আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমেরিকার রাজনীতি -- ভাড়াটে গুন্ডার স্বীকারোক্তি

জাল পেতে চিন্তা শিকার

লেখাটি জন পার্কিন্সের দ্যা কনফেশনস অফ এন ইকনমিক হিট ম্যানের সার সংক্ষেপ। বইটাতে একজন অনুতপ্ত খুনির স্বীকারোক্তি পাওয়া যাবে। সে আবার 'ইকনমিক', সেটা কেমন? লেখক বইয়ের প্রথম পাতাতেই একটা সংগা দিয়ে রেখেছেন। আমাদের রাজনীতিকেরা যেমন কালা জাহাঙ্গীর, মুরগী মিলন বা সুব্রত বায়েনদের তৈরি করেছেন করছেন তেমনি সম্রাজ্যবাদের ক্ষমতা বিস্তারেও এই রকমের গুন্ডা পুষতে হয়। এই ইকনমিক গুন্ডারা তার মধ্যে একটা ধরন।

গুন্ডার পরিচয় আমেরিকার অর্থনীতিবিদ জন পার্কিন্স আমেরিকার নানা শান্তি মিশনে কাজ করেন। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্বব্যপি আমেরিকার সম্রাজ্য বিস্তারের কালা-কানুন ভেতর থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন এবং সক্রিয়ভাবে তাতে নিয়োজিতও ছিলেন। অবশ্য যেটা একসময় একটা নিছক চাকরি ছিল সেটাই এক পর্যায়ে একজন উচ্চবেতনে পালিত ভাড়াটে গুন্ডার কাজ হিসাবে স্পষ্ট হতে থাকে তার কাছে। এই সুবাদে তিনি আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে সাহায্য করতেন। বিভিন্ন দেশের নেতাদের কব্জিতে মোচড় দিয়ে আমেরিকার অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে বাধ্য করতেন আর সেসাথে বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে লোভনীয় প্রকল্প বাগিয়ে দিতেন।

তিনি ১০ বছর এই কাজে ছিলেন। পরে বিবেকের তাড়নায় চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি ছেড়ে তিনি একটা এনার্জি কম্পানি প্রতিষ্টা করেন এবং কিছুটা আশাতীত সাফল্য পান। বুঝতে পারেন চুপ থাকার পুরষ্কার হিসাবেই এই সাফল্য আসছে। তারপর তিনি আশির দশকের শেষদিকে এই তার প্রতিষ্ঠানটিও বিক্রি করে দেন।

এরপর থেকে তিনি ইকুয়েডর এবং বিশ্বের নানা দেশে এনজিওর নানারকম উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হন। এখানেও তিনি পরোক্ষভাবে ঘুষ পেতেন এবং ঘুষের ব্যপারে তার বইতে তার স্পষ্ট স্বিকারোক্তি রয়েছে। কিন্তু ৯/১১ এর পর তিনি মুখ খোলাকে জরুরী মনে করেন। পার্কিন্স সাহেব তার স্বীকারোক্তিকে ২০০৬ সালে তিনি শেষমেশ প্রকাশ করলেন "Confessions of an Economic Hit Man" বইয়ের আকারে। অর্থনীতির সাথে রাজনীতির মিশেলে সম্রাজ্যবাদি শক্তি কিভাবে তাদের কাজ হাসিল করে সে বিষয়ে যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন সেটা প্রচলিত বিশ্বাসকে নিশ্চিত করে।

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউলিয়াম ইস্টারলি বিস্তর লেখা লেখি করেছেন পশ্চিমা বিশ্বের অর্থ সাহায্যের সমালোচনা করে। তিনি নিজেই বিশ্ব ব্যঙ্কে কাজ করেছেন প্রায় ১২ বছর। কিন্তু সেখানে আলোচনাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধরে নেয়া হচ্ছে যে সেগুলোতে অনুন্নত বিশ্বের উন্নয়নে পশ্চিমা দুনিয়া আন্তরিক। কিন্তু পশ্চিমা সাহায্য অনেক ক্ষেত্রে উপকার না করে বরং ক্ষতিই করছে পদ্ধতিগত ভুলের কারনে এমনটা ইস্টারলি সাহেব দেখাতে চেয়েছেন। একজন একাডেমিক হবার দরুন ইস্টারলির লেখা হয়ত বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে অনেক আকর্ষনিয় এবং সুখপাঠ্য।

সেদিক থেকে পার্কিন্স ভাল লেখন না হলেও তার লেখার স্বিকারোক্তির অংশটা গুরুত্বপূর্ণ। একজন আমেরিকার হয়েও দেশের পররাষ্ট্র কার্যক্রমের বিরুদ্ধে লেখার পক্ষে তার যুক্তি এরকমঃ "আমার একমাত্র মেয়ে জেসিকা কলেজের গন্ডি পেরিয়েছে। জগতকে নিজের মত করে বুঝতে শিখেছে। কিছুদিন আগে জেসিকার কাছে বইটি প্রকাশের ব্যপারে মত জানতে চাইলাম এবং আমার শঙ্কার বিষয়গুলো জানালাম। সে বলল "দুশ্চিন্তা করনা বাবা।

তোমার যদি কিছু হয়ে যায় তোমার অসমাপ্ত কাজ আমি শেষ করব। ভবিষ্যতে তোমাদের কোলে আমি হয়ত নাতি-পুতিদের তুলে দেব; তাদের কথা মনে করেই এটা করা দরকার। " একজন ইকনমিক হিটম্যানকে পার্কিন্স সংজ্ঞায়িত করেন এভাবেঃ অভাগুরা হচ্ছে উচ্চবেতন ভোগী পেশাজিবি যারা ট্রিলিয়ন ডলারের ফাঁদে ফেলে সারাবিশ্বের নানা দেশের সাথে প্রতারনা করার কাজে জড়িত। এই প্রতারনার জন্য তারা বিশ্বব্যঙ্ক, ইউএসএইড বা এরকম দাতা সংস্থাগুলোথেকে বিশাল অঙ্কের টাকা বড় বড় কর্পোরেশন বা পাকৃতিক সম্পদের দখলদাল মূষ্টিমেয় পরিবারের পকেটে পূরে দেয়। তাদের বহুল ব্যবহৃত অস্ত্রের ভেতরে ছিল ভাওতামার্কা আর্থিক প্রতিবেদন, ভোট কারচুপি, ঘুষ, যৌনতা এবং খুন।

তাদের এই খেলার ইতিহাস আসলে সম্রাজ্যবাদিতার ইতিহাসের মতই পুরান। কিন্তু বিশ্বায়নের সুবাদে এই খেলা এখন এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ১৯৮২ সালে পার্কিন্স সাহেব যখন বইটি লেখার কাজ করছিলেন তখন তিনি এই সংগাটিও লেখেন আর তখন তিনি ভাবছিলেন বইটিকে উৎসর্গ করবেন ইকুয়েডরের রাষ্ট্রপতি জেইম রল্ডো আর পানামার রাষ্ট্রপতি ওমার টরিযোর নামে। এরা দুজনই তার স্বীকারোক্তি মতে ভারাটে গুন্ডাদের শিকার। তবে এখানে ভারাটে গুন্ডাদের কাজের ক্ষেত্র ভাগ করা আছে।

পার্কিন্স সাহেবের ভাষায়, এদের দু'জনের মৃত্য দুর্ঘটনা ছিলনা। তাদেরকে অভাগুরা তাদের সম্রাজ্যবাদি পরিকল্পনায় রাজি করাতে পারলনা তখন সিআইয়ের গুন্ডারা এগিয়ে আসল। এরা সাধারনত অভাগুদের পেছনেই থাকে। দরকার হলে কাজে নামে। অর্থাৎ তিনি অভিযোগ করছেন এই দুই প্রেসিডেন্টের মৃত্যু আসলে আমেরিকার চক্রান্ত! এরকম আরো উদাহরন আছে বইতে আর উপরের ভিডিও জবানিতে।

বড় শক্ত স্বীকারোক্তি। পার্কিন্স সাহেবে দুঃসাহসের তারিফ করতেই হয়। এখন কথা হচ্ছে এই দুইধরনের কৌশলে কাজ না হলে আমেরিকা কি করে? পার্কিন্স সাহেবের মতে প্রথম দুই ধাপে কাজ না হলে অর্থাৎ অভাগুরা আর সিয়াইয়ের গুন্ডারা যদি ব্যর্থ হয় তখন সরাসরি যু্দ্ধে নামে আমেরিকা, যেমনটা ঘটেছে ইরাক বা আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে। পার্কিন্স সাহেবের অভাগু ক্যরিয়ারের প্রথম বস, ক্লডিনের সাথে তার আলাপ চারিতার কিছু অংশ এখানে তুলে দিতে চাই। ক্লডিন বলছে, "আমার কাজ হল তোমাকে একজন দক্ষ অভাগু হিসাবে গড়ে তোলা।

তোমার কাজ সম্পর্কে কেউ জানতে পারবে না, এমনকি তোমার স্ত্রীও না"। ক্লডিন তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে "একবার এই পেশার ঢুকলে তা সারা জীবনের জন্য"। এখন দেখি তার বস ক্লডিন তার কাজ সম্পর্কে তাকে কিভাবে সবক দিচ্ছেন। ক্লডিন বলছে "তোমার কাজ হবে আমেরিকার বানিজ্য স্বার্থের সাথে যেই নেটওয়ার্ক জড়িত তাতে যুক্ত হতে বিশ্বের নেতাদেরকে রাজি করানো। একপর্যায়ে তারা ঋনের দায়ে এমনই ঋজু হয়ে যাবে যাতে তারা আমাদের অনুগত্য অস্বিকার করতে পারবে না।

তারপর আমরা তাদেরকে আমাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বা সামরিক উদ্দ্যেশ্য পুরনের জন্য এদেরকে ব্যবহার করতে পারব। অন্য দিকে তারা তাদের দেশে আমাদের পয়সায় শিল্প নগরী, বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র, বিমান বন্দর এসব তৈরি করে নিজ নিজ দেশের মানুষের মধ্যে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আর অন্যদিকে আমাদের প্রকৌশলি বা কন্সট্রাকশন কম্পানিগুলো আরো সম্পদশালি হয়ে উঠবে"। ক্লডিন সম্পর্কে পরে আরো লেখার ইচ্ছা আছে। এখানে সম্রাজ্যবাদি শক্তির কৌশলগত দিক গুলো লক্ষ্য করে অবাক হতে হয়।

এই চক্র ভাঙ্গা সহজ নয়। দেখা যাচ্ছে এই প্রক্রিয়াতে বিশ্বব্যপি রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয়রা একটা মেশিনের দ্বারা চালিত। পুজিবাদ আর সম্রাজ্যবাদের যুগল আবিষ্কার এই মেশিন। এখানে ব্যক্তিগত সততার তেমন কিছু করার থাকে না। আমেরিকার একজন প্রেসিডেন্ট সেও এই মেশিনের চক্রে বন্দি।

কেননা বাইরে থেকে টাকা বা ব্যবসার রসদ এনে দিতে না পারলে তার পার্টিতো নির্বাচন প্রচারনার টাকাও পাবে না। অবশ্য বলা হয় ওবামার নির্বাচনি খরচ নির্বাহে কর্পোরেট চক্র থেকে আসা টাকার ভাগ অনেক কম। নির্বাচনে তার জয় হয়ত একটা মাইলফলক, কিন্তু পার্কিন্স সাহেবের বর্ণনায় আমরা যে মেকানিজম বা প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হই সেটা থেকে বেরিয়ে আসা বড় কঠিন। পার্কিন্স সাহেব বিশ্বব্যপী সন্ত্রাসবাদের বিকাশে এই ব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন। তবে আমি তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলনগুলোকে, একাডেমিক চেচামেচিকে, পত্রিকা ব্লগে লেখালেখি এসব চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতে চাই।

কারন এই বাঁধাগুলো না থাকলে আসলে সম্রাজ্যবাদ আরো কঠিন আকার নিত। তারপরও একটা ভাবনা মনে উঁকি দিতেই থাকে আমরা কি আসলে উপনিবেশিক ইতিহাসকে ছাপিয়ে উঠতে পেরেছি? বৃটিশরা চলে গেছে, চলে গেছে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু বিশ্বব্যপি সম্রাজ্যবাদের এখনকার চরিত্র কিন্তু আরো ভয়াল। কারন এটাকে দেখা যায় না। শ্ত্রুকে শত্রু হিসাবে চেনা যায় না।

বন্ধুকেও বিশ্বাস করা যায় না। তার চেয়ে বড় হচ্ছে নিজের ভেতরেই আমরা তৈরি করেছি আত্মবিধ্বংসী শক্তি। এগুলো নিয়ে পরে বিশদ আলচনার ইচ্ছা আছে। যাহোক সম্রাজ্যবাদি মেশিনের কাজের ফল কি দাড়াচ্ছে তা পার্কিন্স সাহেবের মুখেই শুনি, আমাদের (অর্থাৎ আমেরিকার) অনেক নামজাদা প্রতিষ্ঠানে নামমাত্র বেতনে কর্মিদেরকে পাওয়া যাচ্ছে যারা ওই স্বল্পবেতনে মানবেতর পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হয়। তেল কম্পানিগুলো ইচ্ছা করেই রেইন ফরেস্টের নদীতে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে মানুষ, প্রানী, গাছপালা আর বন্য পরিবেষকে ধংস করছে, আদিবাসিরা শিকার হচ্ছে গনহত্যার।

ওষুধ শিল্প আফ্রিকার লাখ লাখ এইডসে আক্রান্ত জনগোষ্ঠিকে জীবন রক্ষাকারি ওষুধ সরবরাহ আটকে দিয়েছে। এই আমেরিকার মাটিতেই এক কোটি বিশ লক্ষ্য পরিবার কপর্দকহীন। এনার্জি খাতে আমরা পাচ্ছি এনরন আর হিসাব খাতে এন্ডারসনের মত প্রতিষ্ঠান। ধনীদেশগুলোতে বাস করা বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ ধনী লোকেদের আয় আর বিশ্বর এক পঞ্চমাংশ দরিদ্রতম লোকেদের আয়ের অনুপাত ৩০ থেকে ৭৪ এ উঠে এসেছে। আমেরিকা ইরাক যুদ্ধে ৮৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, কিন্তু ইউনাইটেড নেশন্সের হিসাব অনুযায়ী এর অর্ধেকেরো কম টাকায় এই পৃথবীর সব মানুষের জন্য নিরাপদ পানি, যথেষ্টা খাবার আর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়।

এর পর এই ফলাফল গুলোর সাথে পার্কিন্স সাহেব সন্ত্রাসবাদের সম্পর্কে আলোচনা করছেন। তিনি মনে করেন সন্ত্রাসবাদকে একটা ষড়যন্ত্র মনে করাটা একটা ভুল। কারন সেক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের হোতাদের আটকাতে পারলেই এর মূলোৎপাটন করা যেত। কাজেই সন্ত্রাসবাদের শিকড়টি আরো গভীর এবং ষড়যন্ত্রের চেয়েও মারাত্মক এবং ভয়াবহ। এর উৎপত্তি হচ্ছে একটা ধারনা বা বিশ্বাসের মধ্যে।

এখন প্রতিটি বিশ্বাসেরই তো একটা কলেমা বা মূল বক্তব্য এবং কিছু অনুবক্তব্য থাকে। এই বিশ্বাসে ক্ষেত্রে সেই বক্তব্য কি? পার্কিনসের বর্ণনামতে "অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সব সময়ে সব আকারেই মানব সভ্যতার জন্যে মংগলের। এই প্রবৃদ্ধি বা গ্রোথ যত বেশি বুঝতে হবে মানুষের উপকারও তত বেশি হচ্ছে। " এই বক্তব্য থেকে আবার একটা অনুবক্তব্যও আসে, যেমন "যারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রসদ যোগার করতে পেড়েছে তারাই সম্মান আর পুরষ্কারের যোগ্য আর প্রান্তিকেরা হবে শোসিত"। গল্প হলেও সত্যি? কে কি বলে? এরকম বোমার মত স্বীকারোক্তি! বিশ্বাস করব? নাকি এই পার্কিন্স ভদ্রলোক নিজেকে মনযোগের কেন্দ্রে আনার জন্য এমনটা করছেন? বলা কঠিন।

এনিয়ে কিছু মতামত হাজির করার চেষ্টা করছি। এই বইয়ের পরেও পার্কিন্স সাহেব বিস্তর লেখালেখি করেছেন যাতে তার স্বীকারোক্তি নানা মাত্রায় হাজির হয়েছে। এটা নিয়ে ডকুমেন্টারিও তৈরি হয়েছে। কিন্তু অনেকেই তার এই গল্পকে অস্বিকার করেছেন। প্রথমে আমেরিকান সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্টেরর বক্তব্য দেখি।

তারা সরাসরি এই অভিযোগ অস্বিকার করেছে (লিঙ্ক) এবং পার্কিন্স সাহেবের লেখাকে কল্পকাহিনি হিসাবে উল্লেখ করেছে। অন্যদিকে পার্কিন্স সাহেব বলছেন তিনি যখন প্রথম বইটি প্রকাশ করার জন্য একজন প্রকাশকের সাথে কথা বলেন তাকে পরামর্শ দেয়া হয় এটাকে কল্পকাহিনী হিসাবে লিখতে। কিন্তু তিনি মনে করেন এর প্রতিটি মুহূর্ত যেহেতু তার জীবনে সত্যি কাজেই এটাকে সত্যির আকারেই প্রকাশ করা উচিত গল্প আকারে নয়। তার এই গল্পটি সত্য কি মিথ্যা অথবা কতটুকু মিশেল সেটা বলা কঠিন। তবে সম্রাজ্যবাদিতার একটা দুষ্ট চক্র যে কোন না কোন ভাবে নিরবে কাজ করে যাচ্ছে সে এটা হয়ত অনেকেরই মনে হয়।

বইটিকে আমরা আত্মজীবনিই বলতে পারি। গল্পের ভাষায় সত্যকে যত কাছ থেকে জীবন্ত রূপে দেখা যায় অনেক সময় পাঠ্য বই বা দারুন বিশ্লেষনি বই থেকেও সেই স্বাদ পাওয়া যায় না; বুদ্ধির দেয়ালে হয়ত একটা মৃদু টোকা দেয়া হয়, ধাক্কা দেয়া হয় না, গল্প সেটা পারে। তাই প্রায়ই নিজের গল্প লেখার অক্ষমতা নিয়ে আফসোস হয়। এখন পর্যন্ত যা লিখলাম তাকে বইটির একটি অতি ছোট-খাট সারাংশ-কাম রিভিউ ভাবতে পারেন। এই গল্প শুনে আমাদের কি দরকার? বাংলাদেশের ইতিহাসেও বিভিন্ন সময়ে যে আমাদের রাজনীতিকদের কবজি মুচরে আমজনতাকে ঘোল খাইয়ে যায় নি অভাগুরা তার কি গ্যারেন্টি আছে? অথবা তারা যে এখন তৎপর না তারই বা কি নিশ্চয়তা? তাছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে যেসব রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটেছে সেগুলোর চরিত্রই বা আমরা কতটুকু জানি? এই এক যায়গায় এসে বাংলাদেশের বাম রাজনিতির চেচামেচিকে বা রাস্তায় পড়ে মার খাওয়াকে বিফল মনে হয়না।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মার্ক্সবাদের প্রভাব বাজার অর্থনীতির প্রভাবের চেয়ে শক্ত। আস্তে আস্তে হয়ত এমনটা কমে আসবে। কিন্তু রাস্তার উপর চেচামেচির দরকার আছে। অন্তত পার্কিন্স সাহেবের গল্প পড়ে তাই মনে হয়। এজন্য গনতন্ত্রকেও সাধুবাদ, রাস্তার পাশে চেচামেচি করে মার খাওয়া বাম ভাবধারার কর্মীদের সাধুবাদ।

মনে পড়ছে এরশাদ সাহেবের আমলে প্রচুর রাস্তাঘাট তৈরির কথা। এরশাদের ব্যপারে যখন কথা ওঠে তখনই বলা হয় তার সময়ে যত রাস্তাঘাট তৈরি হয়েছে এমনটা আগে হয়নি। কথা হয়ত সত্যি কিন্তু এই গল্প পড়ে বোঝা যাচ্ছে এতে আহ্লাদিত হবার আসলে কিছু নেই। মূল কথা বলা হয়ে গেছে উপরেই এবার, একটু বিস্তারিততে যাব। যাদের আগ্রহ আছে তাদের জন্য পরের পর্বে বইয়ের ভেতর থেকে আরেকটু বিবরন হাজির করব।

গল্পের শুরুতে পার্কিন্স সাহেব ইকুরেডরের রাজধানী কুইটোতে ২০০৩ সালে বসে অতীত কৃতিকর্মের স্মৃতিচারন করছেন। সেখানকার ভূপ্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক বৈচিত্র আর নিসর্গের সৌন্দর্যের বর্ণনা করছেন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে উঠে এসেছে ইকুয়েডরের প্রতি তার অপরাধবোধ। তিনি এখন যে সব কার্যক্রমের সাথে জড়িত এটা এক ধরনের প্রায়শ্চিত্যের চেষ্টা। বিগত ৩৫ বছরে এখানে যা পরিবর্তন হয়েছে তার জন্য তার মত অভাগুদের একটা বিরাট ভূমিকা আছে।

ইকুয়েডরের পরিবেশ আর অর্থিনীতির বিপর্যয়ের স্বরূপ বর্ণনার করতে পার্কিন্স সাহেব এক যায়গায় বলছেন আমার মত অভাগুদের কল্যানে আজকের (২০০৩ সালের) ইকুয়েডর আমরা অধুনিক অর্থনীতি, ব্যঙ্কিং আর প্রকৌশল নিয়ে আসার ইকুয়েডরের চেয়ে অনেক নিচে পড়ে গেছে। ১৯৭০ সালের পরের যে সময়টাকে অয়েল বুম বলা হত তখন রাষ্ট্রীয় হিসবেই দারিদ্রের হার ৫০% থেকে বেড়ে ৭০% হয়েছে, সরকারের দেনা ২৪০ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর সরকারের বরাদ্দ ২০ ভাগ থেকে কমে ৬ ভাগে এসে ঠেকেছে। ইকুয়েডরের লক্ষ লক্ষ লোক আর বাকি পৃথিবীর কোটি কোটি লোক এই সব অভাগুদের জন্যই সম্ভব্য সন্ত্রাসি। কমিউনিস্ট আদর্শ, আরজকতার প্রতি সহজাত আকর্ষন বা স্বভাব জাত মন্দ ধারা এর কোনটাই এর জন্য দায়ী নয়।

এরা সন্ত্রাসী হবে কারন এদের আর কোন উপায় নেই। এমাজনের তলায় সঞ্চিত তেলের খনিই হয়ত ইকুয়েডরের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী। অল্প কিছু ধনাঢ্য পরিবারকে টাকা দিয়ে অভাগুরা তেল কম্পানীর কাছে বেঁচে দেয় এমাজনের বনাঞ্চল। আর সেখানত থেকে দুষিত তেল নিঃসরনের মাত্রা বিশ্বের জানা অনেক বড় মাত্রার নিঃসরনকে ছাড়িয়ে গেছে। যেমন এক্সন ভেলদের ক্ষেত্রে যে মাত্রার স্পিলোভার ঘটেছে ইকুয়েডরের ক্ষেত্রে এই উপচে পড়া তেলের পরিমান তার দ্বিগুনেরো বেশি।

তবে কেবল ইকুয়েডর নয় পৃথিবীর যে দেশই আমেরিকার সম্রাজ্যবাদের ছাতার নিচে এসেছে তাদের সবার পরিনতি কম বেশি একই রকম হয়েছে। বাংলাদেশের গ্যাস আর কয়লা নিয়েও নানা রকম ঢাক ঢাক গুর গুরু শোনা যায়। এর মধ্যে যে এরকম ব্যাপার নেই সেটা কি মনে হয়?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.