আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজকুমারী রিয়া - ২য় পর্ব



আজকাল আমার আচরণে সবাই একটু বিরক্ত হচ্ছে । অথচ আমি চুপচাপ বসে থাকি , একা একা ঘুরে বেড়াই, আকাশের সাথে কথা বলি, দিঘির পারে গিয়ে বসে থাকি । তাতেও অনেকের সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে , তাও আবার আমার কাছের মানুষদের । এমনি ভাবে অনেকদিন চলে গেল । রিয়ার কথা আমি কাউকে বলতে পাড়ি নি ।

বন্ধুদের যখনি বলতে চেয়েছি , তখনি মনে হত কে যেন আর্তনাদ করে উঠে । আমাকে বলতে থাকে অমিত, তুমি আমার কথা কউকে বল না । তাহলে আমি চিরতরে হারিয়ে যাব । আর কোনদিন তোমার কাছে ফিরে আসতে পারব না । তাই কেউ জানে না আমি কার জন্য অস্থির হয়ে থাকি, কার কথা ভাবি ,কেইবা আমার মনের করিডোরে সবসময় হেঁটে বেড়ায় ।

আজ আকাশের চাঁদটাকে অনেক বেশি কাছে মনে হচ্ছে, চারিদিকে জোছনা ছড়িয়ে আছে । আজ পূর্ণিমা । এমন রাতেই রিয়ার দেখা পেয়েছিলাম , এই ভেবে আজও গেলাম দিঘির পাড়ে । কোথাও কেউ নেই, নিস্তব্ধ পৃথিবী । রাত প্রায় শেষের দিকে ।

কেন জানি আজ একটু ভয় ভয় লাগছে । তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে নেমে এলাম । পানিতে পা ডুবালাম । ওমনি মৃদু একটা শব্দ হল , যেন কারো বহু প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে । আমি চমকে উঠলাম ।

আর তাকিয়ে থাকতে পারছি না , চোখ বন্ধ করে স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম রিয়ার কণ্ঠ । রিয়া আমাকে বলছে , অমিত তুমি ভয় পেয়েছ কেন? তোমার তো ভয় পেলে হবে না । তুমি তো জানো, আমি রিয়া । তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম এতদিন ।

আজ এত দেরি করে আসলে কেন? তুমি কি জানতে না আজ তোমার সাথে আমার কথা হবে । তুমি হয়ত আমাকে খুঁজে বেড়াও কিন্তু পাও না । আর আমি পেয়েও পাই না। জানো, আমিত তুমি প্রতিদিন যখন দিনের বেলায় আকাশের সাথে কথা বল, আবার রাতের বেলায় দিঘির পাড়ে এসে দাঁড়াও তখন আমি তোমাকে দেখতে পাই , তোমার কথা শুনতে পাই। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারি না ।

খুব কষ্ট হয় তখন, অথচ কাউকে বলতে পারি না । আমিত, আমি এই গ্লানিময় জীবন থেকে মুক্তি চাই । আবার তোমাদের মতো করে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াতে চাই, পানিতে সাঁতরে বেড়াতে চাই, বৃষ্টিতে ভিজতে চাই , ছোট্ট একটা উপহার নিয়ে প্রিয় মানুষদের সামনে দাঁড়াতে চাই । বল আমিত, আমি কি পাবর আবার সাধারণ জীবনে ফিরে আসতে ? আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম রিয়ার কথাগুলো । মনে হচ্ছিল রিয়া বার বার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে ।

আমার কথা শুনতে চাইছে কিন্তু আমি ওকে কীভাবে বুজাব ওর কথা শুনতেই আমার অনেক বেশি বাল লাগে । তবু বললাম, রিয়া আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি স্বপ্ন দেখছি । তুমি শুনে অবাক হবে তোমাকে নিয়ে আমি অনেক আগে থেকেই ভাবতাম, তোমার একটা কল্পিত ছবিও আছে আমার কাছে । আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আজ সেই তোমাকেই আমি আমার সামনে উপলব্ধি করতে পারছি , আমি নিশ্চিত সেই তুমিই আজ ফিরে এসেছ আমার জীবনে । কিন্তু তুমি এমন করে একটা পাথরের মাঝে থাক কেন? কেন তোমার শরীরে অদৃশ্য শিকল ? কেন তুমি আমার সামনে আসতে পার না ? আমি বুঝতে পেলাম আমার কথা শুনে রিয়া মুখ আড়াল করে কাঁদছে , কান্নার শব্দ আমার কানে আসছে ।

আমারও খুব বিষণ্ণ লাগছে রিয়ার কান্না দেখে । রিয়া হঠাৎ কান্না থামিয়ে বলল, অমিত আর বেশিক্ষণ হয়ত তোমার পাশে থাকতে পারব না । চেয়ে দেখ আকাশে চাঁদটা আস্তে আস্তে জোছনাহীন হয়ে পড়ছে । যখন সব জোছনা ঝরে শেষ হয়ে যাবে তখন আমিও হারিয়ে যাব । আর তুমি যা জানতে চেয়েছ তাও বলব, যা জানতে চাও নি তাও বলব ।

তোমাকে বলতেই বলে । মনে হচ্ছে যে প্রকৃতি আমাকে শাস্তি দিয়েছে সেই আজ তোমাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে , আমাকে মুক্ত করবে বলে । বল অমিত, তুমি কি পারবে না আমাকে মুক্ত করতে এই গ্লানিময় জীবন থেকে । আমি আর সহ্য করতে পারছি না নিষ্ঠুর প্রকৃতির এই কঠিন শাস্তি । আমি সবসময় রিয়ার কথা তন্ময় হয়ে শুনতে থাকি, তাই ওর কথার উত্তর দিতে একটু দেরি হচ্ছিল ।

রিয়া তাতে যে খুব অস্থির হয়ে আছে তা দিঘির জলের এলোমেলো ঢেউ দেখেই বুঝা যাচ্ছিল । তাই আমি দেরি না করে বললাম, কথা দিচ্ছি আমার যা কিছু আছে তার সবটুকু দিয়ে আমি চেষ্টা করে যাব তোমাকে প্রকৃতির এই কঠিন কারাগার থেকে মুক্ত করতে । এবার তাহলে বল কেন তুমি বিশ্ববিধাতার রোষানলে পড়েছ ? কি পাপ তুমি করেছিলে ? আমাকে বল, অযত্ন বা অবহেলা কোনটাই হবে না । একটা আজানা কষ্টের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিয়া বলতে শুরু করল, “আসলে অমিত, বিশ্ববিধাতা বল আর প্রকৃতিই বল তাকে কোন দোষ দেওয়া যায় না । বরং আমিই একা একা সুখী হতে চেয়েছিলাম ।

প্রকৃতি আমাকে সুখের একটা নিশানা খুঁজে দিয়েছিল । খুব ভাব ছিল আমাদের মাঝে । কিন্তু আমি স্বার্থপরের মত একা একা সেই সুখের স্রোতে অবগাহন করতে চেয়েছিলাম । তাই বিশ্ববিধাতার কাছে অপারাধী হয়ে বেঁচে আছি । কিন্তু এই বেঁচে থাকার চেয়ে হয়ত মৃত্যু অনেক ভাল ছিল ।

আমি ভুল করেছি । মানুষতো ভুল করবেই এটাই স্বাভাবিক । সবাইত এক সময় না এক সময় ক্ষমা পায় । আমি কি ক্ষমা পাব না । বল অমিত, চুপ করে থেক না ।

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । তুমি ভয় পেও না রিয়া । আমি তোমার পাশেই আছি । তুমি অবশ্যই মুক্তি পাবে । তুমি তো ভুল করেছ মাত্র, পাপতো করনি ।

দেখবে তুমি যেমন চেয়েছিলে তেমনি একদিন হতে পারবে । তুমি হবে প্রকৃতির বিশুদ্ধতম মানিবী । আর তোমার শুদ্ধতায় – শুভ্রতায় আমিও পরিপূর্ণ হবো । কিন্তু কি করে তোমাকে মুক্ত করবো? কোন উপায় কি তোমার জানা আছে? রিয়া চুপ করে রইল । তবে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলছে সেটা অনুমান করতে পারছি ।

কণ্ঠে একটা বারতি মাধুর্য ছড়িয়ে রিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “অমিত, আমায় শুধু তোমাকে ভালবাসতে দাও। দেখবে তোমার আমার ভালবাসার পরশে প্রকৃতি কত অবলীলায় তার রুদ্ধদ্বার খুলে দিবে । ” আমি জানি না কি কারনে আমার মনটা হঠাৎ আনন্দে নেচে উঠল । এমন অনাবিল আনন্দ আর কোনদিন আসে নি আমার মনে । বুঝতে পারলাম, আমি যাকে নিয়ে কল্পনা করি, যাকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাই সে আর কেউ নয়, সেই রিয়া, এই রিয়া ।

। এই মুহূর্তে রিয়াকে এক নজর দেখতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে । কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব । নিজের মধ্যে বেড়ে উঠা অবেগটুকু আড়াল করে রিয়াকে বললাম, “ভালবাসার মানে আমি হয়ত তত বুঝি না । তবু বলছি, ‘তোমাকে ভালবাসি ! অনেক ভালবাসি !’ ভালোবাসা যে যাকে তাকে বিলিয়ে দেওয়া যায় না তা তোমায় দেখার আগ পর্যন্তও আমার জানা ছিল না ।

রিয়া হঠাৎ খুব জোরে শব্দ করে বলল, অমিত । চাঁদের আলোতো নিভে যাচ্ছে, আমাকে এক্ষণি চলে যেতে হবে । নাহয় হয়ত আমি মরেই যাব । কিন্তু আমি বাঁচতে চাই অমিত, তোমার জন্য হলেও বাঁচতে চাই । আমি চলে যাচ্ছি ।

তুমি কি কিছু বলবে? আমি অপ্রস্তুত থেকেই বললাম, রিয়া তুমি ভয় পেও না , আমি আছি তোমার পাশে। প্রকৃতি তোমার ডাকে সাড়া না দিলেও আমি তোমার বাসনাকে প্রকৃতির কাছে হার মানতে দিব না । কথা দিলাম, “তোমাকে প্রেমের পতাকা করে সুখের কপোত উড়াব”। রিয়া এতক্ষণে হয়ত লুকিয়ে পড়েছে দিঘির জলে । আবার চারপাশ নিরব হয়ে আসলো ।

রাত শেষ হয়ে গেছে, কয়েকটা নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে । পিছনে তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে দিঘির পাড়ে । ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।