মিজানুর রহমান খান, ঠাকুরনগর (পশ্চিমবঙ্গ) থেকে | তারিখ: ১৯-০৫-২০১১ --------
দুই বাংলার শূদ্ররা আজ আনন্দিত ও গর্বিত। তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। অন্তত ১৩ জন শূদ্র (অধুনা ‘মতুয়া’ ধর্মে দীক্ষিত) বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবার, যা একটি রেকর্ড। একসময় অবহেলিত ও লাঞ্ছিত-বঞ্চিত শূদ্রদের সমাজে মর্যাদার আসনে বসাতে মমতা অনেক কিছু করেছেন। ৪০০ বছর আগে ফরিদপুরের ওড়াকান্দি থেকে যে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু হয়েছিল, মমতার কারণে তা একটি বড় মাইলফলক পেরোল।
পশ্চিমবঙ্গে সদ্য অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪ আসনের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০টির ফলে কম-বেশি প্রভাব ফেলেছে শূদ্ররা। উল্লেখ্য, হিন্দুসমাজের বর্ণপ্রথার সর্বশেষ ধাপে শূদ্রদের অবস্থান।
দুই বাংলার শূদ্রদের বিষয়ে বিশিষ্ট ভারতীয় গবেষক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই বাংলার ইতিহাসে এই ঘটনা অসাধারণ ও ঐতিহাসিক। ’
একদা ফরিদপুরের অন্তর্গত ওড়াকান্দিতে (বর্তমানে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানাধীন) আজ থেকে চার শতাব্দী আগে জাতপাতের ব্যবধান ঘুচিয়ে শূদ্রদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক আন্দোলনের সূচনা হয়।
সেখানেই পরবর্তী সময়ে ‘মতুয়া’ ধর্ম প্রবর্তন এবং শূদ্রদের মধ্যে তা গ্রহণের চল শুরু হয়।
এর পেছনে রয়েছে গল্পের মতোই এক কাহিনি।
৪০০ বছর আগের কিংবদন্তি। উত্তর প্রদেশের মৈথিলী ব্রাহ্মণ চন্দ্রমোহন ঠাকুর বেড়াতে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে। ওড়াকান্দিতে এলে তাঁর সঙ্গে সেখানকার এক শূদ্র পরিবারের মেয়ে রাজলক্ষ্মী দেবীর প্রেম হয়। তাঁরা বিয়েও করেন।
এ জন্য সমাজপতিদের রোষানলে পড়েন চন্দ্রমোহন ঠাকুর। তবে তিনি না দমে পূর্ববঙ্গের শূদ্রদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূচনা ঘটান।
এই চন্দ্রমোহনেরই উত্তরপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তন করেন মতুয়া ধর্ম। তাঁর বংশধর ও অনুসারীরা এখন দুই বাংলায় ছড়িয়ে।
বাংলাদেশে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখেরও বেশি।
তাঁদের নেতারা বলেছেন, তৃণমূলের প্রতি তাঁদের নৈতিক সমর্থন ছিল। কারণ দলটির প্রধান মমতা মতুয়া ধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি নিজে এ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। নেতারা বলেন, তাঁরা মমতাকে ওড়াকান্দিতে দেখার অপেক্ষা করছেন। লোকসভায় তৃণমূলের সাংসদ গোবিন্দ চন্দ্র নস্কর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মমতা ওড়াকান্দির কথা জানেন।
তাঁর সেখানে যেতে অত্যন্ত আগ্রহ হওয়ারই কথা। ’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডানহাত বলে পরিচিত তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি মুকুল রায়ও মতুয়া ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। প্রসঙ্গত, মতুয়া ধর্মে দীক্ষা নিতে প্রথাগত ধর্মান্তরের দরকার নেই।
যশোরের বেনাপোল থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা থেকে নয়জন ও পাশের নদীয়া থেকে অন্তত তিনজন মতুয়া বিধায়ক হয়েছেন। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে এ রকম কোনো দৃষ্টান্ত নেই।
এ ছাড়া বামদের মতুয়া প্রার্থী হরিপদ বিশ্বাস হেরে গেছেন। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের টিকিটে কোনো মতুয়া জয়ী হননি। গবেষক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডেপুটি ডিন। কলকাতা থেকে গতকাল টেলিফোন করে মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন। ১৯৪৬ সালের বিধানসভায় পূর্ববঙ্গীয় মতুয়াদের একটা উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল।
মাঝখানের ৫০-৬০ বছর খালি ছিল। ’
দুই বাংলার মতুয়াদের অবিসংবাদিত ধর্মীয় নেতা হলেন ‘বড়মা’ বীণাপাণি দেবী। তাঁর ছোট ছেলে মঞ্জিল কৃষ্ণ ঠাকুর এবার বিধায়ক হয়েছেন। রাজ্যভবনের শপথ অনুষ্ঠানে ৯৩ বছর বয়স্ক বড়মাও আমন্ত্রিত। অনেকে বলেন, হবু মুখ্যমন্ত্রী মমতার ‘বিজয়লক্ষ্মী নারী’ ফরিদপুরের বীণাপাণি দেবী।
দেশ ভাগের অল্প আগে ওড়াকান্দির বাড়ি ছেড়ে স্বামী প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের (পিআর ঠাকুর) হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগরে আসেন বড়মা বীণাপাণি দেবী। ব্যারিস্টার পিআর ঠাকুর অবিভক্ত বাংলায় ফরিদপুর এলাকা থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন। বিধান রায়ের আমলে তিনি রাষ্ট্রমন্ত্রীও হন। কলকাতা থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঠাকুরনগরের নাম তাঁর নামেই।
বড়মার মতো বাংলাদেশি মতুয়াদের ছিলেন ছোটমা।
ওড়াকান্দিতে ২০০৬ সালে ছোটমা মঞ্জুলিকা ঠাকুর মারা যান। তাঁরা দুজন সম্পর্কে জা। জানা গেছে, প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে ঠাকুরনগরে প্রায় ৩০ লাখ ও ওড়াকান্দিতে প্রায় ১৫ লাখ লোকের সমাগম হয়।
বাংলাদেশের মতুয়া নেতারা মনে করেন, মমতা এখন তাঁদেরও নেত্রী। গতকাল কাশিয়ানী থেকে ফোনে প্রথম আলোর কাছে প্রতিক্রিয়া জানান কয়েকজন মতুয়া নেতা।
মঞ্জিলের ভাইপো সুব্রত ঠাকুর এখন কাশিয়ানী উপজেলার চেয়ারম্যান। তাঁর বাবা প্রভাস চন্দ্র বাংলাদেশ মতুয়া মহাসংঘের মহাসচিব। এঁদের দুজন এবং ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত বিধায়ক সচিপতি ঠাকুররের (৮০) সঙ্গে গতকাল কথা হয়। প্রথম আলোকে তাঁরা বলেন, ‘মমতার বিজয়ে আমরা গর্বিত ও আশান্বিত। এ জয় মমতার জয়, মতুয়াদের জয়, মর্যাদাহারা মানুষের জয়।
’
নমশূদ্র আন্দোলন বইয়ের লেখক অধ্যাপক শেখর মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এটা দারুণ চমকপ্রদ ঘটনা। ধর্মের ব্যাপার থাকায় বামেরা কখনো তফসিলি সম্প্রদায়কে সংগঠিত করেনি। মমতা কমিউনিস্ট নন। তাই তিনি সহজে মতুয়া ধর্ম গ্রহণ করেন।
তবে সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ সুরজিত দাশগুপ্ত বলেন, ‘এখানে আধুনিক ও সনাতনী মতের দ্বন্দ্ব আছে।
এটা ইতিবাচক নয়। সমাজ এর ফলে অতীতমুখী হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও এটা গরিবের ক্ষমতায়ন নয়। ’
ঠাকুরনগর ঘুরে মতুয়াদের নানা রকম উল্লেখযোগ্য স্থাপনা দেখা গেল। এর মধ্যে রয়েছে শানবাঁধানো কামনা সাগর (মতুয়াদের বিশ্বাস, এখানে স্নান করলে পাপমুক্তি হয়), মার্বেল পাথরের মন্দির।
রেলস্টেশন থেকে মন্দির পর্যন্ত সংযোগ সড়ক তৈরি করা হয়েছে। বড়মার কাছে মমতা প্রসঙ্গে মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মমতা মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, এটা খুবই ভালো। আমাদের উন্নতির জন্য তিনি অনেক করেছেন। উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের আগে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিত। ওরা (তীর্থযাত্রী) বলত, “ট্রেনে আমাদের উঠতে দেয় না।
” এই অন্যায়ের অবসান ঘটেছে। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।