আহমদ আশিকুল হামিদ : নোবেল পুরস্কার জিতলেই কেউ যে একেবারে গড় উল্টে ফেলার মতো মহাকিছু হয়ে যান না সর্বশেষ ক্ষেত্রে তার প্রমাণ দিয়েছেন ভারতের নাগরিক অমর্ত্য সেন।
‘দি আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান গ্রন্থে মূলকথার মধ্য দিয়ে মিস্টার সেন বুঝিয়ে দিয়েছেন, অন্য দশজন হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়র মতো তিনিও মনে-প্রাণে একজন কট্টর
হিন্দুই রয়ে গেছেন, তথাকথিত আন্তর্জাতিকতার আকাশে উড়াল দিতে পারেননি। ভারতীয় হিন্দুদের জন্য এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। অনেক তথ্য ও ঘটনারই উল্লেখ করা যায়, যেগুলো প্রমাণ করবে, মুসলমানদের প্রতি ভারতীয় হিন্দুদের মনোভাব সেই ব্রিটিশ আমলের মতোই রয়েছে। অর্থাৎ পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘টু নেশন থিওরিতে কোনো ভুল বা অতিরঞ্জন ছিল না।
মিস্টার জিন্নাহ আসলেও একশ ভাগ সত্যই বলেছিলেন। প্রথমে ‘ওপার বাংলার কথাই বলা যাক। শুনলে আমাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ সুশীলজনেরা রা-রা করে উঠতে পারেন, কিন্তু ভারত এতটাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যে, কোলকাতার মুসলিম প্রধান পার্ক সার্কাস এলাকায় মুসলমানরা এখনো জুমার নামাজ পড়তে যান টুপি পকেটে নিয়ে। অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়ে- যেন কোনো অন্যায় করতে যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই মাইকে আযান দেয়া আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নয়াদিল্লির তথা ভারতের কেন্দ্রস্থলের দিকে লক্ষ করুন।
ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর মতো বিদেশিনী খ্রিস্টান রমণীকেও নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করার আগে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডেকে, হাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে এবং ঢাকঢোল বাজিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। মন্দিরে গিয়ে গলায় আঁচল পেঁচিয়ে হিন্দুদের দেবীকে পেন্নাম করতে হয়। অথচ সোনিয়া গান্ধী হিন্দু নন। এসবই ভারতের রাজনীতিতে অবশ্যপালনীয়- সোনিয়া গান্ধী থেকে লালকৃষ্ণ আদভানী পর্যন্ত রাজনীতিকদের প্রত্যেককে হিন্দুধর্ম এবং ধর্মের বিধি-বিধান মানতে হয়। নাহলে ভোট পাবেন না তারা।
কথাগুলো জানানোর উদ্দেশ্য একথা স্পষ্ট করা যে, যতোই ‘ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান দেয়া হোক না কেন, ভারত এখনো সর্বতোভাবেই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রই রয়ে গেছে। দেশটিতে মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের বিপদও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এখানে ২০০২ সালের সংঘটিত গুজরাট হত্যাকান্ডের উল্লেখ করা যায়। গোধরায় একটি ট্রেনে অগ্নি সংযোগের মিথ্যা অভিযোগে দিনের পর দিন ধরে সেবার শতশত মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী মুসলমানদের স্বার্থে কোনো পদক্ষেপ নেননি।
শুধু তা-ই নয়, হত্যাকান্ড নিয়ে লোকসভায় বিতর্ক শুরু হওয়ার প্রাক্কালে গোয়ায় অনুষ্ঠিত বিজেপির সম্মেলনে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী গুজরাট হত্যাকান্ডের জন্য উল্টো মুসলমানদের দায়ী করেছিলেন। তার কথাগুলোও ছিল উস্কানিমূলক। তিনি বলেছিলেন, ‘যেখানেই মুসলমান সেখানেই সন্ত্রাস। তাদের ধর্ম সন্ত্রাস শেখায় এবং পৃথিবীর কোথাও তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারে না। বাজপেয়ী গুজরাট পরিস্থিতির জন্য তার নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের এবং গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদীর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই বলেও ঘোষণা করেছিলেন।
এককালের সমাজতন্ত্রী ও বাজপেয়ীর প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের বক্তব্যও স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘রেপ বা ধর্ষণ এমন কোনো বিষয় নয়। এটা অতীতেও বহুবার ঘটেছে। গর্ভবতী মায়ের পেট কেটে শিশু হত্যার যে কথা বলা হচ্ছে তা কি এক গুজরাটেই ঘটেছে? ১৯৪৭ সাল থেকে এমন ঘটনা কতবার ঘটেছে তার হিসাব কষে দেখুন। প্রধানমন্ত্রী বাজপায়ী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের বক্তব্য লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দুজনই প্রকারান্তরে মুসলিম হত্যাকান্ডে নিজেদের সমর্থন ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করেছিলেন।
তাদের কথায় ঘাতকদের প্রতিও সমর্থন ও উস্কানি ছিল- যার অর্থ হলো, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেকোনো সময় যেকোনোস্থানে হত্যার অভিযান চালানো যেতে পারে এতে দোষের কিছু নেই এবং এটাই ভারতীয় মুসলমানদের প্রাপ্য ‘ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী ন্যাশনাল কংগ্রেস ও বামপন্থীসহ বিজেপির বিরোধিতাকারী দলগুলোও কখনো মুসলমানদের পক্ষে ভূমিকা পালন করেনি। গুজরাট হত্যাকান্ডের দিনগুলোতে দেখা গেছে, রাজ্যের রাজধানী আহমেদাবাদে যাওয়ার কিংবা মুসলমানদের বাঁচানোর লক্ষে কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে সোনিয়া গান্ধী শুধু লোকসভার অধিবেশন আহবান জানানোর দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন। এর ফলেও ঘাতকরা যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। এদেশের কারো কারো ‘কাকাবাবু জ্যোতি বসু তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাকেও শুধু দিল্লিতেই দৌড়-ঝাঁপ করতে দেখা গেছে।
এভাবেই এক মাসের বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছিলেন ‘ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের রাজনৈতিক নেতারা। লোকসভার অধিবেশনে দেয়া ভাষণেও সোনিয়া গান্ধী গুজরাট হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচারের এবং মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তেমন জোরালোভাবে জানাননি। তিনি প্রধানত মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদীকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন- যেন ওই একজন মাত্র ব্যক্তিকে সরানো হলেই মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে যেন হত্যার অভিযানে বাজপেয়ীসহ কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো ভূমিকা বা অংশগ্রহণই ছিল না প্রাসঙ্গিক অন্য একটি তথ্যও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। বিরোধী দলের সমালোচনার মুখে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী তখন গুজরাটের রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সোনিয়া গান্ধী সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
কারণ, গুজরাটে তখন নির্বাচন হলে মুসলমান নিধনে নেতৃত্ব দেয়ার ‘পুরস্কার হিসেবে বিজেপি জোটই জয়ী হতো এবং নরেন্দ্র মোদীই আবারও মুখ্যমন্ত্রী হতেন। ভারত এতটাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এর মধ্য দিয়েও প্রমাণিত হয়েছিল, ভারতে এখনো ‘টু নেশন থিওরিই সত্য। উল্লেখ্য, বিজেপি এখনো গুজরাটের ক্ষমতায় রয়েছে এবং মোদীই আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন।
এখানে কংগ্রসের ভূমিকার দিকটি লক্ষ করা দরকার। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বিরোধিতা ও প্রতিবাদের নামে কংগ্রেস যেটুকু করেছিল তার সবই করেছিল নিজের ‘ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য।
কংগ্রেসের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশের অন্যান্য রাজ্যে ‘ভোট ব্যাংক মুসলমানদের সন্তুষ্ট করা। অর্থাৎ কংগ্রেসের উদ্দেশ্যের মধ্যে মুসলমানদের জানমাল হেফাজতের কোনো উপাদান ছিল না। সবই ছিল নিতান্ত রাজনৈতিক কৌশল। বলা দরকার, কংগ্রেস সবচেয়ে বেশি সময় ভারতের ক্ষমতা থেকেছে এবং কংগ্রেসের সময়ও মুসলমানরা একইভাবে হত্যা ও দাঙ্গার শিকার হয়েছেন। ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ যখন ভেঙে ফেলা হয় তখনও কংগ্রেসই ক্ষমতায় ছিল।
প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসীমা রাও। কিন্তু কংগ্রেস সরকার বাবরী মসজিদ ভাঙা যেমন প্রতিহত করেনি তেমনি ব্যবস্থা নেয়নি মুসলমানদের হত্যার অভিযান থামানোর জন্যও। উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং বলেছেন এবং একথা প্রমাণিতও হয়েছে যে, অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদভানী বাবরী মসজিদ ভাঙার কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু নরসীমা রাওয়ের কংগ্রেস সরকার এই দুজনসহ কারো বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সত্যিকার ‘ধর্মনিরপেক্ষ কোনো রাষ্ট্রে এমনটা কল্পনাই করা যায় না।
কিন্তু উত্তর প্রদেশ ও গুজরাটসহ সারা ভারতে মুসলমানদের হত্যাকান্ড সম্ভব হওয়ার কারণ হচ্ছে, সংবিধানে লেখা থাকলেও এবং প্রকাশ্যে প্রচারণা চালানো হলেও ভারত এখনো উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি, মনোভাব ও কৌশল নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে মুসলমানদের হত্যা করার, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালানোর এবং মুসলমানদের পদানত রাখার ব্যাপারে গোপনে গোপনে সকল দলের মধ্যেই সমঝোতা রয়েছে। পার্থক্য হলো, বিজেপি যেখানে হিন্দুত্ববাদী পরিচিতিকে প্রকাশ্যে আনে কংগ্রেস সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার সাইনবোর্ডকে সামনে রাখে।
এখানে কমিউনিস্ট ও বাম নামধারীদের প্রসঙ্গেও বলা দরকার। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ এবং ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান-বিরোধী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে অন্য ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তার আগের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আমলে এই বিরোধিতায় তেমন কমতি ছিল কি-না? উত্তর হলো, সর্বতোভাবে ভারতের স্বার্থ উদ্ধারে নিয়োজিত থাকলেও জ্যোতি বসু এদেশে অনেকেরই ‘কাকাবাবু হওয়ার চাতুরিপƒর্ণ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। ‘কমরেড জ্যোতি বসু যেখানে অভিনয় করার কৌশল নিয়েছিলেন, ‘কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেখানে কূটনৈতিক শালীনতা ও শিষ্টাচার পর্যন্ত মানেন না। তার কথাবার্তা শুনে বরং মনে হবে, প্রকাশ্য পরিচিতিতে একজন ‘কমিউনিস্ট হলেও তার আবির্ভাব ঘটেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি, আরএসএস ও সংঘ পরিবার থেকে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লেগে থাকার জন্যই যেন তাকে মুখ্যমন্ত্রী বানানো হয়েছিল উদাহরণ হিসেবে এখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার কিছু মন্তব্যের উল্লেখ করা যায়। ২০০৪ সালের ১৭ আগস্টের বোমাবাজি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যখন ভীত-সন্ত্রস্ত ও চরমভাবে ক্ষুব্ধ, পশ্চিমবঙ্গের এই ‘কমরেড মুখ্যমন্ত্রী তখন বাংলাদেশে পাকিস্তানের ‘সেকেন্ড ফ্রন্ট আবিষ্কার করে বসেছিলেন। বোমাবাজির ঠিক পরদিন উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও চরম বাংলাদেশ-বিরোধী হিসেবে পরিচিত কোলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ এখন একটা থ্রেট।
এ শুধু কথার কথা ছিল না। কারণ, অত্যন্ত ক্ষোভ ও বিরক্তির সঙ্গে ওই সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ যে একটা ‘থ্রেট এবং পাকিস্তান যে বাংলাদেশে তার ‘সেকেন্ড ফ্রন্ট খুলেছে- এই কথাটি তিনি দিল্লিকে তথা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘ততোবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ‘যতোবার ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু ‘আফসোসের বিষয়, কেউই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথাকে তেমন ‘পাত্তা দেননি। তা সত্তে¦ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার নিজের মনের মতো করে ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন। আনন্দবাজারকে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে ‘কমরেড মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশে ‘মৌলবাদীরা এমনভাবেই মাথাচাড়া দিয়েছে, যার ফলে ‘ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজম নাকি একটি ‘জটিল জায়গায় চলে গেছে তিনি আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, কথিত ‘মৌলবাদীদের প্রতিফলন নাকি সরকারে এবং সেনাবাহিনীতেও হচ্ছে এজন্যই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বাংলাদেশকে একটা ‘থ্রেট মনে করেছেন।
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে তিনি যে পাকিস্তানের পাশাপাশি সার্বিকভাবে মুসলমানদেরই টেনে এনেছেন সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ ভারতের তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেরও কারো কাছে মুসলমানদের আশা করার বা পাওয়ার কিছু নেই- তা তিনি মুখ্যমন্ত্রী বা রাজনেতিক নেতা, কূটনীতিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী বা নোবেল বিজয়ী যা-ই হোন না কেন। উদ্বেগের কারণ হলো, ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মুসলিমবিরোধী হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। দেশটিতে হিন্দু ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন শুধু গড়েই ওঠেনি, সেগুলো দশকের পর দশক ধরে তৎপরতাও চালিয়ে আসছে। এসব সংগঠনের সঙ্গে ভারতের সেনাবাহিনীও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে।
তাদের লক্ষ ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো। তারা ভারতের সেনাবাহিনীতে হিন্দুত্ববাদের প্রচারণা চালাচ্ছে। পেছনে রয়েছে শিব সেনা, বজরঙ্গ দল, আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ এবং বিশ্ব হিন্দুপরিষদ বা ভিএসপির মতো কয়েকটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল। দলগুলো সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের অফিসার ও সৈনিকদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে ভেড়াচ্ছে। পুলিশ অনেক উপলক্ষেই প্রমাণ পেয়েছে, ভারতের সেনাবাহিনী ও হিন্দু সন্ত্রাসীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং তারা মুসলমানদের হত্যাসহ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে।
কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। কারণ, নিন্দেশ আসে ‘র-এর কাছ থেকে। সব প্রধানমন্ত্রীর আমলেই ‘র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ ভারতের রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী, ‘র এবং সন্ত্রাসীদের সমন্বিত নেটওয়ার্ক একযোগে কাজ করছে। বাবরী মসজিদ ধ্বংস ও মুসলমান হত্যা, গোধরায় ট্রেনে অগ্নি সংযোগ, গুজরাট গণহত্যা, মালেগাঁওয়ের বোমা বিস্ফোরণ, সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নি সংযোগ এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর সব অপরাধেই রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী, ‘র এবং সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রতিটি হত্যাকান্ডের সময় তো বটেই, আগে-পরে সকল উপলক্ষেও প্রমাণিত হয়েছে, ভারতীয় মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো দল ভারতে নেই। অদূর ভবিষ্যতেও তেমন কোনো দলের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ, ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে যতো প্রচারণাই চালানো হোক না কেন, ভারত এখনো হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রই রয়ে গেছে। বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, অমর্ত্য সেন মোটেও ব্যতিক্রম ঘটাননি। একজন ভারতীয় হিন্দু হিসেবে তিনি বরং তার জাতীয় দায়িত্বই পালন করেছেন।
বর্তমান পর্যায়ে এত কথা বলার কারণ শুধু অমর্ত্য সেন নন। মিস্টার সেন যে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন, সেই ভারতের চামচামো করার মতো লোকজনের সংখ্যা এদেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তো বটেই, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্য সকল ক্ষেত্রেও তারা দাপটের সঙ্গে তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব লোকজনই কথায় কথায় বাংলাদেশকে ‘এপার বাংলা বানিয়ে ছাড়ছে- যেন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ ‘ওপার বাংলা পশ্চিমবঙ্গের মতো ভারতের একটি রাজ্য মাত্র বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, সবকিছুর পেছনে রয়েছে একই সুচিন্তিত পরিকল্পনা। অমর্ত্য সেনও সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নেই ভূমিকা পালন করেছেন।
বাংলাদেশের জনগণকে তারা ধীরে ধীরে ভারত নামের ট্যাবলেট গেলানোর কৌশল নিয়েছেন। ভারতীয় হিসেবে অমর্ত্য সেন এমন কিছু করতেই পারেন, কিন্তু উদ্বেগ বেড়ে চলেছে আসলে বাংলাদেশের ওই গোষ্ঠীর কর্মকান্ডে। সার্বভৌম বাংলাদেশকে শুধু ‘এপার বাংলা বানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছেন না তারা, সুযোগ সৃষ্টি করে ভারতের জাতীয় সঙ্গীতও বাজাচ্ছেন। এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে রোটারি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখার সম্মেলনে। গত ১ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করেছেন এর কর্মকর্তারা।
এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানে সাধারণত স্বাগতিক দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। কর্তাব্যক্তিরা যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, সম্মেলনে রোটারি ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিত্ব করেছেন একজন ভারতীয়। ওই ভারতীয়র প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যই নাকি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়েছেন তারা যুক্তিটি অবশ্য হালে পানি পায়নি। কারণ, এটা ভারত- বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার মতো কোনো উপলক্ষ ছিল না বরং সম্পূর্ণরূপে ছিল ক্লাবটির বাংলাদেশ শাখার সম্মেলন। এতে যদি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট নিজেও উপস্থিত থাকতেন তাহলেও তার বা বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো চলতো না।
ক্লাবের গঠনতন্ত্রেও অন্য কোনো দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর বিধান নেই। অতীতে এই রোটারি ক্লাবেরই অনেক সম্মেলন বাংলাদেশে হয়েছে। সেগুলোর কোনোটিতেও নিয়মের বাইরে যাওয়া হয়নি। যেমন গত বছর রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তুরস্কের একজন নাগরিক ক্লাব প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ওই সম্মেলনে তাই বলে তুরস্কের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়নি।
কিন্তু এবার নিন্দনীয় ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন ক্লাবের কর্তাব্যক্তিরা। তারা একজন মাত্র প্রতিনিধির প্রতি সম্মান দেখানোর অজুহাত দেখিয়ে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে ছেড়েছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাণিজ্যমন্ত্রী এবং সাবেক তত্ত¦াবধায়ক সরকারের একাধিক উপদেষ্টাসহ উপস্থিত গণ মান্যজনদের কেউই এ ব্যাপারে আপত্তি জানাননি। তারাও সম্ভবত ভক্তিতে গদগদ হয়ে পড়েছিলেন। জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করার এ ঘটনাটিকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই।
কারণ, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা একটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে সম্মানিত হওয়ার মতো বিষয়। এ দুটিকেই আমরা সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতার জন্য জাতি প্রাণ দিয়েছে, রক্তের সাগর তৈরি করেছে। এত বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বলেই জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার অবমাননাকে আইনে দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে নিন্দিষ্ট করা হয়েছে। সংবিধানেও জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখার সুস্পষ্ট নিন্দেশনা রয়েছে।
এজন্যই যার-তার প্রতি সম্মান দেখানোর নামে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো যায় না, যেমন যায় না যে-সে মানুষের গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগানো। এ সংক্রান্ত আইন ও নিন্দেশনা রোটারি কর্মকর্তাদেরও অজানা থাকার কথা নয়। তা সত্তে¦ও তারা যেহেতু একজন ভারতীয় নাগরিকের প্রতি সম্মান দেখানোর অজুহাতে জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়েছেন সেহেতু ধরে নেয়া যায়, সব জেনে-বুঝেই তারা আইন অমান্যের এবং অবমাননা দেখানোর অপকম্মটুকু করেছেন। বলা বাহুল্য, এর পেছনে রয়েছে ভারতপ্রীতির সে একই উদ্দেশ্য, যে উদ্দেশ্য থেকে অমর্ত্য সেন মুসলমানদের ইসলাম ত্যাগ করার ‘নসিহত করেছেন। বিষয়টি নিয়ে এখনই গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।