বলার মত কিছু নাই ....
দৃশ্যপট ১ :
বেশ ক'বছর আগের ঘটনা -
মাত্র কিছুক্ষণ আগেই সকাল হয়েছে | কিন্তু রোদের অসহনীয় তীব্রতা দেখে সে কথা বোঝার উপায় নেই | ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চার-পাঁচ বছরের ছোট্ট একটি ছেলে তাকিয়ে আছে দূরে- ছেলেটির
মন কিছুটা খারাপ | আজ তাকে প্রথম বারের মত স্কুলে যেতে হবে | কিন্তু সে এটা চাইছে না |তার মধ্যে একটা ভয় লাগা কাজ করছে | এর মূল কারণ -কয়েকদিন আগেই সে তার বন্ধুর কাছে শুনেছে স্কুল নাকি ভালো জায়গা না - ওখানে গেলেই শুধু বই পড়তে হবে , খেলতেও দিবে না , আর
পড়া না পারলে টিচারদের মার তো আছেই | সব মিলিয়েই স্কুলে পা রাখার প্রথম দিনটিতেই স্কুলে না যেতে চাওয়ার একটি তীব্র বাসনা তৈরী হয়ে গিয়েছিল তার মনে | যাই হোক - দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সে দেখল -তার মা এগিয়ে আসছে | মা এসে পৌঁছানোর আগেই ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে মা-কে জড়িয়ে ধরল | তারপর কিছুটা ভয় মনে নিয়েই বলে ফেলল - "মা ,আমি স্কুলে যাব না " | মা তো অবাক , এ আবার কী কথা ! মা এরপর নানা ভাবে -ছলে বলে,কৌশলে বোঝাতে চাইলেন ছেলেকে যে স্কুল এর চেয়ে সুখকর জায়গা আর কোথাও নেই | কিন্তু ,ছেলে অনড় - কোনো ভাবেই সে স্কুলে গিয়ে টিচার এর মার খেতে রাজি নয় | অগত্যা ,ডাক পড়ল বাবার | গম্ভীর মুখ নিয়ে ছেলের সামনে হাজির হলেন বাবা |
আরেকটি কথা বলে নেয়া ভালো - একমাত্র বাবা নামক ব্যক্তিটিকেই এই ছোট্ট ছেলেটি সবচেয়ে বেশি ভয় করে | তারপরও যেভাবেই হোক ছেলেটি তার বাবার কথাও আজ শুনতে নারাজ - স্কুলে সে কোনমতেই যাবে না |
অতঃপর কি আর করা ,"সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠিলে তাহা বাঁকাইতেই হয় "......
এর কিছু সময় পর (মাঝের সময়টাতে কি ঘটেছিল -পাঠক অনুমান করে নিন ), দেখা গেল -ফুটফুটে একটি ছেলে সদ্য বানানো ইউনিফর্ম গায়ে চাপিয়ে ,কাঁধে স্কুল ব্যাগ ( যেটা কোনো মতেই তার শরীরের সাথে খাপ খাচ্ছেনা ) নিয়ে বাবার হাত ধরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে !
ঘটনা এখানেই শেষ মনে হলেও -'ইহা শেষ নহে -কেবল শুরু '| ঘর থেকে শান্ত ভাবে বের হলেও , সিঁড়ি পেরোনো মাত্রই ছেলেটি আবার তারস্বরে কান্না জুড়ে দেয় | চিত্কার করতে করতে সে তার মা কে ডাকতে থাকে | কিন্তু বাবা যে অনড় | কিছুতেই ছেলেকে ছাড়বেন না আজকে | অতঃপর একটি ট্রাজিক মুহুর্তের অবতারনা | বাড়ির তিনতলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে মা কিছুটা শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন -
আর বাবা ছেলেটিকে কিছুটা উত্তম - মধ্যম প্রদানের পর টেনে হিঁচড়ে রিকসায় তুলছেন | তখনও ছেলেটির চোখে অশ্রু |
এর খানিকক্ষণ পর দেখা গেল -ছেলেটি ক্লাসরুমে বসে আছে -আরো অনেকগুলো ফুটফুটে ছেলেমেয়ের ভীড়ে -আর কয়েক মুহূর্ত পর পর বাইরে তাকাচ্ছে -যেখানে তার বাবা তখনও দাঁড়িয়ে আছেন |
আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হতে শুরু করলো | কদিন আগেই যে ছেলেটি স্কুলে যেতে চাইতো না - সে আজকাল তার নতুন স্কুল ব্যাগটি বালিশের পাশে রেখে ঘুমাতে যায় |
দৃশ্যপট ২ :
এর কয়েকবছর পরের ঘটনা | ক্লাসরুম - চারিদিকে শুনশান নীরবতা , ক্লাস চলছে | স্যার মনোযোগ দিয়ে তার ছাত্রদের পড়া ধরছেন | পড়া বলতে না পারার অপরাধে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন ছাত্রকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছে বেন্চ এর উপর -এদের মাঝে আমাদের গল্পের ছেলেটিও আছে |
আমাদের গল্পের ছেলেটি এখন নিয়মিত স্কুলে যায় , যেতে না চাইলেও আজকাল যেতে হয় | প্রায়ই পড়া না পারা কিংবা স্কুল পালানোর মত ছোট্ট (!)অপরাধে তাকে বেন্চ এর উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ; কখনো কখনো সাথে যোগ হয় হালকা মাত্রার প্রহার | বেন্চ এর উপর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই তার মনে পড়ে- স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিনের ঘটনাগুলো |তার খুব রাগ হয় -আবারও কেঁদে ফেলে ছেলেটি | সে কখনই স্কুলে আসতে চায়নি - কখনো না |
দৃশ্যপট ৩ :
এসব ঘটনা পেরিয়ে গেছে অনেক দিন হলো | সেদিনকার সেই ছোট্ট ছেলেটি এখন ভার্সিটি তে পড়ে |
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে এলেও এখনো তাকে প্রতিদিন নিয়ম করে ক্লাসে যেতে হয় | কিন্তু এখন আর কেউ আগের মত করে পড়া ধরে না-বকে না,শাস্তি দেয় না; ইদানীং এই ব্যাপারগুলো সে অনেক মিস করে | ক্লাস পালিয়ে আড্ডা দেয়ার মুহুর্তগুলো-কিংবা ক্লাসরুমে ছোঁয়াছুঁই খেলা -অযথাই দৌড়াদৌড়ি করার মুহুর্তগুলো ছেলেটির চোখের পাতা ভারী করে তোলে | কোনো এক গরমের দুপুরে ঘামে ভেজা শরীরে বাসায় বসেও তার মন চলে যায় শৈশবের সেইসব সকাল-দুপুর-কিংবা বিকেলগুলোতে |
মনের অজান্তেই তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে-এবার আবারও কেঁদে ফেলে সে-
ঘটনাটি আগের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হতে পারত |
কিন্তু না - এখন ছেলেটির স্কুলে যেতে খুব ইচ্ছে করে |
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।