আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ দাঁত ভাঙ্গা লোকমান



গালে বসে থাকা মশাটা এক চড়ে চ্যাপ্টা করে দিয়ে মজনু বিরক্তির সুরে বলল, 'এই হারামজাদা মশাদের যন্ত্রণায় এক মিনিটও শান্তিতে বসতে পারছিনা। আর কতক্ষণ ওস্তাদ?' লোকমান উত্তরে কিছুই বললনা, শুধু নাক দিয়ে অদ্ভূত একটা শব্দ করল। কোমরে গুজে রাখা পিস্তলটা বের করে তার উপর আলতোভাবে হাত বুলাল। এই পিস্তল সে পাঁচ বছর আগে গাল কাটা মোখলেছের কাছ থেকে সাড়ে আট হাজার টাকায় কিনেছিল। একেবারে খাঁটি দেশী পিস্তল, কিন্তু কাজ ভাল দেয়।

এটা দিয়ে গত পাঁচ বছরে সে তিন তিনটে খুন করেছে। রাত বারটা। লোকমান এবং মজনু শহরের সবচাইতে নির্জন রাস্তার পাশে ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে আছে। আকাশে চাঁদ নেই, চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। মজনুর মত লোকমানও ভেতরে ভেতরে একধরণের তাড়া অনুভব করে।

আসছে কেন লোকটা? বদরুল কিছুক্ষণ আগে মোবাইল ফোনে জানিয়েছে কবির হোসেন লোকটা এইমাত্র দোকান বন্ধ করে রিকশায় চড়েছে। এই রাস্তা দিয়েই সে বাড়ি ফিরবে। যে রিকশায় লোকটা চড়েছে সেটা চেনার উপায়ও বদরুল বলে দিয়েছে। লোকমান অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা।

গাড়ি একেবারেই নেই; মাঝেমদ্ধে দু একটা রিকশা টুংটাং শব্দে বেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। লোকমান একটু নড়েচড়ে বসে। মশা খুব যন্ত্রণা করছে। টহল পুলিশ ঝামেলা করবে এই ভয়ে ঝোপের আড়াল থেকে বের হতে পারছেনা; মশার কামড় সহ্য করেই বসে থাকতে হচ্ছে। এভাবে বসে থাকতে থাকতে যখন তাদের অস্থিরতা চরমে পৌঁছল ঠিক তখন বেশ খানিকটা দূরে আলোর আভাস লোকমানের চোখে পড়ল।

আলোটা ধীরে ধীরে মন্থর গতিতে এগিয়ে আসছে। লোকমান চাপা স্বরে বলল, 'এসে গেছে। ' আলোটা মজনুরও চোখে পড়েছে। সে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, 'ওস্তাদ এই রিকশাতেই আছে লোকটা?' বিরক্তিতে লোকমানের ভুরু কুঁচকে গেল, বলল, 'গাধার মত প্রশ্ন করবিনা। বদরুল বলেছে কবির হোসেন লোকটা যে রিকশায় চড়েছে সেটার হ্যান্ডেলে একটা টর্চ লাইট লাগানো আছে।

ঐ যে আলো দেখা যাচ্ছে ওটা টর্চ লাইটের আলো। ' লোকমান এবং মজনু দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। মজনু কোমরে গুজে রাখা চার ইঞ্চি ব্লেডের ছোরাটা বের করে খুব সাবধানে তার ধার পরীক্ষা করে। এই ছোরা সে গত পাঁচ বছরে আপেল আর পেয়ারা কাটা ছাড়া কোন কাজে ব্যবহার করতে হয়নি, যা করার ওস্তাদ তার পিস্তল দিয়েই করেছেন। লোকমান বলল, 'বদরুল বলেছে লোকটার কাছে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা আছে।

এটা বাগালেই কেল্লা ফতে। নে, রেডি হ। ' মজনু বিড় বিড় করে বলল, 'কোন ঝামেলা না হলেই হয়। রাত-বিরেতে ঝামেলা ভাল্লাগেনা। ' 'হবে না।

' লোকমান গর্ভের হাসি হাসে, 'আমার নাম দাঁত ভাঙ্গা লোকমান। নাম শুনলেই ব্যাটা সুড় সুড় করে সব টাকা আমার হাতে তুলে দেবে। তার জানের ভয় নাই?' মজনুর মনে পড়ল বছর চারেক আগে ছিনতাই করতে গিয়ে দুজনেই ধরা পড়েছিল। পাবলিক এমন মার মেরেছিল যা সে জীবনেও ভুলবেনা। মারের ফলে ওস্তাদের সামনের সারির দুটো দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল।

সেই থেকে তার নাম হয়ে গেছে দাঁত ভাঙ্গা লোকমান। রিকশা বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে। লোকমান এবং মজনু দুজনেই রাস্তায় নেমে দুই হাত প্রসারিত করে রিকশার পথ আগলে ধরে। রিকশাওয়ালা ব্রেক কষে রিকশা থামায়। মজনু ছুটে গিয়ে রিকশাওলার শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে ড্রাইভিং সিট থেকে নামিয়ে আনে।

রিকশাওয়ালা ভীত-সন্ত্রস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রিকশার হ্যান্ডেলে লাগানো টর্চ লাইটের আলোয় সামনের সামান্য কিছু জায়গা আলোকিত, তাছাড়া পুরো এলাকাটাই ঘুটঘুটে অন্ধকার। রিকশার হুড তোলা। অন্ধকারের কারণে যাত্রীকে দেখা যাচ্ছেনা। লোকমান গম্ভীর স্বরে বলল, 'কবির হোসেন সাহেব, আপনি নেমে আসুন।

' লোকমান ভেবেছিল তার কথা শুনে লোকটা ভয়ে রিকশা ছেড়ে নেমে পড়বে, কিন্তু সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল লোকটা নামছে না। লোকমান ধমক দিয়ে বলল, 'কী, আমার কথা কানে যাচ্ছেনা? নামেন বলছি। ' রিকশাওয়ালা মিন মিন করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, মজনু তার দিকে তেড়ে গেল, হাতের ছোরা বাগিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, 'চুপ শালা, একদম চুপ। একটা কথাও বলবিনা। ' রিকশাওয়ালা চুপ হয়ে গেল।

এদিকে কবির হোসেনের নামার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছেনা। লোকমান ঠাণ্ডা হিম স্বরে বলল, 'দেখেন গায়ে হাত দিতে আমাকে বাধ্য করবেন না। আমি দাঁত ভাঙ্গা লোকমান। আমার নাম শুনলে যমও ভয় পায়। এই কাজে আমার কুখ্যাতি এবং সুখ্যাতি দুটোই আছে।

আবারও বলছি, যদি নিজের ভাল চান নেমে আসুন। অযথা ঝামেলা পাকাবেন না। একটা কথা বলে রাখি, প্রয়োজনে খুন করতেও আমার হাত কাঁপে না। আমি যদি এখানে আপনার লাশ ফেলে যাই কেউ আমার কিচ্ছু করতে পারবে না- এমনকি পুলিশও না। ' লোকমান আবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করল ভয় দেখানোর পরও লোকটা রিকশা ছেড়ে নামছেনা।

তার কথা কাজে আসছেনা ভেবে লোকমান খুব অপমানবোধ করল। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, 'মজনু যা, কুত্তার বাচ্চাকে ঘাড় ধরে নামা। ' মজনু বাম হাতে ছোরাটা ধরে ছুটে গিয়ে ডান হাত দিয়ে প্যাসেঞ্জার সিটে প্রবল বেগে একটা ঝাপটা মারে এবং সাথে সাথে একেবারে বরফের মত জমে যায়। লোকমান বলল, 'কিরে, কী হল? নামা হারামজাদাকে। ' মজনুর চোয়াল ঝুলে পড়েছে।

সে বোকার মত লোকমানের দিকে তাকিয়ে বলল, 'ওস্তাদ, রিকশা খালি!' 'মানে?' 'প্যাসিঞ্জার নাই। ' লোকমানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, অবাক হয়ে বলল, 'কী বললি! প্যাসেঞ্জার নাই?' 'না। ' লজ্জায় লোকমানের মুখ লাল হয়ে উঠে। কী লজ্জার ব্যাপার! এতক্ষণ সে একটা খালি রিকশার সাথে রাগারাগি করেছে! রিকশাওয়ালা নিশ্চই আজকের এই ঘটনা সবাইকে বলে বেড়াবে। দাঁত ভাঙ্গা লোকমান একটা খালি রিকশার সাথে চোটপাট দেখিয়ে আহাম্মক সেজেছে- এটা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করবে।

হয়ত কাল থেকে তাকে সবাই দাঁত ভাঙ্গা লোকমান না বলে আহাম্মক লোকমান বলে ডাকবে। লজ্জায় অপমানে লোকমানের চোখে পানি এসে যায়। মজনু রিকশাওয়ালার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, 'শুয়রের বাচ্চা, রিকশায় প্যাসিঞ্জার নাই আগে বললি না কেন?' রিকশওয়ালা গালে হাত বুলাতে বুলাতে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল, 'আমিতো কইতে চাইছিলাম, আপনে কইতে দেন নাই। ' মজনু রিকশাওয়ালার বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, 'ভাগ শালা। ' রিকশাওয়ালা তড়িঘড়ি করে রিকশা নিয়ে কেটে পড়ল।

মজনু মথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, 'কেলেংকারি হয়ে গেল ওস্তাদ। আজকের রাতটা মাটি। বিরাট লস। ' লোকমান একই জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল, বিড়বিড় করে বলল, 'রিকশাওয়ালা আজকের ঘটনাটা সবাইকে বলবে। ' 'সেটাতো বলবেই।

' লোকমান আগের মত বিড়বিড় করে বলল, 'লোকজন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। ' 'হাসাহাসি করবে!' মজনু হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটা ধরতে পারে। উত্তেজনায় সে শক্ত হয়ে দাঁড়াল, দৃঢ় কণ্ঠে বলল, 'তাহলে দেব নাকি শালা রিকশাওয়ালার লাশ ফেলে?' লোকমান কিছু বলল না। মজনু ওস্তাদের নিরবতাকেই সম্মতি ধরে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। রিকশা অনেক দূরে চলে গেছে।

মজনু ডান হাতে ছোরার বাঁট চেপে ধরে প্রানপণে ছুটতে লাগল। ঐ শালা রিকশায়ালা আজকের ঘটনা সবাইকে বলে বেড়াবে, লোকজন ওস্তাদকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। সে সব কিছু সহ্য করতে পারবে কিন্তু ওস্তাদের অপমান কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। কিছুতেই না। (সমাপ্ত)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।