“দিঘির জলে কার ছায়া গো” , হুমায়ূন আহমেদ এর এই উপন্যাসটা পড়তে পড়তে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি আমার কল্পনার জগতে । কি এক অদ্ভুত মায়ার জালে আমাকে বন্দী করে রেখেছে অস্পষ্ট এক মানবীর ছায়া , যার মোহ থেকে আমি কিছুতেই নিজিকে সরিয়ে রাখতে পারছি না । কখনো কখনো মনে হয় এ হয়ত লেখকের কল্পনা হবে তবে আমার বেলায় সত্য । আমি ভুল করছি না ,এত বড় ভুল কি কোন বিজ্ঞানের ছাত্রের হতে পারে !
আকাশের সাথে কত কথা হয় রোজ, কষ্টের কথা, সুখের কথা, কাউকে বলতে না পারা কথা । আকাশের সাথে ভীষণ ভাব জমেছে আমার ।
তাই মাঝে মাঝে আকাশকে বলি, “বলতো আকাশ, দিঘির জলে কার ছায়া ভেসে বেড়ায় ?কার জন্য আমি আকুল হই, কিসের জন্য আমি আনমনা হই?” আকাশ কোন উত্তর দেয় না, কেবল আমার দিকে চেয়ে থাকে । অনেক দিন পড় এক জোছনা রাতে আকাশ আমাকে নিজেই ডেকে ডেকে বলল , “তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ, আমি আকাশ বলছি তুমি যাকে মাঝে মাঝে নীল বলে ডাকো । মনে পড়েছে ? আজ জোছনা, যেও দিঘির পাড়ে, খুঁজে দেখ তোমার মতো করে । হয়ত সে আলো হয়ে দেখা দিবে তোমার কাছে । ” আমি তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশে চাঁদ আর নক্ষত্রের খেলা দেখছিলাম ।
রাত তখন শেষের দিকে । শেষ রাতের পৃথিবী ভাষাহীন এক অপরূপ সৌন্দর্য ধারণ করেছে । অর্খেক পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ হয়ত এখন ঘুমে আচ্ছন্ন । আমার বাসায়ও সবাই ঘুমএ । আমি একা একা জেগে আছি ।
আমি পা বাড়ালাম দিঘির দিকে । মনের মধ্যে ছাপা একটা ভয় কাজ করছে । তবু গেলাম দিঘির ধারে । মৃদু অস্তিরতা আর ভয়কে উপেক্ষা করে তাকালাম দিঘির জলে । দিঘির শীতল জল আঁচড়ে পড়ছে ছোট ছোট ঢেউ এর উপর ভর করে ।
হঠাৎ সে ঢেউয়ের আড়াল থেকে একটা নীলাভ আলো এসে বার বার উঁকি দিচ্ছে । মনে হচ্ছে যেন ঢেউগুলো জোর করে সেই নীলাভ আলোটাকে আটকে রেখেছে, বেড়িয়ে আসতে দিচ্ছে না । আমার সমস্ত অস্তিরতা-ভয় আচমকা লুকিয়ে গেল । আমি আরও সামনে গেলাম। যেতে যেতে দিঘির শীতল জলে পা ডুবালাম , ওমনি মিষ্টি একটা নারী কণ্ঠ ভেসে আসলো জলের গভীর থেকে ।
হঠাৎ নিজেকে বড় অচেনা মনে হল কয়েক মুহূর্তের জন্য । যেই আমি রাতের আকাশ দেখার জন্য মাঠে এমনকি রাস্তায় যেতে সাহস পাই না , সেই আমি গভীর রাতে দিঘির জলে পা ভিজিয়ে ভয়ানক রকম মধুর এক খেলায় মেতে উঠেছি সেদিন। ক্রমেই ঢেউগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, নীলাভ ঐ আলোটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল , মায়াবী ঐ নারী কণ্ঠটা আমার একেবারে কাছে খুব কাছে চলে এসেছে । আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, “ অমিত, তুমি হয়ত আমায় চেন না , তবু তোমায় আমি চিনি খুব ভাল করেই চিনি । মনে আছে তোমার , এক ভোর রাতে আকাশ থেকে একটা নীলাভ পাথর ঝরে পরেছিল এই দিঘির ধারে ।
তুমি ধরতে গিয়েছিলে কিন্তু পার নি । তুমি ভেবেছিলে এ হয়ত উল্কাপিণ্ড হবে । তাই না ? না অমিত, তুমি যাকে তুচ্ছ পাথর ভেবে ফেলে চলে গিয়েছিলে সে পাথর নয়, সে আমি, বিশ্বাস কর সে আমি ,রিয়া ;
প্রকৃতির সাথে ভীষণ ভাব ছিল আমার, আমি হতে চেয়েছিতারলাম প্রকৃতির বিশুদতম মানবী । কিন্তু খেয়ালি প্রকৃতি আমাকে ঠাই দেয় নি তার শুদ্ধতার আঁধারে, বরং আমাকে ঠেলে দিয়েছে নিষ্ঠুর এক জীবনের দিকে । আচ্ছা তুমিই বল এভাবে একটা পাথরের মাঝে কতদিন বেঁচে থাকা যায় ? তবু তোমার চোখে ছায়া হতে পেরেছি ,এতটুকু প্রশান্তি নিয়েই বেঁচে আছি ।
তুমি প্রতিদিন রাতে এই দিঘির কাছে আসবে, জলে নামবে ,আর আমি তোমায় প্রানভরে অনুভব করতে পারব । তুমি আমার কথা রাখবে তো ?
হ্যাঁ, রাখব । জলে নামবো, সাঁতরে বেড়াবো ,তোমাকে তোমাকে । বলতে বলতে হঠাৎ নিভে গেল সব আলো । দিঘির জলের ঢেউ থামেনি, শুধু হারিয়ে গেছে শুভ্র তনয়া রিয়া ।
আমার মন খারাপ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা হল না । ভাবতে থাকি, আমি মনে মনে যে সরল শুভ্র নারীর কল্পনা করি, রিয়াই কি সেই মেয়ে? না আমি ভুল ভাবি ! একা একা হেঁটে বেড়াতে অনেকেরই ভাল লাগে , আমিও তাদের দলে । তাই রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটছিলাম ,আর মনে মনে কথা বলছিলাম । “ রিয়া, তুমি কি আকাশ জুড়ে থাকো , আকাশে উড়ে বেড়াও –পাখির মতো, তুলোর মতো? আমি কি দিঘির জলে তোমারই ছায়া দেখি? আচ্ছা তুমি দিনের আলোয় ছায়া হয়ে থাকো আবার রাতের আঁধারে পানিতে লুকিয়ে থাকো কেন?” আমার কোন কথার কোন জবাব আসে না । আমি বাসায় ফিরে আসি, ঘুমাতে চেষ্টা করি ।
কিন্তু ঘুম আসে না ।
প্রতিদিন জলে নামি কিন্তু রিয়া আর আসে না । মনে মনে ভাবি রিয়া হয়ত নীরবে আমাকে দেখে আনন্দ পায় । তাই আমি শুধু দাঁড়িয়ে থাকি , দিঘির জলের অদ্ভুত সব খেলা দেখি । মাঝে মাঝে ঢেউয়ের কোনে রিয়ার উপস্তিতি আমি টের পাই ।
ভাল লাগে, ভীষণ ভাল লাগে তখন ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।