মিথ্যার অপচয় বোধ হয় ভালো নয়। আর একাধিক সত্যও একত্রিত হওয়াটাও বিপজ্জনক। এ অবস্থায় সত্য মিথ্যার গতি প্রকৃতি মাছির মতো প্রতিক্রিয়াশীল। কথার ম্যাকানিজমটা হচ্ছে ফুসফুস তাড়িত বাতাস। যা থেকে সত্য কথা কিংবা মিথ্যা কথার সৃষ্টি।
মিথ্যার অনিবার্যতার কারণ কী? অকারণ? নাকি সঙ্গত কারণেই মিথ্যার বাতাস বহে পৃথিবীতে। এবার একটু মিথ্যা নিয়ে মজা করা যেতে পারে। আর এজন্য তাকাতে হবে পেছনে। মূলত মানুষের বিশ্বাসের বস্তুটিই কি সত্য? আর অবিশ্বাসের বস্তুটিই কি মিথ্যা? এ কথার ফাঁকে যে কথা বলা যাবে না, তা কিন্তু নয়। তবে মিথ্যার একটা ভয়াবহ শক্তি আছে।
মিথ্যা সংক্রামকও বটে। মিথ্যাকেও বাঁচতে হয় সত্যকে আশ্রয় করেই। এসব কথার বিন্দুমাত্র আপেকিতা নেই বরং একটা অন্যরকম প্রেতি আছে। দেখা যাক প্রেতিটা কী? মোটাদাগে নয় পেন্সিলের সাহায্য নিয়েই বলছি, ছোটবেলায় মিথ্যা বলে সহজেই পুরস্কার পেয়েছিলাম। এই পুরস্কার অবশ্য নিজের কাছে নিজের।
মিথ্যাগুলো যথারীতি বিস্ময় সৃষ্টি করতো। আর নিমিষেই অসম্ভবগুলো সম্ভব হয়ে উঠতো। ওই সময়ে মিথ্যার অপচয় করে যে আনন্দ পেতাম সত্য কথা বলে তা পেতাম না। দু’একটি সত্য কথা বলার সাহস জুটলেও পান্তরে সত্য বলার সাজা হিসাবে পেতাম আঘাত। একবার মামার টেবিল ঘড়ি ভেঙে গেল, ঘরে তো আর কেউ ছিল না আমি আর বেড়াল।
ইচ্ছা করলে বেড়ালের ওপর দোষ চাপাতে পারতাম। কিন্তু সাহস করে নিজের ঘাড়ে দোষটা নিলাম। মামা তো আর বুঝলো না যে ইচ্ছা করলে আমি দোষটা বেড়ালের ওপর চাপাতে পারতাম। ফলে আঘাত আর অপো করলো না। সত্য সক্রিয় হয়ে উঠলো।
এইযে সত্যটি বলেছিলাম তাতে কিন্তু শৈশবে আমার উপকার হয়নি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে বেড়ালেরা মানুষের ওপর কোনো দোষ চাপায় কি-না? যাই হোক, প্রকৃত মিথ্যা কথা বলতে কিছু নেই। আর প্রকৃত মিথ্যা কথা কেহ বলতে পারে বলে আমার জানা নেই। লুকানো, গোপন করা, মধুর ভণ্ডামিতা, চুরি এসব মিথ্যার অন্যতম মাধ্যম বটে। কিন্তু প্রকৃত মিথ্যা নয়।
তাহলে প্রকৃত মিথ্যা কি? প্রকৃত সত্যই বা কি? চেতনার ভেতর অবচেতনিক অনুসন্ধানে হয়তো প্রকৃত সত্য মিথ্যার দেখা মিলতে পারে।
একজন মানুষের জীবদ্দশার ইতিহাসই তার পৃথিবীর ইতিহাস। আর শৈশবই ঘটে মানুষের অবচেতনিক যুগ। যেহেতু শৈশব জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে একটা পূর্ণ বয়স্ক জীবন। ফলে শৈশব আমলের অবচৈতনিক চিন্তার সকল পরিার ফলালফ শূন্য।
একটু গভীরভাবে যদি চিন্তা করি তবে ব্যাপারটা স্পষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। পুত্রের শৈশব জীবন কখনো উদ্ধার করা যায় না পিতার পূর্ণবয়স্ক জীবন দিয়ে। অনুরূপভাবে পুত্রের শৈশব জীবন উদ্ধার করা সম্ভব হয় না পিতার পূর্ণ বয়স্ক জীবন দিয়ে। সেই ছোটবেলাকার কথা, আমাদের গ্রামে এই নিয়ে সেই নিয়ে হট্টগোল হতো। বিল নিয়ে, চর নিয়ে, হাট নিয়ে মারামারি, খুন হতো প্রায় প্রায়।
একবার কাকে যেন কে মারলো, সেই নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল জানি না। শুধু এটুকুই মনে আছে আদালতে মিথ্যা সািক্ষ দিয়ে একজনের বেল কেটে জেল হয়েছিল। ছোটবেলাকার কথা বেল কাটা বুঝতাম না। কিন্তু জেল মানে লোহার খাঁজায় বন্দি এটুকু ভালোভাবে বুঝতাম। চোর পুলিশ খেলতে খেলতে শিখেছিলাম এসব।
ছোটবেলায় আমাদের সাথে খেলতে এসে দারোগার ছেলে চোর হলো। ধুলার কারাগারে যখন সে বন্দি থাকে হায়রে তার কান্না? তাকে যেন মুক্তি পেতেই হবে। নইলে যে তার আর মান থাকে না। কিন্তু চোর পুলিশ খেলার ধর্মে সন্ধ্যা না হলে ছাড়া পাওয়া যায় না। ছোটবেলাকার সেই বন্ধুটি ঠিকই খেলার ধর্ম পালন করতো, ধুলা দিয়ে ঘেরা ঘরে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসেই থাকতো।
কারণ সে জানতো সে চোর হয়েছে। যাইহোক যে লোকটির বেল কেটে জেল হলো তার অপরাধ ছিল মিথ্যা সাক্ষি দেওয়া। আমরা শুনে খুব হেসেছিলাম তখন। এ আবার কেমন মিথ্যা। আমরা কত মিথ্যা কথা বলছি আর লোকটি কি না জেলে? আমাদের আফাজ স্যার অংকের খাতা জমা পায়নি বলে বেত হাতে বাঘের মতো আচরণ করতেন।
তখন আমরা চমৎকার মিথ্যা কথা বলে রেহায় পেতাম। বলতাম জ্বর হয়েছিল। জ্বরকে মিথ্যা কথা বলতাম আমরা। বাঘকে মিথ্যা কথা বলতাম। বাবার সঙ্গে চিড়িয়াখানা গিয়ে গোপনে গোপনে বন্দি প্রাণীগুলোকে কতো যে মিথ্যা কথা বলে এসেছিলাম বাবা টেরই পায়নি।
ছোটবেলাকার মিথ্যাগুলোকে কোনোদিন ভোলা যায় না। কিন্তু বড়বেলাকার মিথ্যাগুলোকে কেন আমরা মনে রাখতে চাই না, একটু চিন্তা করার আগ্রহ পোষণ করি।
ধরা যাক, মানুষ বেঁচে আছে এ কথাটি ধ্রুব সত্য। ভালো কথা, কিন্তু মানুষ মারা যায় একথাটিও তো সত্য। তাহলে সত্য-মিথ্যার মীমাংসা কোথায়? মানুষের বেঁচে আছে কথাটি কি তবে মিথ্যা? নইলে মানুষ মরে কেন।
নাকি সত্যর একটা বয়স আছে, মানুষের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সত্যও বড় হয়। মানুষ যখন বেঁচে থাকবে তখন সত্য, আর মরলেই সেই সত্যের মৃত্যু! প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান এখানেও হয়তো বৃথা গেল। মানুষের বেঁচে আছে এ সত্যের চিরসত্য বা প্রকৃত সত্য মানুষ কখনো মরবে না। কিন্তু যেহেতু মানুষ মরণশীল সেহেতু সত্যগুলো নির্বিচারে মিথ্যায় রূপান্তর হবে। এই সূত্র ধরে ঘটা করে একটা গল্প করা যেতে পারে।
সঞ্চয়কে আমরা সঞ্জু বলেই ডাকতাম। আমাদের কুয়াশার আড্ডা এখন রণা’র চায়ের দোকান। সেই আড্ডায় বা দোকানে সঞ্জু চা বানাতো। রণার দোকানের একেবারে পেছনের কর্ণারটা আমাদের কুয়াশার আড্ডা। সঞ্জু ওটাকে ফোর কর্নার বলতো।
আমরা গান কবিতা করতাম। সঞ্জু দোকানের কাজ ফাঁকি দিয়ে আমাদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতো। আর কিছুণ পরপর চা বানিয়ে আনতো। চৌদ্দ বছরের সঞ্জু একরকম গর্ব করেই বলতো দাদা আমি পায়ে হেঁটে ইনডিয়া চলে গিয়েছিলাম আমার মাকে দেখতে। সঞ্জুর মা ইনডিয়াতে থাকে।
যাইহোক, ক’দিন বাদে যখন কুয়াশার আড্ডায় গেলাম, দেখলাম আড্ডার কালো বাঁশের খুঁটিতে সঞ্জুকে হাত পেছনে করে বাঁধা। রণাদার সাফ কথা তাকে বিদায় করে দেব। বারোঘরিয়া বাজার তখন বর্ষার পানিতে ভেজা। রণাদাকে বললাম, দাদা ওর হাত খুলে দিন। রণাদা বললেন, কথা বলনাতো ভাই, ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠেছে।
এসব মিথ্যাবাদী চোর পুষে আমার মিঠা সন্দেশ তিতা হতে চলেছে। সঞ্জু আমাকে দেখে তার মুক্তির ইচ্ছা তীব্র হলো। অপরাধ জানতে চাইলে সঞ্জু বললো, গত রাতে খায়নি। তাই ভোরে একটু বেশিই খেয়েছি। কিন্তু রণাদা যখন রেগে গিয়েছিলো তখন ভয়ে মিথ্যা বলেছি যে দুটো রুটি খেয়েছি।
এই গল্পটার এখানেই শেষ। আর একটি অবান্তর প্রশ্নের শুরু ক্ষুধার সাথে মিথ্যার কি একটি অভিন্ন যোগসূত্র থেকেই গেল। উত্তর হয়তো প্রকৃত সত্য কিংবা প্রকৃত মিথ্যার ভেতর আছে। ঠিক এটুকু যখন লিখেছি কুয়াশার আড্ডার কবি বন্ধু অনন্ত আজাদ মুঠোফোনে জানালো জানিস সঞ্জু এখন মৃত্যুর মুখোমুখি? আমি রস করেই বলেছিলাম কেন? সঞ্জু কি মৃত্যুকে মিথ্যা কথা বলেছে? অনন্ত গম্ভীর স্বরে বললো দুটো কিডনিই সঞ্জুকে মিথ্যা কথা বলেছে। কিডনি দুটো আর টানতে পারছে না সঞ্জুকে।
ভারি হয়ে গেলাম। আহা সঞ্জু মরে যাবে? কুয়াশার আড্ডার চায়ের কাপগুলো, ঊর্ধ্বমুখি আগুনগুলো ওরা কি সঞ্জুর আঙুলগুলোকে মনে রাখবে কিংবা হঠাৎ যেন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে ওহে চায়ের পিয়ালা বলোতো? ধীবরের ছেলে সঞ্জুর আঙুলগুলো সত্য না মিথ্যা? বোবা চায়ের পেয়ালার অভিব্যক্তির মধ্যেই হয়তো প্রকৃত সত্যমিথ্যা লুকিয়ে আছে।
তবে কি মিথ্যা আর লোভ সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। পৃথিবীর উ™£ান্ত সত্যগুলো বাধাগ্রস্ত। আবার অনেক সত্য বিবেচনার অভাবে মিথ্যা রূপেই বেঁচে আছে।
জগতে আমরা যেসব মিথ্যা রূপে জানি আমার সন্দেহ হয় সেটা মিথ্যা কি না। আবার সত্যগুলোকেও সন্দেহ হয় সত্য কি না? নাকি উন্মাসিক রাষ্ট্র সমাজকে ফাঁকি দিয়ে ওরা এভাবেই বেঁচে আছে। অনেক সত্যই তো মিথ্যা হলো আবার অনেক মিথ্যাই তো সত্য হলো, তবে সত্য মিথ্যার চূড়ান্ত রূপটা কোন ধারণায় প্রসূত? অনন্ত প্রশ্নের দিকে একবার হাঁটা যাক। জীবনগুলো তাই একঅর্থে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। জীবনকে যেন মর্মের চাকাই ঘুরতেই হবে।
চিন্তা চেতনা যাই বলি না কেন ওই ঘূর্ণমান চাকার উপরই নাকি রাখতে হবে ভরসা। চাকা থেকে কেউ ছিটকে পড়ছে, কেউ কেউ চাকার ভেতরই অস্থির চেতনায় নিমজ্জিত। স্থির চিন্তার অবকাশ বিলুপ্তির পথে। এই ঘূর্ণমান জগতের ঘূর্ণমান সময়ের ফাঁদে কি ঘূর্ণমান সত্যমিথ্যাগুলো তাদের নিজস্ব স্বভাবে আছে? জগতের সত্য আর মানুষের ভাবনার সত্যটি কি এক? মানুষ যখন মিথ্যার আশ্রয় নেয় তখন সেটা তার কাছে চূড়ান্ত সত্য। আর সত্য বলেই মানুষেরা সহজেই মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
জগতের ধ্র“বসত্য গুলো মানুষের কাছে কিরূপে পৌঁছেছে এটা চিন্তার বিষয়। জীবনের অধিকাংশ সময় মানুষ মিথ্যার খপ্পরে পড়ে যায় আর সত্য তখন যায় যায়। যদিও বা ধ্র“ব সত্যগুলো মানুষের কাছে পৌঁছায় ঠিকই কিন্তু জীবনের ধ্র“বগুলো আশ্রয় নেয় মিথ্যার কাছে। তবে কি মানুষের জীবন ধারণের ইতিহাস এক বিরল আপেকিতার মধ্যে নিমজ্জিত? একজন লোক তার স্বীয় অপকর্মের জন্য যে দণ্ডপ্রাপ্ত হতে যাচ্ছেÑ হয়তো একটা মিথ্যা বললেই তার দণ্ড মওকুফের সম্ভাবনাও আছে। যুতসই একটা মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার মতো সত্য আর কি আছে ওই ব্যক্তির কাছে।
মুক্তির জন্য ওই মিথ্যাটিই উক্ত ব্যক্তির কাছে সবচেয়ে সত্য হয়ে ওঠেনি কি? তাই তো সত্য-মিথ্যা যাই হোক সবই প্রকৃত বিন্যাসের সমান দূরত্বের। সবই ফুসফুস তাড়িত বাতাস। সেই বাতাস দূষিত না বিশুদ্ধ প্রশ্নাতীত। অন্যকোনো প্রাণীর এসবের চিন্তার প্রয়োজন হয় না। কারণ তাদের ফুসফুস তাড়িত বাতাসে সত্য-মিথ্যা নেই, তাদের ভাষাও নেই।
ধরে নেওয়া যেতে পারে উপরোক্ত সকল কথাই মিথ্যা। কেউ যদি ঘটা করে মিথ্যা বলতে চায় তবে তাকে অভিবাদন। কত মিথ্যা আর বলা যায়? প্রকৃত মিথ্যা তো আর বলা যায় না। কাল পাত্রভেদে কোনো না কোনোভাবে এসব মিথ্যা সত্যে রূপান্তর হবেই। তবে বঞ্চিতের কাছে মিথ্যাই একমাত্র শক্তি।
যা তার অস্তিত্বকে রা আর চাঙা করে তোলে। মিথ্যা নিয়ে মজার বাক্যটি হলো যার কাছে যত মিথ্যা, তার তত তাৎক্ষনাত শক্তি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।