আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঈশ্বরের অস্তিত্ব : আমার চিন্তাভাবনা (পর্ব - ২)

শালিক পাখি

ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে লেখা আগের ব্লগে আমি ‘বিশ্বাস’ শব্দটা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম| আরো দুটি শব্দ নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিলো| চলুন, আজ তাহলে ‘মানুষ’ নিয়ে কথা বলা যাক| ২. মানুষ: ‘মানুষ’ এর ব্যাখ্যা খুব সহজ, আবার বড়ই জটিল| সহজ ভাবে বলতে গেলে আমি, আপনি আমরা সবাই মানুষ| অনেকে আবার দার্শনিকভাবে অনেক দিক দিয়ে মানুষের সংজ্ঞা দিতে চান| আমি সেসব দিক নিয়ে বলবো না| আমি একটু বিজ্ঞানের দিক দিয়ে বিচার করবো| আশা করি আমরা সবাই জানি, মাত্রা কী| দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এগুলো হচ্ছে মাত্রা| মানুষ সামনে-পিছনে যেতে পারে, ডানে-বামে যেতে পারে, আবার উপর-নিচেও যেতে পারে| কাজেই মানুষ একটি ত্রিমাত্রিক প্রাণী| মাত্রার সংজ্ঞা আরেকটু ভালোভাবে দেয়া যায়: মাত্রা হচ্ছে আপনার সীমা| যেহেতু আপনি তিনটা দিকে যেতে পারেন, কাজেই আপনার মাত্রা তিন| যদি আপনার মাত্রা দুই হত, তাহলে শত চেষ্টা করেও আপনি তৃতীয় দিকে যেতে পারতেন না| ব্যাপারটা আমাদের জন্য চিন্তা করা একটু কষ্টকর, কারণ আমরা ত্রিমাত্রিক, কাজেই আমাদের চিন্তা ভাবনাও ত্রিমাত্রিক| আমরা চাইলেও দ্বিমাত্রিক প্রাণী (যদি আদৌ থেকে থাকে) কিভাবে তৃতীয় মাত্রায় যেতে পারবে না, তা বুঝতে পারবো না| নিজেরা কিভাবে চতুর্মাত্রায় যেতে পারবো না, তা হয়তো বুঝতে পারবো, কিন্তু সে ব্যাপারে পরে আসছি| আপাতত একটা দ্বিমাত্রিক জিনিস নিয়েই আলোচনা করি| আপনাকে যদি কোনো দ্বিমাত্রিক জিনিসের (অর্থাৎ যার শুধু দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ আছে, উচ্চতা নেই) উদাহরণ দিতে বলা হয়, আপনি হয়তো বলবেন, কাগজ বা এই জাতীয় পাতলা কিছু| কিন্তু সেটা সঠিক না| কাগজ যত পাতলাই হোক, তার কিছু উচ্চতা আছে| দ্বিমাত্রিক জিনিস হলো সেই জিনিস, যার উচ্চতা নাই বা শূন্য| অনেক চিন্তা করে এই ত্রিমাত্রিক পৃথিবীতে একটা মাত্র দ্বিমাত্রিক জিনিসের সন্ধান পেয়েছি, আর তা হলো ছায়া (যদি কেউ আর কোনো দ্বিমাত্রিক জিনিস আছে বলে জেনে থাকেন, জানাবেন দয়া করে)| ছায়া দ্বিমাত্রিক, অর্থাৎ এর সীমা বা মাত্রা দুই| শত চেষ্টা করলেও এটা তৃতীয় মাত্রায় যেতে পারবে না| আপনি কী কখনো একই সাথে দুটি তলে একটি ছায়া দেখেছেন? দেখেননি| কখনো দেখবেন ও না| কারণ এটা সম্ভব না| আপনি হয়তো বলতে পারেন, কেউ যদি দেয়ালের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে তার ছায়ার কিছু অংশ পড়ে মাটিতে, আর কিছু অংশও দেয়ালে| আপনার কথা ঠিক, কিন্তু এটা ছায়াকে ত্রিমাত্রিক বানায় না| কারণ, আপাত দৃষ্টিতে ছায়াটিকে দুটি তলে মনে হলেও, ছায়ার একটি নির্দিষ্ট অংশ কিন্তু একটি তলেই আছে, আর তা হলো দেয়াল অথবা মাটি| দেয়াল বা মাটির তলই ছায়ার তল এবং ছায়া কখনোই এর বাইরে যেতে পারবে না| এবার আপনি বলতে পারেন, ছায়ার তো জীবন নেই, ছায়া কিভাবে নিজ থেকে এক তল থেকে আরেক তলে যাবে? তাহলে ধরে নেই, এই পৃথিবীতে কোনো দ্বিমাত্রিক প্রাণী আছে| আপনি যদি এই প্রাণীর সামনে গিয়ে দাঁড়ান, সে কী দেখবে? সে কিন্তু আপনাকে পুরোপুরি দেখবে না| এমনকি সে ধারণাও করতে পারবে না, আপনি কে বা কী? তাহলে সে কী দেখবে? ধরেন, তার অবস্থান আপনার দেহের মাঝ বরাবর (পেটের কাছাকাছি) এবং আপনার সামনে| এবার আপনার পেটের ভিতর দিয়ে দুটো তল (যারা পরস্পরের খুব কাছাকাছি, অর্থাৎ যাদের মধ্যে দুরত্ব খুব কম) কল্পনা করেন, যা আপনার পেটকে ব্যবচ্ছেদ করছে (গা গুলালেও কল্পনা করেন)| আমরা যদি ধরে নেই, ওই দ্বিমাত্রিক প্রাণীটি সেই দুই তলের মাঝখানে অবস্থান করছে, তাহলে সে আপনার দেহের যে অংশটুকু ওই দুই তলের মাঝখানে আছে, সেই অংশটুকুই দেখবে| এখন আপনি হয়তো বলবেন, “একটু আগে আপনিই তো বললেন যে দ্বিমাত্রিক মানে যার কোনো উচ্চতা নাই| তাহলে যদি ওই দুই তলের মাঝখানে কিছু জায়গা থাকে, তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তাহলে তো তা আর দ্বিমাত্রিক থাকলোনা, ত্রিমাত্রিক হয়ে গেলো, কারণ ওই অংশের কিছু উচ্চতা অবশ্যই আছে|” খুব ভালো প্রশ্ন| উত্তর হলো, কল্পনার সুবিধার্থে আমরা ধরে নিয়েছিলাম প্রাণীটা এবং আপনার দেহের ওই অংশটুকু প্রায় দ্বিমাত্রিক, যার তৃতীয় মাত্রা, অর্থাৎ উচ্চতা প্রায় নাই বললেই চলে| একটু পরেই আমরা পুরো দ্বিমাত্রিক প্রাণী নিয়ে আলোচনায় যাবো| এখন ধরে নেই, প্রাণীটা আপনার দেহের ওই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উচ্চতার অংশটুকু দেখছে| যদি আপনার দেহের ওই অংশের প্রস্থ এক ফুট হয়, তাহলে সে দেখবে এক ফুট দৈর্ঘের একটি অনুভূমিক রেখা, যার উচ্চতা খুব কম| এবার আপনি মনে মনে ঘুরে দাঁড়ান, অর্থাৎ এখন প্রাণীটা আপনাকে পাশ থেকে দেখছে| আপনার পেট আর পিঠের মাঝের অংশের দৈর্ঘ্য যদি আধ ফুট হয়, তাহলে এবার প্রাণীটা দেখবে আধ ফুটের একটা রেখা, এবারও উচ্চতা নগন্য| আপনার এই ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা এবার একটু ভিডিওর মতো করে ভাবুন তো, প্রাণীটা কী দেখবে? সে দেখবে, কথা নাই, বার্তা নাই, হঠাৎ করে সেই এক ফুটের রেখাটা আস্তে আস্তে কমে আধ ফুট হয়ে গেলো| আশা করি ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে পেরেছি| এবার ধরা যাক, প্রাণীটা পুরোপুরি দ্বিমাত্রিক| তাহলে সে আপনার দেহের যে অংশটুকু দেখবে, তার আসলে কোনো উচ্চতা নাই বা উচ্চতা শূন্য| এবার একটু চিন্তা করেন তো, সে আসলে কী দেখবে, বা আদৌ কিছু দেখবে কিনা? সে আসলে কিছুই দেখবে না, কারণ যে তলের বা রেখার উচ্চতা শূন্য, তাকে কি দেখা যায়? এবার ধরে নেন, আপনার কাছে একটা ক্ষমতা আছে, যার ফলে আপনি ওই প্রাণীটাকে পুরোপুরি দ্বিমাত্রিক থেকে কিঞ্চিত ত্রিমাত্রিক বানাতে পারেন, অর্থাৎ আপনি চাইলে সে আপনার খুব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ দেখতে পারবে| অতএব এবার সে আপনাকে একটা রেখা হিসাবে দেখতে পারবে, যার উচ্চতা আসলে খুব কম (প্রথম ক্ষেত্রের ঘটনা)| এবার এই জিনিসটাকে একটু বৃহৎভাবে চিন্তা করি| আমাদের যে ত্রিমাত্রিক জগৎ, তা আসলে অসংখ্য দ্বিমাত্রিক জগতের সমষ্টি| বুঝিয়ে বলি| বইয়ের একটা পাতা প্রায় দ্বিমাত্রিক, কিন্তু যখন ৩০০ পাতা মিলে একটা বই হবে, তখন তা হবে ত্রিমাত্রিক| যদি বইয়ের পাতা পুরোপুরি দ্বিমাত্রিক (উচ্চতা নাই বা শূন্য) হত, তাহলে এরকম কতগুলো পাতা লাগতো, একটা ত্রিমাত্রিক বই বানাতে? উত্তর: অসীম সংখ্যক| কাজেই আমাদের ত্রিমাত্রিক জগৎ আসলে অসীম সংখ্যক দ্বিমাত্রিক জগতের সমষ্টি (চিন্তার সুবিধার জন্য ধরে নিতে পারেন, কোটি কোটি প্রায় দ্বিমাত্রিক জগতের সমষ্টি)| এবার তাহলে আরেকটু গভীরে যাই| এই যে অসংখ্য দ্বিমাত্রিক জগৎ, সেগুলো আসলে ত্রিমাত্রিক স্পেসে অবস্থানকারী অসংখ্য দ্বিমাত্রিক তল| এই অসংখ্য দ্বিমাত্রিক তলের প্রত্যেকটাতে যদি একটা করে দ্বিমাত্রিক প্রাণী থাকে, তাহলে তারা কী দেখবে? আপনার দেহের যে অংশটুকু তাদের সেই তলে/জগতে থাকবে, শুধু সেই অংশটুকু| ঘটনাগুলো মনে হয় একটু পেঁচিয়ে গেলো| একটু summarize করি| মূল ব্যাপারটা হলো, ত্রিমাত্রিক বস্তু বা প্রাণী কী জিনিস, তা দ্বিমাত্রিক প্রাণী কখনোই জানতে পারবে না| তারা শুধু আঁচ করতে পারবে এবং ত্রিমাত্রিক বস্তুটির শুধু সেই অংশই দেখতে পারবে, যা তাদের জগতে বিরাজমান| এমন কি তারা তাদের সীমিত দ্বিমাত্রিক জ্ঞান (যদি থেকে থাকে) দিয়ে বুঝতেও পারবে না, ত্রিমাত্রিক প্রাণীটা আসলে ঠিক কী জিনিস| একটু আগে বলেছিলাম, আমরা কেন চতুর্মাত্রায় যেতে পারবো না তা পরে আলোচনা করবো| শুরু করা যাক| আলোচনা করছিলাম দ্বিমাত্রিক আর ত্রিমাত্রিক প্রাণী/বস্তু নিয়ে| এবার চলুন ভাবি ত্রিমাত্রিক আর চতুর্মাত্রিক বস্তুর কথা| এতে কল্পনা করতে একটু সুবিধা হবার কথা, কারণ আমরা মানুষরাই ত্রিমাত্রিক প্রাণী! ধরেন আপনার আশেপাশের জগৎ চতুর্মাত্রিক, যেখানে চতুর্থ মাত্রাটি হচ্ছে ‘সময়’| আপনি নিজে ত্রিমাত্রিক প্রাণী, কাজেই আপনার পক্ষে চতুর্থ মাত্রায় বিচরণ করা অসম্ভব (টাইম মেশিন দিয়ে সময় পরিভ্রমণ আসলে পুরোপুরিই কল্পকাহিনী| এটা logically প্রায় অসম্ভব| বিস্তারিত ব্যাখ্যা অন্য কোনো দিন)| কিন্তু যদি জগৎটা চতুর্মাত্রিক হয়, তাহলে আপনি যে জগৎটা দেখেন, সেটা আসলে আপনার ‘সময়’এ সেই জগতের একটা প্রতিচ্ছবি| ঠিক যেমন, দ্বিমাত্রিক প্রাণী আপনাকে দেখে না, শুধু আপনার (বা পুরো ত্রিমাত্রিক জগতের) যে অংশটুকু তার তলে/জগতে থাকে, সে অংশটা দেখে, ঠিক তেমনি আপনিও পুরো জগৎ কখনোই দেখতে পারবেন না| শুধু আপনার সময়ের জগৎকে দেখতে পারবেন| এবং আপনি শত চেষ্টা করলেও কখনো অন্য সময়ে যেতে পারবেন না, অর্থাৎ সময় বরাবর ভ্রমণ করতে পারবেন না| ঠিক যেমন, ছায়া শত চেষ্টা করেও এক তল থেকে আরেক তলে যেতে পারেনি| ব্যপারটা কিন্তু আসলে সেরকমই| আমরা কি কখনো পারি, এক সেকেন্ড আগের সময়েও যেতে? কিংবা আধ সেকেন্ড পরে চলে যেতে? পারিনা| এবার ধরেন, চতুর্মাত্রিক জগতে কোনো একটা চতুর্মাত্রিক প্রাণী আছে| তার কোন অংশটুকু আমরা দেখবো? যে অংশটুকু আমাদের জগতে থাকবে, ঠিক সেই অংশটুকু| কারণ চতুর্মাত্রিক প্রাণীটা চতুর্থ মাত্রায়, অর্থাৎ সময় বরাবর ভ্রমণ করতে পারে| কাজেই সে যদি আমাদের সময়ে আসে, তবেই আমরা তাকে দেখবো| যদি সে আমাদের জগৎ থেকে সময় অক্ষে এক মিলিসেকেন্ড আগে বা পরেও থাকে, আমরা কিন্তু তাকে কখনোই দেখবো না| ঠিক যেমন দ্বিমাত্রিক প্রাণীটা শত চেষ্টা করেও উঁকি-ঝুঁকি দিয়েও দেখতে পারেনি, ঠিক তার উপরের তলে কী আছে| এবার আসা যাক, চতুর্মাত্রিক প্রাণীর সরূপ আসলে কেমন, সে আলোচনায়| আমাদের কাছে যেমন ভিন্ন উচ্চতার অনেক বস্তু একসাথে দৃশ্যমান (যেমন মাটিতে যদি তিনটা লাঠি থাকে, একটা ২ ফুট, একটা ৩ ফুট, একটা ৫ ফুট, সবগুলোই কিন্তু আপনার কাছে দৃশ্যমান হবে), ঠিক তেমনি চতুর্মাত্রিক প্রাণীর কাছে কিন্তু ভিন্ন সময়ের সবকিছু একসাথে দৃশ্যমান| অর্থাৎ তার কাছে স্থান, কাল, পাত্রের কোনো ধারনাই নেই| তার কাছে সবই বর্তমান| আপনি যদি জানালা দিয়ে বাইরে তাকান, তাহলে আপনার দৃষ্টিসীমার মধ্যে যা কিছু পড়া সম্ভব, সেসব যেমন একসাথে আপনার চোখে পড়ে, ঠিক তেমনি চতুর্মাত্রিক প্রাণী যখন সময়ের জানালা দিয়ে আমাদের এই জগতের দিকে তাকায়, তখন তার কাছে সব সময়ের ঘটনা একসাথে চোখে পড়ে| এই প্রাণীটির অবস্থান যদি সর্বস্থানব্যাপী হয় (এটা শুধুই একটা কল্পনা, বিজ্ঞান সব কিছুই কল্পনা করার অধিকার দেয়, প্রমাণ করা পরের ব্যাপার), তাহলে তার কাছে আসলে ঐ চতুর্মাত্রিক জগতের কোনো কিছুই সীমাবদ্ধ হবে না| সে হবে সেই জগতের সর্বস্থানব্যাপী এবং সে হবে সকল সময়ে বিরাজমান| আর আমরা, আমাদের ত্রিমাত্রিক সীমিত জ্ঞান দিয়ে কখনোই সেই প্রাণীকে জানতে বা বুঝতে পারবো না| কাজেই, মানুষ সম্পর্কে উপসংহার হলো: মানুষ একটি ত্রিমাত্রিক প্রাণী, যে তার এই ত্রিমাত্রিক জগতে সবচেয়ে জ্ঞানী প্রাণী হতে পারে, কিন্তু চতুর্মাত্রিক প্রাণীর কাছে সে অসহায়| চর্তুর্মাত্রিক প্রাণীর শুধু সেই অংশটুকুই সে দেখতে পারবে, যে অংশটুকু তার ত্রিমাত্রিক জগতে থাকবে|

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।