আনন্দবতী মেয়ে আমি হাওয়ায় উড়াই চুল,চোখের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ মনের ভেতর নীল ঘাসফুল
রক্ত চাও ?
এই নাও দিলাম
হাত দাও --
বিপ্লব দিলাম ।
আর কিছু ?
আর নয় !
এই নাও দিচ্ছি মিছিল আর বিজয় ।
১৯৯০ সাল , ডিসেম্বর মাস গণতন্ত্রের জন্য উত্তাল পুরো দেশ । তাও কলেজ যাচ্ছি তীব্র নেশা পেয়ে বসেছে আড্ডা , বাস ভ্রমণ আর স্যারদের ক্লাশ । স্বৈরাচার আর গণতন্ত্র কে ঘামায় মাথা ? বরং মজাই লাগতো এসব মিটিং - মিছিল ।
৬ ডিসেম্বর মিষ্টির বন্যা কলেজ পৌঁছে দেখি । ডিগ্রী শ্রেণীর ছাত্র শাহীন ভাই আমাদের এসে বললেন "চলো সবাই মিছিলে আসো"। ঘাবড়ে গেলাম বলে কি ! সবাই দেখলাম যাচ্ছে , আমায়ও যেতে হলো । জীবনের প্রথম এবং একমাত্র মিছিলের আনন্দ নিলাম । পুরো কমলগঞ্জ থানা ঘুরলাম , দারুন মজা লাগলো ।
তারপর কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন । মিন্টু বললো আমায় মহিলা এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা পদে দাঁড়াতেই হবে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে । ও ভগবান ভালোবাসার এতো বিড়ম্বনা যে বাধ্য হলাম রাজী হতে । রাজনীতির বুঝি না কিছু । বাসা থেকে কখনোই তেমন কোনো কঠিন বাঁধা আসেনি ।
তবু নিজের থেকে মন সায় দিচ্ছিলো না । ছাত্র ইউনিয়নের বই আনলাম রিপনদার থেকে । যদিও রসহীন তবুও পড়লাম । এর কয়েকদিন পরেই কলেজে গন্ডগোল চোখের সামনে দেখলাম চিরচেনা প্রিয় বন্ধুরা ছাত্রলীগ আর ছাত্রদল এর জন্য নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে । মাথায় কি চেপে গেলো দৌঁড়ে গেলাম ওদের ঠিক মধ্যখানে গিয়ে দাঁড়ালাম ।
ওদিকে স্যারেরা চিৎকার দিয়ে যাচ্ছেন আমার নাম ধরে । কে শোনে কার কথা ! হঠাৎ মিন্টু এসে আমায় টানতে লাগলো :"চল এখানে থাকিস না । তুই কি রে ?" আমি বললাম :"ঐসব পার্টির জন্য এতো আপন কে মারবে ? হাসিনা - খালেদা ওদের আপন বেশী ?" চিৎকার করে আরো বললম "তোরা মারামারি কর আমায় মারবি তারপর সরবো । আমার বন্ধুরা এতো খারাপ হতে পারেনা । কখনোই না ।
" বেলাল ছিলো নেতা জোর করে মিন্টু আর ও আমায় সরিয়ে নিলো । প্রচন্ড জেদী আমি আবার গেলাম এবং থামালাম । বিশ্বজিৎ স্যার বলেই ফেললেন সাহসী মেয়ে । আর রায়হান স্যার বললেন এমন বোকামী যেনো না করি । তবে আনন্দের ব্যাপার হলো আমাদের নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেলো ।
বেঁচে গেলাম ।
মার্চে হলো আমাদের নবীন বরন অনুষ্ঠান । কলেজে প্রথম অনুষ্ঠান আমার "জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ" গাইলাম । সিনিয়র ক্লাশের ভাইয়া - আপুরা আমাদের বরন করার পর আমি সবার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম একটা মানপত্র তৈরী করে । এমন ভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন কেউ কখনোই করেনি ।
তার জন্য আমি পেলাম বিশাল উপহার । নবীনদের উদ্দেশ্য করে তৈরী করা মানচিত্র আমায় তুলে দেয়া হলো চিরতরে । অবাক করে দিয়ে আমাদের ক্লাশের দু'শত ছাত্র
- ছাত্রী হাত উঠিয়ে সম্মতি জানিয়েছিলো । আধুনিক গান নিয়ে মজার কথা মনে পড়ছে , আমি গেয়েছিলাম অনুপ জালোটার "ভরেনা তোমায় দেখে দেখে মন" । ক্লাসিক গান কি আর চলে চঞ্চল বয়সে ? তৃতীয় হলাম আর বিশ্বজিৎ স্যার তো রেগে অস্থির :"এই তুই মন মানেনা অথবা ও বন্ধুরে এই সব গাইলি না কেন ? এরার মাথায় কিছু আছে ওই গান বুঝার ?" হেসে ফেললাম ।
যাক "যেমন খুশী তেমন সাজ" শুরু হলো গাঁয়ের বধূ সাজলাম । থিম ছিলো গাঁয়ের বধূ পুজো দিচ্ছে
। আমি একটু অন্য ভাবে করলাম । পুজোর থালা - গ্লাস নিয়ে পুকুরে গেলাম যাবার পথে অনেক ভীড় । সব বন্ধুরা এসে ভীড় সরালো ।
তারপর শুরু হলো ওদের জ্বালাতন । আমার ছাত্র জীবনে সাজগোজ করিনি কখনোই । সবাই ওই প্রথম সাজ দেখে চমকে গেলো , অনেকে প্রেমেও যে পড়েনি তা বললেও ভুল হবে । না সামনে এসে কেউ কোনোদিন ভালোবাসি কথা বলার সুযোগ পায়নি । তবে এটা ঠিক সুযোগ দিয়েছিলাম এক জনকে , থাক তাকে আমার বন্ধু ভূবনে আনতে চাই
না ।
তবে সে আসবে পরে কোনো এক সময়ে ।
লিলি ওর জন্য নতুন কবিতা লিখতে হতো প্রতিদিন । একদিন তাড়া থাকায় দৌড়ালাম , বাসে উঠার পরই লিলি হাত বাড়ালো । লিখে না আনাতে মন খারাপ ওর
, সেই মূহুর্তে লিখলাম :
খুব ইচ্ছে করে খুব জ্বালাতে ।
কাকে জানো ?
এই হৃদয় কে ।
না তাতেও মন ভরলো না । "এতো ছোট ! আরেকটা নীলাঞ্জনা প্লিজ"।
অঙ্কুরিত হইনি এখনও
তবু মাথার 'পরে ছাদ
প্রস্ফুটিত হবার পরে
কোন বুকে থাকবো আমি ?
ভালোবাসা একেই বলে । ইচ্ছে করছে না তবুও হাসি মুখে করা । তবে সেখানে কৃত্রিমতাকেও আশ্রয় না দেয়া ।
কলেজ থেকে ফেরার পথে কুমকুম আপার বান্ধবী সুফিয়া / রোকেয়া (নাম ভুলে গেছি তবে এ দুইয়ের মাঝে অবশ্যই একজন ) আপা আমায় বললেন :"নীলা একটা কথা আছে । তোমায় একজন ভালোবাসে । সে তোমাকে চিঠি দিয়েছে । "
-----"আমি বললাম আপনি কি আপনার ছোট বোন কে এভাবে দিতে পারবেন ? যদি পারেন তবে আমি নেবো"।
তিনি ভুল বুঝতে পারলেন ।
তবে কি করে জানি সবাই জেনে গেলো সেলিম ভাইয়ের কথা । বেচারার নামই পড়ে গেলো মজনু মিয়া । শান্ত - শিষ্ট মানুষটার এই নামকরণ হলো নাসিমার থেকে । হায়রে পরে উনি সবার যন্ত্রণায় কলেজ আসাই বন্ধ করে দিলেন । করা উচিৎ ছিলো না যদিও বেশ কৌতুক করেছি তাঁকে নিয়ে আমরা সবাই ।
কুমকুম আপা একদিন বললো বিরহে পড়ে সেলিম ভাই সিঙ্গাপুর চলে গেছেন । আর যায় কোথায় তাঁর অবর্তমানে একটা সিনেম্যাটিক নামের জন্ম হলো : মজনু এখন সিঙ্গাপুরে ।
আমার কন্ঠের জোর অনেক । একদিন বাস চলে গেলো কলেজ গেট থেকে অনেকটা দূর । সবাই বলছে হায় , হায় ! এমন চিৎকার করে ডাকলাম বাস থেমে গেলো ।
সবাই বললো এরপর থেকে বাস থামানোর দায়িত্ব আমার । আরেকদিন বাসের কোনো খবর নেই । শোনা গেলো বাস - ট্রাক ধর্মঘট । কমলগঞ্জ থেকে সবাই মিলে হেঁটে শমশেরনগর । নাহ্ কষ্ট হয়নি ।
রাস্তার মালিক আমরা । গান - গল্প - হৈ - হুল্লোড়ে বিভিন্ন বাড়ি থেকে লোকজন উঁকি মেরে দেখছিলো । এভাবেই আরো একদিন ট্রাকের পেছনে ওঠার সৌভাগ্য হয়েছিলো । সেদিন তো আরো আনন্দ প্রথম ট্রাকের পেছনে ।
ওদিকে রায়হান স্যার আমার কবিতার পেছনে লেগেই আছেন ।
এই কবিতা পাঠাও , নয়তো ওটা । রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে লেখা একটা প্রবন্ধ বেশ সুনাম অর্জন করেছিলো । বিঞ্জানের ছাত্রী ছিলাম , আর্টিক্যাল লিখেছি পরজীবি , অভিস্রবণ আরো কতো কি । সবই প্রকাশিত হয়েছে স্যারের উৎসাহে । আমাদের বাসায় সব সময় দুটো পত্রিকা আসতো ইংলিশ এবং বাংলা ।
সৈয়দ আলী বাগানের পিয়ন পত্রিকা আনতো সকাল এগারোটারও পরে । একদিন নয়টার সময় দেখি মিন্টু দৌড়ে
দৌড়ে আসছে । তখন আমি বাগানে জল দিচ্ছিলাম । হাঁপাতে হাঁপাতে বললো :"তোর আরেকটা কবিতা ছাপা হয়েছে । দেখ , দেখ ।
" আমি একটু রাগ করে বললাম এমন করে কেউ দৌঁড়ায় ?পরেই তো দেখতে পারতাম" । না সে আমায় তখুনি দেখাবে । দেখলাম আমার "মূল্য" কবিতা :
যেন নদী
বাঁধ না মানা
জোয়ারে ভাসাই
পংক্তিমালা ---
আপন পৃথিবী ।
কন্ঠ নিঃসৃত সুরে ,
দু'কূল প্লাবি ,
উচ্ছ্বলতা বারংবার
অথচ কখনো বুঝিনা
ভালোবাসার দারুণ খরায়
হৃদয়ের মূল্য একটু বেশী ।
ভেবে পাইনা এখনো , কেন আমায় এতো ভালোবাসতো ওরা ? কি ছিলো আমার মাঝে ? বলতো আমার মনটা নাকি অনেক ভালো ।
আচ্ছা যদি ভালোই আমার মন , সে কেন বুঝলো না ?
নীলাঞ্জনা নীলা
ক্রমশ-----
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।