আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নৈতিক অধঃপতন ॥ কতটা গভীর?

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।

১৯৬০ সালে জনএফ কেনেডি যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন তখন আমেরিকার গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবে:“ঠিক এ মুহূর্তে যে শিশুটি এ ভূখন্ডে ভূমিষ্ঠ হলো সে হতে পারে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। ” প্রকৃতপক্ষে খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে গ্রিকরা যে গণতন্ত্রের ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন সেটার মূল বক্তব্যই ছিল এটা এবং যেটা প্রজাতন্ত্র ধারণার মূল উপপাদ্য। একমাত্র রাজতন্ত্রেই বহু সময় আগেই রাজ্যের প্রজারা জানতে পারেন কে হবেন তাদের পরবর্তী রাজা বা রানী। অবশ্য এ ধরনের রাজতন্ত্রের রাজ্যের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে।

বিশেষ করে ইউরোপে এবং এ সমস্ত রাজ্যেও রাজা বা রানীরা এখন আর শাসন করেন না, তারা শুধু সিংহাসন অলঙ্কৃত করেন। নির্বাচিত সংসদ, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভা আইন প্রণয়ন এবং দেশ পরিচালনা করেন। যদিও পারিবারিক উত্তরাধিকার কমবেশি সব দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব ফেলে, কিন্তু বর্তমান সময়ে শুধু দুটো দেশের মানুষই সুনিশ্চিভাবে জানতেন-কে হবেন তাদের রাষ্ট্রের পরবর্তী কর্ণধার। আর সে দুটো হলো: কোরিয়ান ‘গণতান্ত্রিক’ প্রজাতন্ত্র এবং ‘গণতান্ত্রিক’ সিরিয়ান আরব প্রজাতন্ত্র। এটা বোধকরি বলার প্রয়োজন নেই, ঐ দুই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নাগরিকরা কি ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছেন।

সবেমাত্র ঐ দুই ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নামও সংযোজিত হলো গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর নাম অতি গর্বের সঙ্গে ঘোষণার মধ্য দিয়ে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (যদিও এ ধরনের কোন পদ বিএনপির ঘোষণাপত্রে নেই), যিনি তার সমালোচকদের কাছে ‘দুর্নীতির বরপুত্র’ হিসেবে অভিহিত, তার বিরোধীদের কিছু সমালোচনার জবাবে এক হুঁশিয়ারিতে ঐ দলের এক মুখপাত্র বললেন, “তারেক রহমানের সম্পর্কে সাবধানে কথা বলবেন, তিনি বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। ” বিএনপি মুখপাত্রের হুঁশিয়ারিতে দুটো বক্তব্য রয়েছে: প্রথমটা হলো, এটা দৃঢ়প্রত্যয়ে বলা হলো কোন্ দল আগামী নির্বাচনে জয়ী হবে এবং সে প্রেক্ষিতে দলীয়প্রধান নয়, তার ছেলেই হবেন প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয়ত যেহেতু তিনি হবেন প্রধানমন্ত্রী সেহেতু তিনি থাকবেন সমস্ত সমালোচনার উর্ধে, যেমনভাবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজারা তাদের প্রজাদের সমালোচনার সম্পূর্ণ উর্ধে। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করেন তাদের প্রায় সবাই কমবেশি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বা সমালোচিত হন।

অবশ্য তারেক রহমানের রয়েছে বিবিধ পরিচয়, দুর্নীতিবাজ থেকে সন্ত্রাসী। এমন কোন ধরনের অপরাধ নেই যার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না- তা সে একুশে আগস্টের হত্যাযজ্ঞ বা দশট্রাক অস্ত্রপাচার যেটাই হোক না কেন। তিনি এক বিরল সৌভাগ্যের (!) অধিকারী যিনি দাউদ ইব্রাহীমের মতন অপরাধীদের গুরুর সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তারই বিরুদ্ধে মামলাই বাংলাদেশের আদালতে একমাত্র মামলা যেটায় ২০ কোটি ৪১ লাখ টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করার সে মামলায় আমেরিকা থেকে খোদ এফবিআইএর প্রতিনিধি ঢাকাতে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ডেবরা ল্যাপরেভোট নামের সুপারভাইজার মর্যাদার এই বিশেষ এফবিআই প্রতিনিধি ঢাকার আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা দিয়েছেনÑকিভাবে তিনি তারেক এবং তার বন্ধু মামুনের পাচারের টাকার সন্ধান এবং এর স্থানান্তর মনিটর করেছেন এবং এটা পরিশেষে কিভাবে তাদের সিঙ্গাপুরের এ্যাকাউন্টে জমা হলো।

যে আমেরিকার নেতাদের উদ্দেশ করে তার মা ওয়াশিংটন টাইমসে নিবন্ধ লিখেছিলেন (যেটা অবশ্য দীর্ঘ ৬ মাস পর তিনি লেখেননি বলে অস্বীকার করলেন) বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়ে (যেখানে তিনি জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের হুমকি দেয়ার আহ্বানও জানিয়েছিলেন) সেই আমেরিকা তারেক রহমানকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখছে? ঢাকাস্থ আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় তারেক রহমানকে, লোভ-লালসা-চোরামি আর দুর্নীতিবান সরকারের এবং হিংস্র রাজনীতির’ প্রতিবিম্ব হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং তাকে যেন যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার অনুমতি না দেয়া হয় সে সুপারিশ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বিশ্বাস করেÑ তারেক রহমান ‘কুখ্যাত রাজনৈতিক দুর্র্নীতির দোষে’ দোষী এবং এ ব্যাপারে দূতাবাস তারেকের কিছু বড় ধরনের দুর্নীতির বিবরণ ঐ তারবার্তায় তুলে ধরেন। উপরোক্ত তারবার্তা প্রেরণের ৬ মাস পর ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে আর একটি তারবার্তা পাঠান। ঐ তারবার্তায় বলা হয়, স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণার আওতায় তারেক রহমানের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করছে। ঐ বার্তায় বলা হয়, তার অপকর্ম সরকারের প্রতি জনগণের আস্থাকে দুর্বল করেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থায়িত্বকে খর্ব করেছে।

তার কোটি কোটি ডলারের চুরি এ মধ্যপন্থী মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থায়িত্ব এবং ভিতকে দুর্বল করেছে এবং যার প্রেক্ষিতে এ দেশে একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যয় ও প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। উইকিলিকসের প্রকাশিত এক বিবরণীতে বলা হয়, ‘হাওয়া ভবন’ নামে এক ‘ছায়া সরকার’ তিনি চালিয়েছেন, বিশেষ করে সরকারী নিয়োগ এবং কনট্রাক্ট দেয়ার ব্যাপারে ঐ ভবনের কথাই ছিল শেষ কথা। উইকিলিকসের বিবরণীতে আরও বলা হয়, ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে গঠিত ৬০ জনের মন্ত্রিসভার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তিনিই বিক্রি করেছিলেন। তিনি নৃশংস, সীমাহীন দুর্নীতিবাজ, রাজনীতিতে এবং ব্যবসায় অনভিজ্ঞ, অশিক্ষিত, বাস্তব জ্ঞান বিবর্জিত এবং অমানবিক। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামালউদ্দিন উদ্দিন সিদ্দিকী তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি টমাসকে বলেছিলেন, খালেদার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ব্যর্থতা ছিল তার দুর্নীতিবাজ পুত্র তারেক রহমানকে রক্ষা করা।

প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে ব্যর্থতা তার দুর্নীতির রাজত্ব কায়েমে তার পুত্রকে প্রশ্রয় দেয়া এবং রক্ষা করা। তারেক রহমান পুনরায় সংবাদপত্রের শিরোনাম হন যখন ঢাকার একটি আদালত দুদকের অনুরোধে তার বিরদ্ধে যে দু’ডজনের মতো মামলা হয় রজু হয়েেেছ বা বিচার চলছে তার একটিতে কোর্টে হাজির হওয়ার জন্য ওয়ারেন্ট ইস্যুর মাধ্যমে। তার দলীয় কর্মীরা সঙ্গে সঙ্গে এ ওয়ারেন্ট ইস্যুর জবাব দেন দেশব্যাপী রাস্তায় পার্ক করা সাধারণ গাড়ি মালিকদের গাড়ি ভাঙ্গা এবং পোড়ানোর মধ্য দিয়ে (যেটা আমি স্যাটেলাইট টিভির বদৌলতে কানাডায় আমার ড্রয়িংরুমে বসেও দেখতে পাচ্ছিলাম); যদিও তারেক রহমান জেলে জেলের বাইরে থাকুন, সেটা নিয়ে ঐ সমস্ত গাড়ি মালিকদের কোন মাথা ব্যথা নেই। যেটা আমার কাছে সবচেয়ে বড় নৈতিক অধঃপতন বলে মনে হয়েছে, সেটা হলো ‘নির্দোষ’ তারেক রহমানের পক্ষে ‘জাতীয়তাবাদী’ বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক এবং অধ্যাপকরা হয় রাস্তায় নামলেন বা বিবৃতি দিলেন এই ‘নির্দোষ’ রাজনীতিবিদকে এবং দেশের ‘ভাবী প্রধানমন্ত্রীকে’ সম্পূর্ণ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ হয়রানি করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে। একজন প্রাক্তন চীনপন্থী চরম বামপন্থী বুদ্বিজীবী, বিধাতার অস্তিত্বে যার কোনদিনও কোন বিশ্বাস ছিল বলে আমার জানা নেই, কয়েক বছর আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছেলে যখন আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন তখন আমাকে টেলিফোন করেছিলেন আমার মতামত জানতে চেয়ে এতে কি আওয়ামী লীগ বিএনপির তুলনায় যে নৈতিক উচ্চ অবস্থানে রয়েছে সেটার অবসান ঘটবে কিনা? তিনি আমার জবাবে খুশি হননি যখন আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নৈতিকতা কোন ধর্তব্যের বিষয় নয়।

একই বুদ্ধিজীবী গণজাগরণ মঞ্চের ‘নাস্তিকদের’ বিরুদ্ধে তার নিরলস প্রচার এবং বিষোদগারের কারণে ইতোমধ্যে ‘প্রখ্যাত বুদ্বিজীবী’তে পরিণত হয়েছেন এবং তিনি তার ‘সাহসী সম্পাদক’ বন্ধুর সঙ্গে এক সেমিনারে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সব ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ দায়ের করা মামলা ‘নিঃশর্ত প্রত্যাহার’ দাবি জানিয়ে বক্তব্য দিলেন। ‘জাতীয়তাবাদী’ চিকিৎসকরা হাসপাতাল ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসলেন তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে। আমি ভাবছি এ সমস্ত ‘জাতীয়তাবাদী’ চিকিৎসকদের ‘অজাতীয়তাবাদী’ রুগীসমূহ কতটুকু আশান্বিত বোধ করেন তাদের জীবনের দায় ঐ সমস্ত চিকিৎসকদের হাতে সমর্পণ করতে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা একযোগে বিবৃতি দিলেন এই ‘নিরপরাধ’ রাজনীতিক এবং দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রীকে বিনা কারণে হয়রানি করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে। নিজে একজন অধ্যাপক হয়ে এটা আমার কাছে দুর্বোধ্য লাগছে এই ভেবে যে, এ সমস্ত অধ্যাপক এ রকম একজন অধঃপতিত ব্যক্তির স্বপক্ষে বিবৃতি দিয়ে কোন্ নৈতিকতার বলে নিজেদের ছাত্রছাত্রী বা নিজেদের সন্তানদের সামনে দাঁড়িয়ে নৈতিকতা সম্পর্কে বক্তৃতা দেন, যেটা কিনা বিশেষ করে শিক্ষকতা পেশার মূল স্তম্ভ।

আমি নিজে আমার বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীদের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক সময় অস্বস্তি অনুভব করি এই ভেবে যে, আমার ছাত্রছাত্রীরা যদি আমার লেখা কলাম পড়ে থাকে, যার প্রায় সবগুলোতেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমার অবিকম্পিত গভীর অনুরক্তি প্রকাশ পেয়েছে, তারা যদি তার সঙ্গে একমত পোষণ না করে! ইদানীং ঘটে যাওয়া পাঁচটি সিটি নির্বাচনের ফল আবারও প্রমাণ করল যে, এ ভূখ-ের রাজনৈতিক অঙ্গনে সফলতা লাভে দুর্র্নীতি বা নৈতিক অবক্ষয় কোন বিচার্য বিষয় নয়। একথা ভেবে আমাদেরকে সে অভিশপ্ত দিনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বোধ করি কোন উপায় নেই যেদিন দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করতে গিয়ে আমাদের মুখে সে নিদারুণ অপমানের ছায়া ভেসে উঠবেঠিক যেমনভাবে আমাদের পাকিস্তানী বন্ধুদের অবয়বে অপমানের ছায়া ভেসে ওঠে তাদের দেশের প্রেসিডেন্টের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে, যদিও তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত। লেখক : কানাডা প্রবাসী, অধ্যাপক Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.