তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ও পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস
ফকির ইলিয়াস
========================================
বাংলাদেশে আগামীর রাজনীতির প্রকরণ আবারও বেশ জটিল হয়ে উঠছে। আগামী সংসদ নির্বাচন কীভাবে হবে, তাতে সব রাজনৈতিক দল অংশ নেবে কি-না, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ব্যক্তিগত মতামতে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে না পারলে সর্বশেষ ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের আয়োজন করবে। এর জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম।
আলোচনা সেখানেই থেমে নেই।
একটি রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের আদালত রায় দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ। তবে গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে আরও দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখারও সুপারিশ করা হয়েছে ওই রায়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর মাধ্যমে দেশ একটি অস্থিতিশীলতার দিকে ক্রমেই অগ্রসর হচ্ছে।
বাংলাদেশে কেন, কোন প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি। একটি রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান চরম রূপ লাভ করলে নব্বই সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়।
ওই গণঅভ্যুত্থানের সময় আটদল ও সাতদলীয় জোটের একটি ঐক্যবদ্ধ রূপরেখা ছিল বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। ওই রূপরেখায় খুব স্পষ্ট করে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র সুসংহত করার পক্ষে উভয় জোটই মত প্রকাশ করেছিল। '৯১-এর নির্বাচনে জিতে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। এর প্রায় দুই বছরের মাথায়ই আওয়ামী লীগ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তী সময়ে 'নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের' অধীনে নির্বাচন প্রধান ইস্যুতে পরিণত হয়।
এ সময়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেন, 'পাগল' ও 'শিশু' ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না!
তার এ বক্তব্যের পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করে। রক্তপাত শুরু হয়। এরপরই ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে এককভাবে একটি জাতীয় সংসদ অধিবেশনের আয়োজন করে বিএনপি। ওই অধিবেশনেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ও বিল পাস হয়।
এর ক'সপ্তাহের মধ্যেই ওই সংসদ বাতিল করে দেন রাষ্ট্রপতি। তারপর বিএনপির পাস করে যাওয়া বিলের পরিপ্রেক্ষিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। '৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে।
এখানে যে বিষয়টি মনে রাখা দরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি কিন্তু সেই ফেব্রুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনেরই ফসল। এ সংসদ এবং এর কার্যক্রমও কিন্তু স্বীকার করে নিয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও।
এটা অনুমান করা খুবই সহজ, বর্তমানে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ ব্রুট মেজরিটির কারণে 'সংবিধান সংশোধন', 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি'-এর মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস দেখাচ্ছে। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বিএনপিও সেই ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন সম্পন্ন করে রাতারাতি আইন পাস করেছিল। আওয়ামী লীগ যদিও সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তারপরও বিএনপি তাৎক্ষণিক এর কোন তোয়াক্কাই করেনি। কথাগুলো এ জন্য বলছি, বিএনপি আগামী কোন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে সেই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মতো আবারও নির্বাচন করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে পারে এমন সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়ার কোন কারণ নেই।
এবার আসা যাক আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে, কীভাবে হবে, সে প্রসঙ্গে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি এবং তার সমগোত্রীয় দলগুলো পেশি প্রদর্শন করবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রথমত, তারা সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মানবে না, তা তারা জানিয়ে দিয়েছে এরই মধ্যে। সরকার বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এর প্রতিবাদে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিমানে পদত্যাগ করেছেন আরেকজন সিনিয়র বিচারপতি আবু নঈম মমিনুর রহমান, যা ব্যাপক আলোচনার ঝড় তুলেছে।
আমাদের মনে আছে একই প্রক্রিয়ায় ২০০৬ সালেও চারদলীয় জোট একই রকম পাঁয়তারা করেছিল।
তারা তাদের পছন্দের বিচারপতিদের ছক কষে বিভিন্ন পদে বসিয়েছিল। যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান তাদের মন মতো ব্যক্তিই হতে পারেন। শেষমেশ ওই খেলায় জিততে না পেরে তাদেরই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ঘোষণা করা হয়। এর পরবর্তী পরিস্থিতিতে সামনে চলে আসে জানুয়ারি এগারোর ঘটনাবলি। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসছে, বর্তমান মহাজোটও কি তেমন কোন গহ্বরে পা দিতে যাচ্ছে?
দুই
যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে, তারা পুনরায় ক্ষমতায় আসার জন্য কোন রকম অসাধু পন্থা অবলম্বন করবে, তা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।
অতি সম্প্রতি আমরা ভারতের নির্বাচন দেখলাম। কমিউনিস্টদের দুর্গ বলে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের ধস নেমেছে। পরাজয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পদত্যাগ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রসে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে এবং মমতা ব্যানার্জিই ওই অঞ্চলের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন এটা প্রায় নিশ্চিত। একটি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেটাই হওয়া উচিত।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভ ঘটে ব্রিটিশ ঔপনিবেশবাদের হাত থেকে। বাঙালি জাতিসত্তার গণজাগরণও প্রায় একই সময় থেকে শুরু হয়। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বীজ রোপিত হয়েছিল, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেই স্বপ্ন মহীরুহে রূপ লাভ করে। কিন্তু কথা হচ্ছে, চার দশকেরও বেশি সময়ে বাংলাদেশের মানুষ এবং রাজনীতিকরা পরিশুদ্ধ গণতন্ত্রের ধারক হতে পারলেন না কেন? পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলচালে কেন বারবার প্রতারিত হচ্ছে ৩০ লাখ শহীদের পবিত্র রক্ত?
ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, এ দেশটিকে কেউ মনে-প্রাণে ভালোবাসে না। ওরা সবাই শুধু ভোগ করতে চায়।
তিনি 'ওরা' বলতে রাজনীতিকদেরই বুঝাতে চেয়েছিলেন। এই সত্যটি আমরা এখনো দেখছি প্রতিনিয়ত।
সংবিধান সংশোধনীর সভায় বিএনপি অংশ নেয়নি। তারা অংশ নেবেও না। কারণ তারা জানে, তাদের মতো করেই সংবিধানকে দেখতে চায় তারা।
এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য দলীয় স্বার্থ রক্ষা করা। জাতীয় স্বার্থ অবশ্যই নয়। এই দুঃখজনক পরিস্থিতির উত্তরণ অবশ্যই দরকার কিন্তু প্রধান দুই দল এ বিষয়ে অত্যন্ত সন্দিহান দীর্ঘকাল থেকেই।
দেশে বেশ কিছু রায় নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ফতোয়া দেয়া বৈধ কিন্তু যারা ফতোয়া দেবে তারা তা প্রয়োগ করতে পারবে না।
এমন রায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলে ফতোয়া প্রয়োগ করার জন্য একটি পেটোয়া কিংবা ভাড়াটে বাহিনী যে রেখেছে তা কি সরকার পক্ষ বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন। আমার জানতে খুব ইচ্ছে করছে, এ পর্যন্ত যারা বাংলাদেশে বিভিন্ন ফতোয়ার রায় প্রয়োগ কিংবা বাস্তবায়ন করেছে, এরা কারা? অবৈধভাবে তা করার জন্য এদের বিচার কি বিভিন্ন মেয়াদের সরকারগুলো করতে পেরেছে?
এ রকম বিভিন্ন ইস্যুতেই প্রায় প্রতিটি সরকারের শিকড়ই একই সূত্রে গাঁথা। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিটিও নিজেদের অনুকূলে নেয়ার জন্য প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই কসরত করছে।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার ও প্রধান বিরোধীদল আবারও সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে। কারণ বর্তমান সরকারের সঙ্গে 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' ইস্যুতে বিএনপি ও তাদের সমগোত্রীয় জোট কোন সমঝোতায় না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনাকে কোন মতেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ বিনা কারণে রক্তপাত ঠেকাতে কাউকে তো দাঁড়াতেই হবে।
এর স্পষ্ট প্রমাণ আমরা পেয়েছি প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের বিদায় সংবর্ধনাকে ঘিরে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আয়োজিত বিদায়ী সংবর্ধনায় খায়রুল হক উপস্থিত হননি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা প্রথম ঘটনা।
আইনজীবী সমিতির কর্মকর্তারা বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করে বলেছেন, তারা 'গায়েবানা জানাজা' পড়ছেন। এসব কথাবার্তা এক ধরনের ধৃষ্টতার শামিল। অন্যদিকে রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এসব আইনজীবী কর্তৃক বিচারপতি খায়রুল হক নানাভাবে হেনস্তা হয়েছেন গেল দুই বছরে। তাই বিদায়বেলা আর তাদের দ্বারা নিগৃহীত হতে চাননি বলেই বোধহয় বিদায় সংবর্ধনায় যাননি। বর্তমান আইনজীবী সমিতি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কোন মতেই খায়রুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে দেবে না।
প্রায় ১৮ বছর পর ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। লন্ডনে তিনি এক সমাবেশে বলেছেন, ৩০ মের আগেই তিনি দেশে ফিরবেন। এবং এর পরই দেশব্যাপী গণসংযোগ করবেন। তাদের প্রধান দাবি, 'মিডটার্ম ইলেকশন'-এর লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করবেন তিনি।
বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট এবং অন্য ডানপন্থি দলগুলোর মোর্চা গঠন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কারণ লন্ডনের সমাবেশেই দেখা গেছে চারদলীয় জোট এবং অন্য ডানপন্থি কর্মীরা ছিলেন বেশ সক্রিয়। যুদ্ধাপরাধ কিংবা মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে তাদের পক্ষ নিচ্ছেন না যদিও কিন্তু তাদের পরোক্ষ সমর্থন করছেন, তা দেশবাসীর অজানা নয়।
এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন, আংশিক বিবর্তন, পরিবর্ধন কিছুই মানবে বলে মনে হয় না। কারণ তারা মনে করছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট একটি ফাঁদ পেতে আবার নিজেরাই ক্ষমতায় আসবে। তাই বিএনপি কোনমতেই সে ফাঁদে পা দিতে চাইবে না।
এক্ষেত্রে 'আইনের বিজয় হয়েছে' এমন আপ্তবাক্য তারা যে মানছে না, তা জানিয়েই দিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
প্রকৃত কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দুটি দল একে-অন্যকে মোটেই বিশ্বাস করে না। আর না করার ফসলই হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সবাই সম্মিলিতভাবে যে কাঁটা গলায় বিঁধিয়েছে, তা সম্মিলিতভাবেই উগলে ফেলতে হবে। উভয় পক্ষের সম্মতি ছাড়া যত কথাই বলা হোক না কেন, তা বাংলাদেশে ফলপ্রসূ করা খুবই দুরূহ কাজ।
এতে শুধু রক্তপাতই বাড়বে। আর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিরীহ জনগণ।
নিউইয়র্ক ১৮ মে ২০১১
-------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ/ ঢাকা/ ২০ মে ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত
ছবি- লিন্ডা ক্লমেক্স ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।