আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইমান হারানোর করূন কাহিনী

হ য ব র ল কথামালা না আর পারলাম না । খড়কুঁটো আঁকড়ে ধরে ইমান নিয়ে বেঁচে থাকার সব চেষ্টাই ব্যার্থ হলো । বিশ্বাস হারালাম ধর্মে। আর অজ্ঞেয়বাদকেই বেছে নিলাম সঙ্গী হিসেবে । বিশ্বাসের ছায়া সুনীবিড় পথ ছেড়ে অজ্ঞেয়বাদের রোদেলা গনগনে পথে শুরু হলো আমার পথচলা ।

ছোটবেলায় ভাবতাম কি অসাধারন সৌভাগ্য নিয়েই না আমি জন্মগ্রহন করেছি । নিজের কোন কৃতিত্ব না থাকা সত্তেও শুধুমাত্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করার কারনেই আমি কোন না কোন সময় বেহেশতে যাব । অথচ পৃথিবীর বেশিরভাগ লোকই দোজখে চলে যাবে । নিজে বেহেশতে যাব একথা ভেবে কিছুটা পুলকিত হতাম বৈকি,মাগনা মাগনা জিনিস পেতে কারই বা খারাপ লাগে । তবে বিশ্বাস থাকলেও ছোটবেলায় ধর্মকর্ম তেমন একটা করতাম না ।

বিশ্বাসের ঘাটতি ছিল না, নেহায়েত অলস্যের কারনেই নামাজ কালাম পড়া খুব একটা হত না । তবে ক্লাস নাইন টেনের দিকে আমি ব্যাপক মাত্রায় ধার্মিক হয়ে পড়ি । ওই সময়টাতে আমি লেখাপড়াতেও ব্যাপক মনোযোগী হয়ে পড়ি । আমার একাডেমিক রেজাল্ট ভালো হতে থাকে । এখন ধারনা করি ওই সময়টাতে আমার ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারন হচ্ছে,ভালো লেখাপড়ার সাথে সাথে নামাজ পড়ায় ভালো ছেলে হিসেবে বাবা মা,আত্মীয় স্বজনের বাহবা পেতাম , আবার আমার পড়ালেখার ওই তীব্র প্রতিযোগীতার সময়টাতে মানসিক শান্তির প্র্রয়োজন ছিলো, নামাজ পড়ে যেটা পেতাম প্লাস এলাকার ছেলেপিলেদের সাথে সোশালাইজেশনও হতো।

বিশেষ করে যোহরের নামাজটা মসজিদে পড়তে কি পরিমান শান্তি যে পেতাম তা বলে বোঝাতে পারবো না । মসজিদটা ছিলো অসাধারন এক প্রাকৃতিক পরিবেশে , বিশাল এলাকা নিয়ে, মসজিদের পাশে ছিলো প্রত্নতাত্তিক মাজার, খেলার মাঠ আর প্রচুর নারকেল গাছ । সত্যি সে সময়টা আমি উপভোগ করেছি । মূলত এস এস সির পর থেকেই ধর্মের প্রতি আমার উদাসীনতার সূচনা হয় । আসলে ওই সময় থেকে ধর্মের কিচ্ছা কাহিনী আমার কাছে দ্রুত আবেদন হারাচ্ছিলো ।

এর আগে শুধুমাত্র নারায়ণগন্জ শহরেই আমার চলাফেরা সীমিত ছিলো । নটরডেমে ভর্তি হবার সুবাদে আমার পৃথিবী যেন আগের চাইতে অনেক বড় হয়ে গেল । নটরডেমে পড়ার সময় একটা ব্যাপার আমাকে বেশ অবাক করত , নটরডেম হলো খ্রিষ্টান মিশনারী পরিচালিত , তাদের আসল লক্ষ্য হলো জিসাসের বানী পৌছে দেয়া অথচ খোদ কলেজ প্রাঙ্গনে একটা মসজিদ আছে । সেখানে মুসলিম ছাত্ররা নিয়মিত নামাজ পড়ে থাকে । খ্রিষ্টান মিশনারীরা তাদের ধর্মপ্রচারের টাকায় মসজিদ বানিয়েছে, তাদের এই উদারতা আমাকে সেসময় মুগ্ধ করেছিল ।

আমাদের তাবলিগের ভাইয়েরা কি কখনও চার্চ প্রতিষ্ঠা করবেন? ইন্টারমিডিয়েটের বায়োলজি আমার অগোচরে আমার মনের উপর ভীষন প্রভাব ফেলেছিলো । আগে আমি বির্বতনবাদকে বিজ্ঞানীদের মনগড়া ভাবতাম । কিন্ত বায়োলজি ল্যাবে ব্যাঙ কেটে আশ্চর্য হলাম মানুষ আর ব্যাঙের পরিপাকতন্ত্রের মধ্যের ব্যাপক মিল নিজ চোখে দেখে । হূদপিন্ডের গঠন ও কার্যপ্রনালী পড়ে বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম । মানু্ষের হূদপিন্ডর চার প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট আর নিন্মস্তরের স্থলচর প্রানীদের ক্ষেত্রে সেটা দুই প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট, সরীসৃপদের ক্ষেত্রে সেটা মাঝামাঝি ।

তাদের অলিন্দ আর নিলয়ের রক্ত মিশে যায় । এভাবে ক্রমপরিবর্তন দেখে বিবর্তনকে অস্বীকার করা দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ল । জীব জগতের শ্রেণীবিভাগ পড়ে, জীবজগতের বৈচিত্র্য দেখে বিবর্তনবাদের দিকেই যেন ঝুকে পড়লাম, তবে ইমান হারানোর ভযে তখনও মনকে নানারকম উল্টাপাল্টা বুঝ (হয়রান তত্ত্ব) দিয়ে রাখলাম । ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে আই ইউ টি তে ভর্তি হযে চিন্তাভাবনার করার মত অনেক সময় সুযোগ পেয়েছিলাম । খেলাধুলা করতাম না তাই পরীক্ষার সময়টুকু বাদ দিলে বেশিরভাগ সময় গল্পগুজব, হাসি তামাশা আর বাকিটুকু সময় লাইব্রেরীতে কাটাতাম ।

লাইব্রেরীতে আবার "সাইন্টিফিক ইন্ডিকেশন ইন হলি কোরান" টাইপের প্রচুর বই ছিলো । কিন্ত সেগুলার কোনটাতেই যুতসই কিছু পাই নি । ফলাফল ধর্মের প্রতি উদাসীনতা আরো বাড়তে থাকল । হল জীবনে আসার আগে নিজের ফ্যামিলির বাইরে অন্য কাউকে যাচাইয়ের সুযোগও ছিল না । সেখানেই দেখলাম যে নামাজী পোলা সুযোগ পাইলেই নানা নসিহত করত বিশ্ববিদ্যালয ছেড়ে যাওয়ার সময় নিজে ৯-১০ গিগা ডিভিডি রাইট করে নিয়ে গেল ।

শিবির মেন্টালিটি কি জিনিস তাও বুঝলাম । ধর্মের প্রতি প্রবল আস্থাবান অথচ নিজের হার্ডডি্স্ক চাইল্ড পর্নে ভর্তি । তবে সবাই এরকম না । এরা মোটের একটা ক্ষুদ্র অংশ । ওআইসি ফান্ডিংয়ে পরিচালিত হওয়ায় আমাদের ১৮২ ক্রেডিটের ইন্জিনিয়ারিং কোর্সের প্রায় ১২-১৫ ক্রেডিট ছিলো আবার ধর্ম বিষয়ক ।

তার মধ্যে ৩ ক্রেডিটের "মর্ডান সাইন্স এন্ড হলি কোরান" একটা সাবজেক্ট ছিলো । বুয়েটের বিখ্যাত হামিদুর রহমান স্যার নিতেন ক্লাস । বলাবাহুল্য হতাশ হলাম । পুরো কো্র্সটাকে জোড়াতালি দিয়ে ঘোড়াবুঝ দিয়ে সাজানো হাঁসজারু টাইপের কিছু মনে হয়েছিল । স্যারকেও কূপমন্ডুক টাইপের মনে হলো ।

"মর্ডান সাইন্স এন্ড হলি কোরান" পড়াচ্ছেন অথচ যুক্তি নয় যেন বিশ্বাস আর আবেগের চোটে তিনি একাকার । কোর্সের মাঝখানে উনি আবার হজ্জে গেলেন এবং গা বাঁচিয়ে কো্র্সটা শেষ করলেন । পরবর্তিতে আই বি এ তে এসেও এরকম আরেকজনকে পেলাম ,মিজানুর রহমান স্যার, ব্যাপক ধার্মিক, যে সাবজেক্ট নেন তার নাম কোয়ান্টিটেটিভ এনালাইসিস । ওনাকেও আমার সেই একই টাইপের গা বাঁচিয়ে চলা লোক মনে হল । একজন অসাধারন টিচার পেলাম, গেষ্ট ফ্যাকাল্টি ড. এনামূল হক ,আমাদের ইকোনোমিক্স নিতেন।

আমার জীবনের আদর্শ শিক্ষক তিনিই । সারা ক্লাসে যেন জাদুগ্রস্ত মোহময় একটা সময় কাটত । যে কোন বিষযে উনার পারসেপশন অসাধারন ক্লিয়ার । উনি আমাকে প্রভাবিত করেছেন । আমার ধারনা তিনি প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী নন ।

যদিও ধর্ম নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি তবে গেম থিওরি পড়ানোর সময় তার কথাবার্তায় তাকে বিশ্বাসী মনে হয়নি । উনি কিছুটা কৌতুক ছলেই বললেন কেনো ধর্মগুলো মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে নিয়েই সবকিছু সাজিয়েছে । পুরো ইকোনোমিক্স কোর্সে উনি দেখিয়েছেন অনেক কিছুই আমরা যে ভাবে ভাবি প্রকৃত ঘটনা অন্যরকম । একাডেমিক লাইনের বাইরে আরেকজন আমাকে প্রভাবিত করেছে । তিনি হলেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ।

উনিও অজ্ঞেয়বাদী , প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী নন । উনার সাথে কথা , উনার আত্মজীবনীমূলক বইপত্র আমাকে প্রভাবিত করেছে । ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরিতে ঢুকলাম । প্রতিদিন অফিস করে বাসায় ফিরে বইপত্র পড়তাম , ব্লগের সাথে এই সময়েই প্রথম পরিচয় । অফিসে , বাসায় গোগ্রাসে ব্লগ পড়তে থাকলাম ।

ব্লগ আমাকে আমার ধর্মের মোহমুক্তি থেকে মুক্ত হতে ব্যাপক সাহায্য করেছে । যে কয়টা জিনিস আকড়ে ধর্মবিশ্বাস টিকে ছিল ,সেগুলোতেও ধাক্কা লাগলো । দেখলাম যেগুলোকে এতদিন যুক্তি ভেবেছিলাম সেগুলোও আর ধোপে টিকছে না । সামহয়ারইনের পর পরিচিত হলাম মুক্তমনার সাথে । যদিও সেখানকার বেশিরভাগ লেখাই ইসলাম বিদ্বেষী ,কিন্ত জেনুইন লেখাও আছে বেশ কিছু এবং সেগুলোই আমার বিশ্বাসের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিল ।

বির্বতন নিয়ে কিছু ভূল ধারনা ছিল । এনথ্রোপলজির বইপত্র , মুক্তমনার বিবর্তন আর্কাইভ পড়ে সেগুলোও দূরীভূত হলো । এনথ্রোপলজির বইপত্র ঘেটে দেখলাম কবে কোথায় মানুষের খুব কাছাকাছি পূর্বপুরূষ নিয়ানর্ডারথাল, লুসি এদের ফসিল পাওয়া গিয়েছে । পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ানর্ডারথালের হাজারো আবিস্কৃত ফসিল আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে যেন বিবর্তনবাদের সত্যতা জানান দিয়ে গেল । ধার্মিক লোকেরা আসলে স্বার্থপর টাইপের হয় ।

তারা সবসময নিজের ইহকাল , পরকাল নিয়ে চিন্তা করে । সমাজের ভালো চিন্তা করার সময় যেন তাদের নাই । তারা আরেকজনকে ইসলামের দাওয়াত দেয় সেটাও নিজের পরকালের কথা চিন্তা করে , ফকির কে টাকা দেয় নিজের আখিরাতের সঞ্চয় হচ্ছে ভেবে । একটা জিনিস আমাকে বেশ কষ্ট দিত তা হলো ধর্মে নামাজ , রোজার তথা ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ইবাদতের বিশাল গুরুত্ব , অথচ সমাজের কল্যান , মানুষের কল্যানের ব্যাপারগুলো কেমন যেন দায়সারা টাইপের । ধর্ম বিশ্বাসী নন এমন লোক অশিক্ষিত লোকের মাঝে পাওয়া যাবে না , কিন্ত শিক্ষার লেভেল যতটা বাড়তে থাকে অবিশ্বাসের % ও বাড়তে থাকে , এর কারন কি হতে পারে? এটা কি শয়তান নামক এক অদ্ভুদ এনটিটির ধোকা , না কি বিচার বিবেচনাবোধ বাড়ার সাথে সাথে ধর্মীয় কিচ্ছা কাহিনীকে গ্রহন করার অক্ষমতা ? এভাবে যত চিন্তা করি প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মের অসারতা ফুটে উঠে ।

অথচ হওয়ার কথা ছিলো উল্টো, যত চিন্তা করব, ধর্ম তত সত্য হয়ে ধরা দিবে । ধর্ম প্রশ্নকে ভয় পায় ,অথচ সত্যের তো উচিত প্রশ্নকে স্বাগত জানানো । উপায়হীন হয়ে ইমান রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি নিজে কোরানের বাংলা অনুবাদ ঘাটা শুরু করলাম এবং হতাশ হলাম । সবকথাই আমার তখনকার প্রেক্ষাপটে মানুষের লেখা মনে হতে লাগল । ইশ্বরের সব কাজকর্ম মানুষর কাজকর্মের মতো মনে হতে থাকল ।

এক সময় মনে হলো ইশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেননি , মানুষই ইশ্বরকে বানিয়েছে । সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের কাছে সৎ থাকার । যদি মৃত্যুর পর গিয়ে দেখি সত্যি সত্যিই আল্লাহ বলে কেউ আছেন এবং তিনি প্রশ্ন করেন কেন আমাকে বিশ্বাস করোনি ,তাহলে আমার উত্তর হবে "যথেষ্ট প্রমান পাইনি"  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.