আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমর্ত্য সেন: সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক এক সাক্ষাতকারে

লেখক/কবি
১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন শান্তি নিকেতনে জন্ম নেবার পর থেকে কম বেশী সারাটা জীবনই কেটেছে কোন না কোন বিশ্ব বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এলাকায়। এক সময় তার বাবা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে রসায়ন পড়াতেন। পুরাতন ঢাকার ওয়ারীতে ছিল তাঁদের পূর্বপুরুষের আবাস স্থল। বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে তাঁরা পারিজমান ভারতে। নানা রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে সংস্কৃত আর প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ে পড়াতেন।

সেখানেই একসময় তাঁর মা অমিতা সেনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়, আরো পরে এই একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর নিজের ছাত্র জীবনের সূচনা। তার পর শান্তিনিকেতনের গন্ডিপেরিয়ে একে একে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কেমব্রিজ ট্রিনিটি কলেজের ছাত্রত্ব বরন করেন। এক সময় এই উভয় শহরের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ একাধারে পড়াতে শুরু করেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সর্ফোড, হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর অতিথি শিক্ষক হিসেবে পড়াতে থাকেন এমআইটি, স্টেনফোর্ড, বার্কলে, এবং কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শিক্ষকতা ও গবেষণার বাইরে অন্য কোন পেষায় তিনি কখনই খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না। অর্থনীতিতে স্থিত হবার আগে তরুণ বয়েসে তিনি নানা বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। পরিবর্তন সম্পর্কে সেনের বক্তব্য ‘কেবল জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের মধ্য দিয়েই আসতে পারে পরিবর্তন’। অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এর আইডিয়া অব জাস্টিস নতুন বইটি সম্প্রতি আলোচিত একটি বই। বইটির আলোকে সন্ত্রাসবাদ ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলও: প্রশ্ন: অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, আমরা সন্ত্রাসবাদের একটি সময় অতিবাহিত করছি আর আদর্শের মাধ্যমে যে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে আমরা ভারতবাসীরাও তার শিকারে পরিণত হচ্ছি।

আপনার ন্যায় বিচারের তত্ত্ব, প্রকাশ্য ন্যায়তা তত্ত্ব কিভাবে এক জন সন্ত্রাসবাদীর জন্য ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করতে পারে? অমর্ত্য সেন: আসলে কি জানেন বিশেষ কোন ব্যক্তির বিচার সম্বন্ধে তত্ত্বটিতে খুব বেশী কিছু বলা নেই। এটা সম্পূর্ণ আইনি একটি বিষয়। আইন অনুযায়ীই তার সমাধান হওয়া উচিত। কিন্তু আপনি কিভাবে নিশ্চিত হবেন যে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা বিচারের সুযোগ কমাবার বদলে বাড়াতে পারছি। আপনি জানেন, সন্ত্রাস বাদের কারণে মুক্তভাবে কথা বলার সুযোগ যত বেশী কমে আসছে ততই আমাদের সংঘাতের মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে।

একারণে অত্যাচার এবং অন্যান্য উপায়ে তথ্য পাবার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে, যার থেকে আবার অন্য ধরনের এক সন্ত্রাসের ইস্যুর জন্ম হচ্ছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে এমন কোন পরিস্থিতিতে এমন কি সন্ত্রাসের ক্ষেত্রেও মারধোরের কোন কারণ থাকতে পারে না। কেননা তথ্য পাওয়ার জন্য এটি খুবই খারাপ একটি পন্থা। তেমন একটা কার্যকরও নয় পদ্ধতিটি। শত বছর ধরে বিশ্বব্যাপী পীড়ন বিষয়ে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে পীড়নের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে লোকেরা জিজ্ঞাসাবাদ কারীকে সন্তষ্ঠ করতে পারে এমন কথাই বানিয়ে বানিয়ে বলেছে।

তাই এর থেকে তেমন বেশী তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়াও অন্যান্য আরো ইস্যুনিয়ে জনগণের মাঝে উন্মুক্ত আলোচনা হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আমি আগের প্রশাসনের বদলে প্রেসিডেন্ট ওবামার মতই অবস্থান নেব। বিগত প্রশাসনের চেনি বিশেষভাবে বলেছিলেন, প্রয়োজনের কারণে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছিলো। আমি মনে করি এটা অবিচার ও অবিবেচনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

কিন্তু অন্য ইস্যুটা একটা বড় ইস্যু। সন্ত্রাসবাদের কারণ গুলো চিহ্নিত করতে জনমতের সহায়তা নেওয়া দরকার। একাজে অনেক সময় দরকার। রানী এবং প্রধান মন্ত্রীকে জানিয়ে কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেলের মাধ্যমে একটি কমনওয়েলথ কমিশন গঠন করার সুযোগ হয়েছিলো আমার। কাম পালার এক সভায় প্রধান মন্ত্রী প্রস্তাবটি মেনেও নিয়েছিলেন, তাদের বক্তব্যও ছিলও কেবল জনগণের সংশ্লিষ্টতাই সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের চূড়ান্ত অস্ত্র হতে পারে।

প্রশ্ন: এটাকি ভাবাদর্শের সঙ্গে সংলাপের ধারনা নয়? অমর্ত্য সেন: ভাবাদর্শের সঙ্গে সংলাপ নয়। আসলে ভাবাদর্শ বাদীর সংখ্যা খুবই নগণ্য কিন্তু তারা সত্যিকার অর্থে অন্যান্য আরো অনেক লোকের উপর নির্ভর করে। যে লোকটা এই মাত্র কাউকে গুলি করলো একবার ভাবুনতো দেখি সব কিছু জেনে বুঝে কে তাকে আশ্রয় দিলো, আমি বিশেষ কারো প্রতি ইঙ্গিত করছি না, অতীতের দিকে একটু তাকালেই বুঝতে পারবেন আমি কি বলতে চাচ্ছি। অন্তত সব জায়গাতেই প্রতি এক জন অজানা সন্ত্রাসীর পেছনে আরো একশত জন অজানা লোকের অস্তিত্ব রয়েছে যারা কোননা কোনভাবে বিষয়টিকে জেনে বুঝে পুরোপুরি মেনে নেয়। প্রশ্ন: কিন্তু ভারতে জন বহুল এলাকা মুম্বাই সন্ত্রাসী হামলার মত আরো বেশ কিছু ঘটনার কারণে তাৎক্ষনিক বিচারের প্রশ্ন উঠেছে, সবার ধারনা এভাবেই সন্তাসবাদ ঠেকানো এবং সন্ত্রাসবাদের বিচার করা সম্ভব।

অমর্ত্য সেন: প্রথমেই আমি শুরু করেছি সাধারণ জনগণকে নিয়ে, এখন কাজ করছি সহানুভূতিশীলদের নিয়ে, তারপর আমি সম্ভাব্যদের তাৎক্ষনিক বিচারের বিষয়ে কাজ করবো। প্রশ্ন: আপনি কি এর বিরোধিতা করেন? অমর্ত্য সেন: আপনাকে সহানুভূতিশীলদের অথবা যারা সহানুভূতিশীলে পরিণত হতে পারে এমন লোকদের নিয়ে ভাবতে হবে। বেশীরভাগ শান্তিপ্রিয় লোকেরাই সহানুভূতিশীল হয়। তারা এমনভাবে সন্ত্রাস সহ্য করে সত্যিকারে সেটা তাদের পক্ষে বুঝে ওঠাই সম্ভব হয় না। কিন্তু আপনি যাবতীয় অনুযোগ আর বিগত দিনে বিভিন্ন জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া উপনিবেশবাদ, অন্যায় অত্যাচারের আলোকে এগুলো বুঝে উঠতে পারবেন।

প্রশ্ন: এর মাধ্যমে কি, কিভাবে সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি হয় তা বুঝতে পারবো? অমর্ত্য সেন: না, কিভাবে পুন: পুন: সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয় তা বুঝে উঠতে পারবেন। প্রশ্ন: প্রকাশ্য যুক্তি তর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে একে কমানো চেষ্টা করা সম্ভব কি? অমর্ত্য সেন: উদাহরণ হিসেবে জমি মালিকদের কথা বলা যেতে পারে। যদিও বিষয়টি একটু ভিন্ন ধরনের। জমি মালিকদের দ্বারা সমাজের নিচু শ্রেণী যদি খুব বেশী পরিমাণে নিষ্পেষিত হয় তাহলে বুঝতে হবে অচিরেই এ খেলার শেষ হবে। কেবল এটাই যথেষ্ট নয়, আপনাকে এ কথাও স্বীকার করতে হবে কোথাও বড় ধরনের ভুল রয়ে গেছে, আর তা মোটেই গ্রহণ যোগ্য নয়।

এই একই দৃষ্টিতে একসময় ম্যান্ডেলা এবং টুটু শ্বেতাঙ্গদের দেখতও। প্রশ্ন: মুম্বাইয়ের মতো আর সব জায়গাতেই সন্ত্রাসী হামলার পর পরই বিভিন্ন প্রকাশ্য আলাপ আলোচনায় কম বেশী সবাই বলেছে “বিচার প্রক্রিয়ার কথা ভুলেগিয়ে এদের ফাঁসি দিয়ে দেয়া হোক” তাই এভাবে জনতার মতামত নেয়াতে কি আপনি ভীত নন, আর এমন পরিস্থিতিতে জনতা কি বিশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারেনা? অমর্ত্য সেন: জনতা ক্ষেপে উঠুক কি না উঠুক আপনাকে প্রকাশ্য যুক্তি তর্ক তুলে ধরতে হবে। এভাবে বিশৃঙ্খল জনতার মানসিকতার বিরুদ্ধে যুক্তি তুলেধরা সম্ভব। উদাহরণ তৈরির জন্য আপনাকে ভীর থেকে বেরিয়ে আলাদা হতে হবে। আমাকে কোন উদাহরণ তৈরি করতে হবেনা তার কারণ আমরা আজ সন্ত্রাসের মাঝে বসবাস করছি।

কিন্তু আমাদের অতীতের কথা একবার ভাবুন যখন এখানে পরিস্থিতি শান্ত ছিলও, একই সঙ্গে তখনকার দক্ষিণ আমেরিকার বিশৃঙ্খল জনতার কথা ভাবুন, সেখান কার লোকেরা কালোদের উপর এমনই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলো যে সব কালোদের ধরেই তারা ফাঁসিতে ঝুলাবার পক্ষে মতদিয়ে দিচ্ছিলও। কেবল উদাহরণ সামনে টেনে কিন্তু আলাপ আলোচনা বন্ধ করে দেওয়া ভুল হবে। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াই হবে সঠিক শিক্ষা। এই যুদ্ধে মার্টিন লুথারকিংএর জয় হয়েছে, ম্যান্ডেলার জয় হয়েছে, গান্ধির জয় হয়েছে। প্রশ্ন: জনমত গ্রহণের ধারনা খুবই মজার, একারণে আমরা সবাই এর পেছনে ধাওয়া করছি।

কিন্তু এতে করে আবার মিডিয়ার মাধ্যমে বিচার হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায় না কি? অমর্ত্য সেন: আমার মনে হয় জনমতের ব্যাপারে আপনি খানিকটা হলেও অবিশ্বাসী। জাতিগত হানাহানির কথাই ধরুন। কালোরা সাদাদের চাইতে নিচুস্তরের এমন বাজে যুক্তি হতে এর জন্ম। এক্ষেত্রে কখনো বলা হয়নি আসুন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। কেবল বিশ্বাসই করা হয়েছে যে কালোরা আসলেই শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে হীন প্রকৃতির।

কেন এমনটা বিশ্বাস করা হয়? কি প্রমানইবা আছে এর সপক্ষে? সমস্যা জয় করতে হলে সবাইকে যুক্তি দিয়েই প্রথমে বোঝাতে হবে। তাহলেই কেবল জনতার মধ্যে জন্ম নেওয়া বিশৃঙ্খলতা নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। কাউকে ধরে মেরে ফেললেই একে বারে এর সমাধান হবে না। এটা শুধু শত্রু “ মিত্রের সমস্যা নয়। আর তাই সন্ত্রাস বাদের পুরো বিষয়টিকে ভালো করে বুঝতে হবে।

যে লোকটা গুলি ছুড়ছে আর তার পেছনের যে পুরো সমাজ তাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আমরা তার মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হচ্ছি। প্রশ্ন: আর তাই কি আপনি প্রকাশ্য আলোচনার কথা বলছেন? অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ আসলেই তাই। কারণ তাদের ওপরই টেররিস্টদের নির্ভর করতে হয়। আপনি বলতে পারেন সে আর কোন সমস্যাই না কারণ সন্ত্রাসীটিকে গুলি মারা হয়েছে। কিন্তু আত্মঘাতী মিশনে বের হওয়া কোন ঘাতক এর পরোয়া করেনা।

প্রশ্ন: কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের নিরিখে এর মানে কি হতে পারে? এখানকার সংখ্যালঘু অধিকারের দিকে লক্ষ্য করুন। মুসলমানেরা বলছে মুসলমান হওয়ার কারণে তারা মাথা গোজার ঠাই পাচ্ছেনা। হিন্দুরা দেশটিকে দৈত্য বলে অভিহিত করছে, বিষয়টি আসলে তেমন নয়, এখানে কোন কুসংস্কার বলতে নেই। এমন মেরুকরণ পরিস্থিতিতে কিকরে প্রকাশ্য আলোচনা সম্ভব? অমর্ত্য সেন: প্রথমেই এমন পার্থক্যের মধ্যে কোন দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক তা খুঁজে বের করতে হবে, কারণ এগুলো পরস্পর বিরোধী। কোন লোক মুসলমান বলে সে বঞ্চিত হবে এ টাকি এর কারণ হতে পারে? কোন একটা কিছু খুঁজে বের করতে হবে।

বিষয়টিকে নাড়াচাড়া করার সবচেয়ে ভালো কোন উপায় বের করতে দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্য মিডিয়াকে পর্দা সরাতে হবে। আমি মনে করি এক্ষেত্রে আগেই ভুল হয়েছে। মিডিয়াকে উভয় পক্ষের কর্মকাণ্ডই স্পষ্ট করতে হবে। সংক্ষিপ্ত
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.