এ-মন একবারই ছুঁয়ে যেতে পারে কেউ...
আমাদের ফ্ল্যাটের চার তলার বাসিন্দার রুথ মারা গেছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রুথের ফ্যামিলি ডাক্তার ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখতে পায় সে গালে হাত দিয়ে প্যাসিজে বসে আছে, পা দু’টি দু'দিকে ছড়ানো। রুথের ঘরের দরজা খোলা ছিল, তবে দরজাটা একটু গোছানো ছিল বলে পাশের ঘরের বাসিন্দা জস বা তার মা কেউই কিছুই টের পায়নি।
গত বৃহস্প্রতিবার রুথের ফ্যামিলি ডাক্তার যখন রুথের ফ্ল্যাটে ঢুকার জন্য নিচে থেকে লক করছিলো, তখন ফ্ল্যাটের মেইন দরজা কেউ খুলে দেয়নি। ডাক্তার কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করার পর রুথের পাশের ঘরের বাসিন্দা জস্ নিচে এসে ফ্ল্যাটের মেইন দরজা খুলে দিয়েছিল এবং ডাক্তার উপরে আসার পর ঝসের মা এগিয়ে যান।
ডাক্তার ও জসের মা দু’জনেই রুথের দরজায় লক করতে গিয়ে একটু জোরে ধাক্কা দিয়ে দেখে দরজা খোলা। আর দরজার সামনেই দেয়ালে হেলান দিয়ে নিথর দেহে বসে আছে রুথ। ঐ অবস্থায় রুথকে দেখা মাত্রই ডাক্তার জেনে গেলেন রুথ আর পৃথিবীতে আর বেঁচে নেই। তাড়াতাড়ি পুলিশকে ফোন করা হলো। চার জন পুলিশ সারাদিন রুথের ফ্ল্যাটে ছিল, রাতে তার মরদেহ এ্যাম্বুল্যান্স করে নিয়ে গেল হাসপাতালে।
ডাক্তারের ভাষ্য অনুযায়ী রুথ মারা গেছে তার ফ্ল্যাটে দু’দিন আগে। এখানে ওর আপনজন বলতে কেউ নেই । এক বোন আছে থাকে ইয়র্কশায়ার, ডাক্তারের সার্জারিতে সেই না-কি ফোন করে বলেছিল তার বোন রুথ ফোন ধরছে না, মনে হয় সে অসুস্থ। কারণ কয়েকদিন পূর্বে রুথ ফোনে তার বোনকে বলেছিল তার শরীরটা ভাল নেই, এরপর আর তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়নি। ডাক্তারের সার্জারি আমাদের ফ্ল্যাটের অপজিটে, তাই পরিচিত ডাক্তার হল এসেছিলেন রুথের খোঁজ নিতে।
কিন্তু এসেই শনাক্ত করলেন তার এতো দিনের পুরোনো প্রেসেন্ট রুথ নেই, মারা গেছে। হায়রে নিয়তি! কার ভাগ্যে কি ভাবে মৃত্যু লিখা আছে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।
হালকা পাতলা গড়নের ষাট উর্ধ্বয়সী রুথ তার দু-বেড রুমের ফ্লাটে একা-ই থাকতো, ছেলে- মেয়ে নেই। যদিও অনেকবার রুথের সাথে নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছিল তবে কোনদিন ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করিনি, কারণ কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আগ্রহ দেখানো আমি মোটেই পছন্দ এবং সমচীন মনে করি না। রুথ মারা যাবার পর পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা বাবরা’র বদলৌতে জানতে পারলাম রুথ জীবনে বিয়ে করেনি।
পঞ্চাশ উর্ধো বয়সী বাবরা অনেক বছর ধরে এ ফ্ল্যাটে আছে কিন্তু কোনদিন রুথের সাথে কোন পুরুষ দেখেনি। এমন কি তার কোন আত্ত্বীয়-স্বজনও চোখে পড়েনি। রুথ বরাবরই ছিল একটু নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। সে তার ফ্ল্যাটে কখন আসতো আর কখন বের হয়ে যেত অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা কেউ টের পেত না।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি যখন এই ফ্ল্যাটে উঠি, এর পরদিন সকালে রুথের সাথে দেখা হয়েছিল আমার দরজার সামনে।
সে সময় রুথ বলেছিল' নাইস টু মিট ইউ ইয়াং লেডি, ইফ ইউ নিড এ্যানি হেলপ জাষ্ট কল মি'। সদা হাস্যময়ী বাদামী চুলের রুথকে সে দিন বেশ ভালো মনের একজন মানুষ মনে হলো। রুথ দিনের বেলা কাজ করতো সামার ফিল্ডে, এবং রোজ সন্ধ্যায় একটি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতো। ইউকেন্ডে মাঝে মধ্যে রাতের বেলায় পাবে যেত। দীর্ঘ এগার বছর একই ফ্ল্যাটে বসবাস করছি, রুথের সাথে প্রায় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।
কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে নিভুতচারি রুথের সাথে এ ফ্ল্যাটের আর কারো দেখা হয় না। নীরবে নিঃশব্দে কাউকে কিছু না বলে রুথ একা একা চলে গেল জীবনের শেষ গন্তব্যে।
রুথের ডায়বেটিস ছিল। ডায়বেটিস উঠা-নামা করলে সে কেঁপে কেঁপে পড়ে যেত যে কোন জায়গায়। মনে পড়ে কয়েক বছর পূর্বে রুথ আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে রাস্তার পাশের গেইটে পড়ে গিয়েছিল এবং খুব আঘাত পেয়েছিল পায়ে।
তৃতীয় তলার বাসিন্দা মিলি এবং আমি এ্যাম্বুলেন্স ডেকে ওকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম। হাসপাতালে দু’দিন থাকার পর রুথ বাসায় ফিরে এসেছিল এবং অতি বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ দিতে এসেছিল আমার দরজায়।
ইদানিং রুথের সাথে খুব কম-ই দেখা হয়েছে। ব্যস্ততা প্রচণ্ড বেড়েছে আমার। ঠিকমতো সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি না।
গত ক্রিসমাস ২০১০, রুথ কার্ড ও চকলেট নিয়ে এয়েছিলো আমার ফ্ল্যাটে। বলেছিলো হ্যালো, 'হাউ আর ইউ? ওয়ার হেভ ইউ বিন, লং টাইম নো সি' বলে জড়িয়ে ধরেছিল। সে দিন রুথ বেশিক্ষণ বসেনি, চা বা কফি কোন কিছু পান না করেই চলে গিয়েছিল মার্কেটে কেনাকাটার জন্য। এরপর আবার রুথের সাথে গত মাসে দেখা হয়েছিল, ও লেটরা বক্স থেকে চিঠি বের করে ওপরের দিকে যাচ্ছিল আর আমি বাইরে যাবার জন্য বের হচ্ছিলাম। সেদিনও তেমন কথা হয়নি ওর সাথে।
কোন এক অদৃশ্য কারণে ইদানিং আমার মনটা খারাপ যাচ্ছে।
আমাদের ফ্ল্যাটের দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা হেলেন এবং মিশেইল। ওরা মা-মেয়ে এক সাথে থাকে। মা হেলেন একটু বয়স্ক আর মেয়ে মিশেইলের মাথায় গন্ডগোল আছে। প্রায় সময় মায়ের সাথে ঝগড়া করে, আবার কিছুক্ষণ পর একা একা হাসে।
কোন কোন দিন মিশেইল একেবারে নীরব হয়ে থাকে। রুথ মারা যাবার খবর যে দিন আমরা পেলাম সেদিন সকাল থেকে হেলেন খুব নীরব ছিল। এবং রুথের ফ্ল্যাটে পুলিশ আসার পর সবাই কেমন জানি অজানা শঙ্কায় শঙ্কিত ছিল। বিকেল চারটায় ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দা আমার দরজার সামনে প্যাচিজে এসে জড়ো হল। আমি আর বাবরা পাশাপাশি গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকি।
আমিও দরজা খুলে বের হলাম। বাবরা বলল ফ্ল্যাটে এতো পুলিশ কেন? হেলেন ও মিশেইল বলল, উই ডোন্ট নো'। আমরা উপরের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলাম আর রুথের কথা বলাবলি করছিলাম। ঐ সময় মিশেইল বলছিল সে দু'দিন আগে সন্ধ্যায় রুথকে অসুস্থ দেখেছে , রুথের হাত থেকে রক্ত বেরুচ্ছিল। মনে হয় কোথাও পড়ে গিয়েছিল, যার কারণে এ রক্তক্ষরণ।
বাবরার দরজার সামনে এবং উপরে উঠার সিঁড়িতে সামান্য দু এক ফোঁটা রক্তের দাগও দেখিয়ে বলছিল,এই রক্ত রুথের হাত থেকে পড়েছে। রুথ উপরে যেতে পারছিল না। ওকে আমরা উপরে উঠার জন্য সাহায্য করেছিলাম। এরপর রুথকে দেখিনি। এবং আমাকে উদ্দেশ্যে করে হেলেন বলল, আমরা তোমার দরজায় নক করেছিলাম, তুমি বাসায় ছিলে না।
আমরা তখনও জানতাম না যে রুথ বেঁচে নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝসের মা উপর থেকে নীচে এসে বললেন, রুথ নেই, মারা গেছে। আমরা সবাই নীরব হয়ে গেলাম। মনে হল একখন্ড কালো মেঘ এসে নিমিষেই ঢেকে দিল আমাদের আকাশ। আমরা বাকরুদ্ধ ক’জন মানুষ কেবলই অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
পৃথিবী ছেড়ে সবাই চলে যায়। নাম ধরে যার ডাক আসে সেই একা যাত্রী হয় পরপারের বাহনে, পেছনে ফেলে যায় পরিচিত স্বজন, প্রিয় মানুষ, বন্ধু-বান্ধবসহ কতো কতো স্মৃতি। হায়রে মানুষ! সময়ের সাথে থেমে যায় তোমার জীবনের ঘড়ি। নতুন সাজে সজ্জিত হও, চার বাহকের পালকি চড়ে চলে যাও আপন নিবাসে .. প্রিয়জনের হৃদয় কাঁদে বিরহে তোমার.. তারপর অল্প অল্প করে মুছে যাও তুমি, কেউ মনে রাখে না তোমার নাম।
আসলে মানুষ বড় একা।
কবি আবুল হাসানের কবিতার সাথে আমিও আজ সুর মিলিয়ে বলছি ’অবশেষে জেনেছি মানুষ চিরকাল একা, চিরকাল তার চিবুকের কাছে ভীষণ অচেনা ও একা। '
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।