বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়ার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি চলছে। জাতীয় সংগীতের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যে স্বরলিপি ও সুর অনুমোদন করা হয়েছে, তা অনুসরণ করছেন না অধিকাংশ শিল্পী। ফলে গাইতে গিয়ে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন। এমনকি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও বিভিন্নভাবে জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছে। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও এ ব্যাপারে প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে।
অভিন্নভাবে যাতে জাতীয় সংগীত হওয়া হয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানানো হলেও কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটির প্রথম দশ লাইনকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই। আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয় স্বাধীনতার পরে। ১৯৭২ সালের
১৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে স্বরলিপিসহ জাতীয় সংগীত বিল পাস হয়। পরে সংগীতজ্ঞ সমর দাসের (প্রয়াত) তত্ত্বাবধানে ব্রিটেনের বিবিসি স্টুডিও থেকে জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রেশন তৈরি করে আনা হয়।
এই সুরই বাজানো হয় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদিতে। কিন্তু অধিকাংশ শিল্পী জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় অনুমোদিত স্বরলিপি ও সুর অনুসরণ না করে তাঁরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত গায়কী অনুসরণ করছেন। ফলে জাতীয় সংগীত গাওয়ার ক্ষেত্রে দুুটি জায়গায় ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। গানের 'চিরদিন তোমার আকাশ' অংশটি জাতীয় সংগীতের স্বরলিপি এবং তৈরি করা অর্কেস্টেশনে একবার আছে। কিন্তু শিল্পীরা গাওয়ার সময় একমাত্রা বিরতি দিয়ে দুইবার গেয়ে থাকেন।
'মা তোর মুখের বাণী' অংশে 'মুখের' শব্দটি প্রলম্বিত করে কখনোবা মাঝখানে নিঃশ্বাস নিয়ে অফবিটে 'বাণী' শব্দটি উচ্চারণ করেন শিল্পীরা। কিন্তু জাতীয় সংগীতের গৃহীত স্বরলিপিতে 'মুখের বাণী' এক সাথে রয়েছে। এই দুটি ক্ষেত্রে ভিন্নতার কারণে জাতীয় সংগীত অভিন্নভাবে গাওয়া হচ্ছে না। ফলে গাওয়ার সময় সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়েন। এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও একেক জায়গায় একেকভাবে গাওয়া হচ্ছে।
চলতি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের খেলার শুরুতেও এই ভিন্নতা লক্ষ করা গেছে। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত দুটি খেলায় রাষ্ট্রীয় অনুমোদিত স্বরলিপি অনুসরণে জাতীয় সংগীত গাওয়া হলেও ঢাকার মিরপুরে অনুষ্ঠিত খেলাগুলোতে বিশ্বভারতীর সুরে গাওয়া হয়েছে।
বিশ্বভারতী শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া গায়কীকে অনুমোদন করেছে বলে জানা গেছে। ছায়ানট ও রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের শিল্পীরা এই গায়কীকেই যথার্থ বলে মনে করেন এবং অনুসরণ করছেন। এই রীতি অনুসারে যাতে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়, এর জন্য তাঁরা তৎপরও রয়েছেন।
শিল্পীদের মধ্যে ভিন্নমতও প্রচলিত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উদীচীর সংগঠক ও গণসংগীত শিল্পী মাহমুদ সেলিম জানান, একটি গান যখন শুধু গান হিসেবে গাওয়া হয় তখন শিল্পী তাঁর দক্ষতা অনুসারে কারুকাজ ফুটিয়ে তুলবেন_এটা স্বাভাবিক। কিন্তু গানটি যখন জাতীয় সংগীত হিসেবে গীত হবে এবং কোটি কোটি মানুষ গাইবে বলে আশা করা হবে, তখন গানটি হতে হবে সহজ ও কারুকাজবর্জিত। এই সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তটিই বঙ্গবন্ধুর সরকার গ্রহণ করেছিল। এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়।
তিনি জানান, সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া এবং বিশ্বভারতী অনুমোদিত গানের সঙ্গে ৯০ শতাংশের মিল রয়েছে। সহজ এবং সবার গ্রহণযোগ্য সুরের জন্য শুধু কঠিন কারুকাজগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী তপন মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, 'জাতীয় সংগীত একটি জাতির পরিচয় ও গৌরবের প্রতীক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনো সঠিকভাবে জাতীয় সংগীত গাইতে পারছি না। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যন্ত্রসংগীতে একরকম সুর বাজছে, আবার শিল্পীরা অন্যভাবে গাইছেন_এটা কোনোভাবেই উচিত না।
' তিনি অবিলম্বে রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সভা করে এই ভিন্নতা দূর করার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত সুরটিই সবার গাওয়ার উপযোগী বলে তিনি মত দেন। তাঁরা এটি অনুসরণ করেন বলেও জানান তপন মাহমুদ।
জাতীয় সংগীত ভিন্ন ভিন্নভাবে গাওয়া প্রসঙ্গে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মজয়ন্তী পালন জাতীয় কমিটির সভায় তিনি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, জাতীয় সংগীতের একাধিক সুর থাকতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সম্মান জানিয়ে এখনই এ ব্যাপারে একটি সমাধানে আসা উচিত। তিনি বলেন, যে দুইভাবে জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছে, কোনোটাই ভুল নয়। তবে স্বরলিপি অনুসরণ করে গান করা শিল্পীদের দ্বারা সম্ভব। সাধারণ মানুষের গাওয়ার জন্য জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে সহজ সুর বেছে নেওয়া হয়েছে এটাই যথার্থ।
তবে এ ব্যাপারে একটা সমাধান প্রয়োজন।
জাতীয় সংগীতের অর্কেস্টেশন অনুমোদনের সময়ই এর সুর নিয়ে ভিন্নমত সৃষ্টি হয় বলে জানা যায়। সংগীতজ্ঞ আবদুল আহাদ (প্রয়াত) তাঁর আত্মজীবনী 'আসা-যাওয়ার পথের ধারে' (বাংলা একাডেমী, প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ১৯৮৯) গ্রন্থে লিখেছেন, "আমাদের জাতীয় সংগীতটির অর্কেস্ট্রেশনের বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিভিন্ন সরকারি পর্যায়ে বাজানোর জন্য এবং যাতে মিলিটারি ব্যান্ডে বাজাতে পারে সেজন্য ব্র্যাসব্যান্ডে এই গানটির অর্কেস্ট্রেশন খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ... রেকর্ড হয়ে যাওয়ার পর কেমন রেকর্ডিং হলো তা শোনার জন্য একটি মিটিং ডাকা হয়েছিল রেকর্ডিংয়ের ছয় নম্বর স্টুডিওতে। মিটিংয়ে তথ্যমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন এবং দুজন সেক্রেটারি তৌফিক ইমাম ও মুজিবুল হক, স্থানীয় মিলিটারি ব্যান্ডের পরিচালক, সনজীদা খাতুন, জামিল চৌধুরী এবং আমি উপস্থিত ছিলাম।
সমর দাসও উপস্থিত ছিল। 'সোনার বাংলা'র টেপটি বাজিয়ে শোনানো হলো এবং শোনার পর যে প্রতিক্রিয়া হলো তা বলার নয়। ঘোর আপত্তি উঠল যে, গানটির সুর বিকৃত করা হয়েছে। ...প্রথম দিনের মিটিং হৈচৈয়ের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। কয়েক দিন পর আবার মিটিং ডাকা হলো।
সে মিটিংয়েও একই অবস্থা। সবাই একবাক্যে বলল, সোনার বাংলার এই অর্কেস্ট্রেশন আমরা কিছুতেই অনুমোদন করব না। তাহেরউদ্দিন ঠাকুর আমাকে ডেকে নিয়ে রেডিও স্টেশনের একপ্রান্তে গিয়ে বললেন, 'আহাদ সাহেব, সরকারের অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে আর কিছু করা সম্ভব না, আপনি ঠিক আছে বলে দিন। ' মন্ত্রীর অনুরোধ এবং সরকারের অবস্থা বিবেচনা করে আমাকে সম্মতি দিতে হলো। "
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ড. সন্জীদা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে অসুস্থতার কারণে তিনি কথা বলতে পারেননি।
পরে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জাতীয় সংগীত প্রত্যেক জায়গায় যাতে একইভাবে এবং যত্ন সহকারে গাওয়া হয়, এর জন্য তাঁরা একটি রেকর্ড তৈরি করেছেন। যেটি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় বাজানো হয়েছে। ছায়ানটের সংগঠক ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পার্থ তানভীর নবেদ জানান, মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই ছায়ানটের শিল্পীরা সুচিত্রা মিত্রের গায়কীতে 'আমার সোনার বাংলা' গানটি গাইতেন। বঙ্গবন্ধু সেটিই শুনেছিলেন এবং সেটিকেই জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু অর্কেস্ট্রেশন তৈরির সময় সেটিকে অনুসরণ করা হয়নি।
বর্তমান সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা অবমাননা-সংক্রান্ত আইন পাস হয়েছে। কিন্তু তা যথাযথভাবে অনুসরণ হচ্ছে কি না এ ব্যাপারে কোনো তদারকি লক্ষ করা যাচ্ছে না। আজিজুল পারভেজ
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়ার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি চলছে। জাতীয় সংগীতের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যে স্বরলিপি ও সুর অনুমোদন করা হয়েছে, তা অনুসরণ করছেন না অধিকাংশ শিল্পী। ফলে গাইতে গিয়ে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন।
এমনকি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও বিভিন্নভাবে জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছে। এটা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও এ ব্যাপারে প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। অভিন্নভাবে যাতে জাতীয় সংগীত হওয়া হয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানানো হলেও কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটির প্রথম দশ লাইনকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই। আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয় স্বাধীনতার পরে।
১৯৭২ সালের
১৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে স্বরলিপিসহ জাতীয় সংগীত বিল পাস হয়। পরে সংগীতজ্ঞ সমর দাসের (প্রয়াত) তত্ত্বাবধানে ব্রিটেনের বিবিসি স্টুডিও থেকে জাতীয় সংগীতের অর্কেস্ট্রেশন তৈরি করে আনা হয়। এই সুরই বাজানো হয় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদিতে। কিন্তু অধিকাংশ শিল্পী জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় অনুমোদিত স্বরলিপি ও সুর অনুসরণ না করে তাঁরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত গায়কী অনুসরণ করছেন। ফলে জাতীয় সংগীত গাওয়ার ক্ষেত্রে দুুটি জায়গায় ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে।
গানের 'চিরদিন তোমার আকাশ' অংশটি জাতীয় সংগীতের স্বরলিপি এবং তৈরি করা অর্কেস্টেশনে একবার আছে। কিন্তু শিল্পীরা গাওয়ার সময় একমাত্রা বিরতি দিয়ে দুইবার গেয়ে থাকেন।
'মা তোর মুখের বাণী' অংশে 'মুখের' শব্দটি প্রলম্বিত করে কখনোবা মাঝখানে নিঃশ্বাস নিয়ে অফবিটে 'বাণী' শব্দটি উচ্চারণ করেন শিল্পীরা। কিন্তু জাতীয় সংগীতের গৃহীত স্বরলিপিতে 'মুখের বাণী' এক সাথে রয়েছে। এই দুটি ক্ষেত্রে ভিন্নতার কারণে জাতীয় সংগীত অভিন্নভাবে গাওয়া হচ্ছে না।
ফলে গাওয়ার সময় সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়েন। এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও একেক জায়গায় একেকভাবে গাওয়া হচ্ছে। চলতি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের খেলার শুরুতেও এই ভিন্নতা লক্ষ করা গেছে। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত দুটি খেলায় রাষ্ট্রীয় অনুমোদিত স্বরলিপি অনুসরণে জাতীয় সংগীত গাওয়া হলেও ঢাকার মিরপুরে অনুষ্ঠিত খেলাগুলোতে বিশ্বভারতীর সুরে গাওয়া হয়েছে।
বিশ্বভারতী শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া গায়কীকে অনুমোদন করেছে বলে জানা গেছে।
ছায়ানট ও রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের শিল্পীরা এই গায়কীকেই যথার্থ বলে মনে করেন এবং অনুসরণ করছেন। এই রীতি অনুসারে যাতে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়, এর জন্য তাঁরা তৎপরও রয়েছেন। শিল্পীদের মধ্যে ভিন্নমতও প্রচলিত রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উদীচীর সংগঠক ও গণসংগীত শিল্পী মাহমুদ সেলিম জানান, একটি গান যখন শুধু গান হিসেবে গাওয়া হয় তখন শিল্পী তাঁর দক্ষতা অনুসারে কারুকাজ ফুটিয়ে তুলবেন_এটা স্বাভাবিক। কিন্তু গানটি যখন জাতীয় সংগীত হিসেবে গীত হবে এবং কোটি কোটি মানুষ গাইবে বলে আশা করা হবে, তখন গানটি হতে হবে সহজ ও কারুকাজবর্জিত।
এই সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তটিই বঙ্গবন্ধুর সরকার গ্রহণ করেছিল। এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। তিনি জানান, সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া এবং বিশ্বভারতী অনুমোদিত গানের সঙ্গে ৯০ শতাংশের মিল রয়েছে। সহজ এবং সবার গ্রহণযোগ্য সুরের জন্য শুধু কঠিন কারুকাজগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী তপন মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, 'জাতীয় সংগীত একটি জাতির পরিচয় ও গৌরবের প্রতীক।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনো সঠিকভাবে জাতীয় সংগীত গাইতে পারছি না। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যন্ত্রসংগীতে একরকম সুর বাজছে, আবার শিল্পীরা অন্যভাবে গাইছেন_এটা কোনোভাবেই উচিত না। ' তিনি অবিলম্বে রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সভা করে এই ভিন্নতা দূর করার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত সুরটিই সবার গাওয়ার উপযোগী বলে তিনি মত দেন। তাঁরা এটি অনুসরণ করেন বলেও জানান তপন মাহমুদ।
জাতীয় সংগীত ভিন্ন ভিন্নভাবে গাওয়া প্রসঙ্গে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মজয়ন্তী পালন জাতীয় কমিটির সভায় তিনি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, জাতীয় সংগীতের একাধিক সুর থাকতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সম্মান জানিয়ে এখনই এ ব্যাপারে একটি সমাধানে আসা উচিত। তিনি বলেন, যে দুইভাবে জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছে, কোনোটাই ভুল নয়।
তবে স্বরলিপি অনুসরণ করে গান করা শিল্পীদের দ্বারা সম্ভব। সাধারণ মানুষের গাওয়ার জন্য জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে সহজ সুর বেছে নেওয়া হয়েছে এটাই যথার্থ। তবে এ ব্যাপারে একটা সমাধান প্রয়োজন।
জাতীয় সংগীতের অর্কেস্টেশন অনুমোদনের সময়ই এর সুর নিয়ে ভিন্নমত সৃষ্টি হয় বলে জানা যায়। সংগীতজ্ঞ আবদুল আহাদ (প্রয়াত) তাঁর আত্মজীবনী 'আসা-যাওয়ার পথের ধারে' (বাংলা একাডেমী, প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ১৯৮৯) গ্রন্থে লিখেছেন, "আমাদের জাতীয় সংগীতটির অর্কেস্ট্রেশনের বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিভিন্ন সরকারি পর্যায়ে বাজানোর জন্য এবং যাতে মিলিটারি ব্যান্ডে বাজাতে পারে সেজন্য ব্র্যাসব্যান্ডে এই গানটির অর্কেস্ট্রেশন খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
... রেকর্ড হয়ে যাওয়ার পর কেমন রেকর্ডিং হলো তা শোনার জন্য একটি মিটিং ডাকা হয়েছিল রেকর্ডিংয়ের ছয় নম্বর স্টুডিওতে। মিটিংয়ে তথ্যমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন এবং দুজন সেক্রেটারি তৌফিক ইমাম ও মুজিবুল হক, স্থানীয় মিলিটারি ব্যান্ডের পরিচালক, সনজীদা খাতুন, জামিল চৌধুরী এবং আমি উপস্থিত ছিলাম। সমর দাসও উপস্থিত ছিল। 'সোনার বাংলা'র টেপটি বাজিয়ে শোনানো হলো এবং শোনার পর যে প্রতিক্রিয়া হলো তা বলার নয়। ঘোর আপত্তি উঠল যে, গানটির সুর বিকৃত করা হয়েছে।
...প্রথম দিনের মিটিং হৈচৈয়ের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। কয়েক দিন পর আবার মিটিং ডাকা হলো। সে মিটিংয়েও একই অবস্থা। সবাই একবাক্যে বলল, সোনার বাংলার এই অর্কেস্ট্রেশন আমরা কিছুতেই অনুমোদন করব না। তাহেরউদ্দিন ঠাকুর আমাকে ডেকে নিয়ে রেডিও স্টেশনের একপ্রান্তে গিয়ে বললেন, 'আহাদ সাহেব, সরকারের অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে আর কিছু করা সম্ভব না, আপনি ঠিক আছে বলে দিন।
' মন্ত্রীর অনুরোধ এবং সরকারের অবস্থা বিবেচনা করে আমাকে সম্মতি দিতে হলো। "
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ড. সন্জীদা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে অসুস্থতার কারণে তিনি কথা বলতে পারেননি। পরে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জাতীয় সংগীত প্রত্যেক জায়গায় যাতে একইভাবে এবং যত্ন সহকারে গাওয়া হয়, এর জন্য তাঁরা একটি রেকর্ড তৈরি করেছেন। যেটি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় বাজানো হয়েছে। ছায়ানটের সংগঠক ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পার্থ তানভীর নবেদ জানান, মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই ছায়ানটের শিল্পীরা সুচিত্রা মিত্রের গায়কীতে 'আমার সোনার বাংলা' গানটি গাইতেন।
বঙ্গবন্ধু সেটিই শুনেছিলেন এবং সেটিকেই জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু অর্কেস্ট্রেশন তৈরির সময় সেটিকে অনুসরণ করা হয়নি।
বর্তমান সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা অবমাননা-সংক্রান্ত আইন পাস হয়েছে। কিন্তু তা যথাযথভাবে অনুসরণ হচ্ছে কি না এ ব্যাপারে কোনো তদারকি লক্ষ করা যাচ্ছে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।