হল । শুনে আমার গা শিউরে উঠল । চারদিক থেকে অসংখ্য ভয় আমাকে ঘিরে রেখেছে ।
এর মধ্যে মার অচেনা গলা আমার ভয়টা কে আরও বাড়িয়ে দিল । মা আমার সামনে এসে দাঁড়াল । মার মুখ দেখে ভয়টা একটু কমে গেল। মা চুপচাপ আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “রিয়া আসবে না । ” মার কাছ থেকে এমন কথা শুনার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না ।
তবুও আমতা আমতা করে বলেই ফেললাম, মা তুমি কি সব জানো?” হ্যাঁ, জানি। জানি বলেইতো বলছি । তুমি রিয়ার কথা কিভাবে জানো মা? আমার এমন সাহস আগে কখনো ছিল না যে মার সাথে কোন বন্ধু তাও আবার মেয়ে বন্ধু নিয়ে কথা বলব । মা আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল, “আমি তোমার মা নই, আমি রিয়ার মা । তবে মানুষ নই ।
রিয়ার মার আত্মা । তাই তোমার মার চেহারায় এসেছি । যেন তুমি ভয় না পাও ।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার স্বাভাবিক বোধ হারিয়ে গেল ।
ভয়ের আনুভুতিটা এতই ভায়ানক ছিল যে একবার মনে হচ্ছিল আমি পানিতে ঝাপ দেই , হঠাৎ অবচেতন মনেই বোধদয় হল যে পানিতে ভূত বেশি থাকে । হয়ত রিয়াও মানুষ নয় । ভূতই হবে । পানিতে গেলে হয়ত আমাকে মেরেই ফেলবে । আবার জীবনের প্রথম আত্মা দেখছি মানে ভূত দেখছি এটা ভেবে একটু গর্বই হচ্ছিল ।
কিন্তু আমাকেতো বাঁচতে হবে , না হয় এই কথা গুলো মানুষ জানবে কি করে , এই ভেবে সামনের দিকে দৌড়ে যাবার জন্য যখনই তাকালাম দেখি কোথাও কেউ নেই! মনে হচ্ছে মা মেয়ে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে । এখনি টেনে পানিতে নিয়ে যাবে, আমার রক্ত চুষে খাবে । আমি কোথাও না তাকিয়ে এক দৌড়ে বাড়িতে চলে আসি । ঘরের দরজার সামনে এসে উল্টে পড়ে যাই । শব্দ শুনে বাসার সবাই ছুটে আসে।
আমাকে এই অবস্থায় দেখে বাবা ভীষণ অবাক হয় । মা কান্না শুরু করে দেয় । আমকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে যায় । মানুষ যাকে বেশি ভালবাসে তাকেই হয়ত বেশি শাসন করতে চায়। আবার তার জন্যই তাকে বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয় ।
এটাই হয়ত প্রকৃতির নিয়ম , নিয়তির খেলা ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।