আসো, মুখোশ পড়ে খেলতে বসি, আমি জানি আমি জিতবো - আমি এই খেলাটায় বড্ড পটু!
গ্রামের সাথে যতটুকু যোগাযোগ না থাকলে সেটাকে সম্পর্কহীন বলা যাবে না ঠিক ততটুকু সম্পর্কই আমার রয়ে গেছে আমার গ্রামের সাথে। একসময় প্রতি বছর নিয়ম করে বাড়ী যাওয়া হত ঈদের ছুটিতে কিংবা অগ্রহায়ণে । দাদীর প্রতি বাবার টান আমাদেরকে প্রতিবছর গ্রামমুখী করতো ।
নানা ঝক্কি-ঝামেলার শেষে আত্মীয় পরিজনের সাথে চমৎকার কিছু সময় কাটিয়ে আসতাম । অগ্রহায়ণের নতুন ধান, সেই ধানের খই, সারারাত চুলা জ্বালিয়ে চাচীদের ধান সিদ্ধ করা আর বাড়ির সকলে মিলে হইচই করে সময় কাটত ।
কোন কোন রাতে হয়ত গেরস্তালি কাজ না থাকলে সন্ধ্যা নামতেই খাওয়ার পাট চুকিয়ে উঠোনে পাটি কিংবা চাটাই বিছিয়ে বসত গল্প আর গীতের আসর । সন্ধ্যার সাথেই নিশুতি নামা গ্রামে রাত দশটা বাজতেই ঢুলু-ঢুলু চোখে ঘুমুতে যাওয়া । সকালে পিঠা-পায়েসের গন্ধ নিয়ে ঘুম থেকে উঠে, মায়ের বকুনী এড়িয়ে মুখ না ধুয়েই খেতে বসে যাওয়া । তারপর বাবার তত্ত্বাবধানে আমপাতা দিয়ে দাঁত মাজা পর্ব । ফুটবল, দৌড়াদৌড়ি, ঘুড়ি উড়ানো, লাট্টু ঘোরানো কিংবা ম্যাচের খোল (প্যাকেট ) বাজী রেখে মার্বেল খেলা ।
বেলা দশটার আগেই কলার ভেলা নিয়ে পুকুরে দাপাদাপি । শহুরে ছেলের সাঁতার না জানা নিয়ে সমবয়সী আর বড়দের টিপ্পনী । বিকেলে সারা গ্রামের ছেলেরা কোনদিন ফুটবল আবার কোনদিন হা-ডু-ডু অথবা যেকোন দৌড়ঝাপের খেলা ।
যদিও শৈশবের প্রথম চার বছর কেটেছে গ্রামে, তবুও আবেগকে প্রাধান্য দেয়ার বয়সের আগ পর্যন্ত আমার কাছে গ্রাম মানেই অফুরান আনন্দ আর ছুটি । সবার আদরে বেড়ে উঠার সময়ে চোখে লেগে আছে বাবা চাচাদের চারটি ঘরের সামনের বিশাল উঠোন ।
সেই উঠোন পেরিয়ে বৈঠক ঘরে যাওয়া আসা করতে আমাদের ছোটদের অনেকটা পথ দৌড়ে পার হতে হত । প্রবল বর্ষায় মাথায় কচুপাতা অথবা চাচার মাথাল নিয়ে একছুটে চলে যেতাম বৈঠক ঘরে ।
তারপর একসময় নিয়মমত আবেগ এসে ভর করলো কিশোর মনে । গভীর রাতে কোন মাঠে শুয়ে একসাথে তারা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যেতাম আমরা কয়জনে । বাড়ী লাগোয়া পাট চাষের নীচু জমি ততদিনে ধান চাষের জন্য উঁচু করা হয়ে গেছে ।
খড়ের গাঁদায় লুকোচুরি খেলবার বয়স পেরিয়ে এসেছি ততদিনে । লুকিয়ে সিগারেট খেতে বড়দের চোখ এড়িয়ে অনেকদূরের এক কালভার্টে গিয়ে বসে থাকতাম একাকী । চারিদিকে বিরান মাঠের মাঝখানে সেঁচের জন্য তৈরী করা কালভার্ট পাড়ে নিঃসঙ্গ খেজুর গাছ আর তার নীচে একাকী আমি । আবেগে অভিমান নিয়ে বসে থাকি একাকিত্বের বিড়ম্বনায় । তখনো জীবনানন্দ কিংবা আবুল হাসানের সাথে পরিচয় হয়নি ।
শুধু জানতাম এক নারীর কথা নাটোরের বনলতা সেন । কে সেই নারী তার জন্য কেন আমার মনে হাহাকার তা জানবার বা বুঝবার মত বয়স কিংবা জ্ঞান আমার তখনো কিংবা হয়ত আজো হয় নি । জ্বলন্ত সিগারেট হাতে লক্ষ তারার মাঝে খুঁজে ফিরতাম বনলতা সেনকে ।
নিজের বড় হয়ে উঠাটা প্রতিদিনই টের পাই । এখন আর গ্রামে গিয়ে সেই পুরনো আবেগ খুঁজে পাই না ।
এখন সঙ্গী হয় আবেগী অভিমানী আবুল হাসান আর তার ঝিনুক নীরবে সহো । বাড়ীর সেই নিকানো উঠোন আর নেই । পরিবারের সদস্যদের সংখ্যার সাথে আনুপাতিক হারে বেড়ে উঠছে ঘরের সংখ্যা । উঠোনের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা ঘর ছাড়িয়ে আমি খুঁজি শৈশবের সেই উঠোন, সদ্য কাটা ধান এর গন্ধ, পাটখড়ির সিগারেট, সেই লালচিনি মাখানো দুধ আর খই ।
দাদীর ছিল গাছ লাগানোর বাতিক ।
বাড়ির বড় পুকুরের চারপাশ ঘিরে কদম আর বাঁশের ঝোপ, উঠোনের দূরুহ কোণ ছাড়িয়ে বাড়ীর সামনেই থাকা ক্ষেতের আল পর্যন্ত । প্রতিটি গাছ বেড়ে উঠত সমান আদর যত্নে । তাঁর প্রতিটি নাতি-নাতনী, গাছ, কুকুর-বেড়াল পেত সমান মমতা । বাবা চাচাদের হাসি মশকরার মাঝেও উঠোনে থাকা আম, কাঁঠাল, পেয়ারা গাছ এর মতই যত্ন পেত বৈঠকের সামনের সিঁদুরমুখী কিংবা নারকেল এর গাছ দুটো । ছোট থাকতেই কাটা পড়তে দেখেছিলাম লিচু গাছটির ।
বড় হতে হতে দেখেছি উঠোনের বড় গাছগুলো পরিবারের বিয়েতে কিংবা বিপদে অর্থনৈতিক শক্তি যোগাতে কাটা পড়েছে । সেই উঠোনে আজ টিকে আছে বড়ই আর পেয়ারার গাছ, আর বাকী গাছগুলো হারিয়ে গেছে দাদীর মতই । বড় অযত্নে আছে আমার সিঁদুরমুখী । বৈঠকখানা ভেঙ্গে থাকার ঘরগুলো সামনে নিয়ে আসা হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে । আমার ঘরের দোরে থাকা সিঁদুরমুখী গাছটায় মাঝে মাঝে হাত বুলাই ।
বিজলী চলে গেলে যেমন হাত বুলাই সেই পুরানো কাঁচের প্রদীপটিতে । আমি খুঁজি আমার শৈশব, খুঁজি দাদীর পালকী, সিন্দুক কিংবা সিন্দুকে রেখে দেওয়া দাদীর চশমা অথবা খুচরো পয়সা । পঁচিশ পয়সার লজেন্সের মত সব যেন টুপ করে ডুব দিয়েছে সময়ের জলে ।
দাদীর অবর্তমানে আমার বাবা সেই গাছ লাগানোর উত্তরাধিকার নিয়েছেন । পুকুর ঘেঁষে তিনি দিনের পর দিন লাগিয়ে চলেছেন রেইন-ট্রি, জলপাই, সেগুন, শিশু আর গগণ-শিরীষ ।
প্রতিবছর নিয়ম করে বাড়ী চলে যান বাবা । পুকুর পাড়ে বসে থেকে গাছগুলোর তদারকি করেন । হয়ত গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে খুঁজে ফেরেন তাঁর মাকে । কিন্তু আমাদের আর তা জানা হয়ে উঠে না ।
বাড়ীতে ঢোকার আগে পোড়ো জায়গায় এতদিনে গড়ে উঠেছে ছোট্ট বাজার ।
গা ছমছমে সেই পোড়ো জায়গা দিয়ে সন্ধ্যার পর কেউ বাড়ী ঢুকলে গোসল না করে দেউড়িতে উঠতে দিতেন না দাদী । সেখানে আজ চায়ের দোকানে খই, মুড়ী চানাচুর আর খাঁটি দুধের সর পড়া চা । হৈ হট্টগোল আর ক্যারম । পোড়ো জায়গার পাশেই উঠেছে বাঁধানো কবরস্থান আর প্রাথমিক বিদ্যালয় । এবার কবরস্থান দেখে আমার বাবা তাঁর প্রিয় ভাইঝিকে জানিয়ে দেন তিনি আর বাড়ি আসবেন না ।
নিশুতি রাতে সড়ক ধরে হেটে যাই, কবরস্থানের দিকে চোখ ফেরাতেই দেখি হাজার হাজার জোনাকী । সড়কের দুইপাশ ধরে লক্ষ লক্ষ জোনাকির ঝিকমিক দেখতে দেখতে স্বপ্নে প্রবেশ করি । চাঁদ উঠেনি তখনো । কিন্তু মাঠের এই লক্ষ তারার ঝিকমিক উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই । ক্লান্ত হওয়া পর্যন্ত হেঁটে চলে যাই অন্য কোন এক গ্রামে ।
ক্লান্তি ছাড়িয়ে মনে হতে থাকে মরবার জন্য বড় সুন্দর এই সময়। কি অদ্ভুত বৈপরিত্য। আমার পিতা মৃত্যুভয়ের কারণে বাড়ি আসবেন না আর আমি খুঁজে ফিরি মৃত্যুকে । মৃত্যুর প্রতি এই অমোঘ কিন্তু বিপরীত টান কি বয়সজনীত কিনা সেই চিন্তা মস্তিষ্কের কোষে দিতেই ভাবনা আসে, বাবাকে কখনো বলা হয়নি তাঁকে ভালবাসি কিনা । যেদিন থেকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা ছেড়েছি সেদিন থেকে আর বাবাকে স্পর্শ করা হয়নি ।
বাবার গন্ধ আমি চিনি না । আমার কাছে বাবার গন্ধ মানে গোসলখানায় ব্যবহৃত লাইফবয় সাবানের গন্ধ । কিন্তু জানি এর বাইরেও বাবার নিজস্ব গন্ধ আছে । আমার নিজস্ব নারীর যেমন খুব চেনা নিজস্ব গন্ধ আছে । আমি খুঁজে ফিরি বাবার সেই না পাওয়া গন্ধ ।
পাই না, যেমন পাইনা পোড়ো জায়গার সেই প্রাচীন অশ্বত্থ কিংবা পুকুরে লাফ দিয়ে উঠা পুঁটির গায়ে পড়া চাঁদের রূপোলী ঝিলিক ।
আস্তে আস্তে ক্লান্ত হয়ে হেঁটে যাই বাবার লাগানো গাছগুলির কাছে । হাত রাখি, জানতে চাই বাবার গন্ধ কেমন? বুঝতে চাই বাবাকে ছুঁতে কেমন লাগবে? ভালবাসার নারীকে জানাতে পেরেছি ভাললাগার কথা, কিন্তু গভীর চেনা এই মানুষটিকে কখনো বলা হয়নি আমি নিজের মাঝে তাকে দেখতে পাই । কখনো মুখ ফুটে বলা হবে না আর । বাবা বেঁচে থাকবেন তাঁর বৈষয়িক চিন্তা নিয়ে কিংবা মৃত্যু ভয়ের সাথে আপোষ করে ।
কিন্তু আমার হয়ত জানা হবে না বাবার গন্ধ কেমন ।
আবার ফিরে যাই আমার কালভার্ট এর কাছে । কালভার্ট আজ আমার মত একা । তার সঙ্গী সেই গাছ আজ আর নেই । হয়ত নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রতিটি কণা পানির কাছে কালভার্ট বলে তার হারিয়ে যাওয়া গাছের গল্প, যেমনটা আমি নিভে যাওয়া জোনাকির কাছে বলছি হারিয়ে যাওয়া নারীর গল্প ।
ফাগুনের হাওয়া আসে, রাতের চাঁদ আসে রূপোলী আলোয় । শোকাতুর কালভার্টের মত আমার পানিও বয়ে চলে আমার গাল বেয়ে । নারী, আমার জলের মতই কালভার্টের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া জলও কি গাছের শোকে নোনা? কান্না ঢাকতে শিখে নিয়েছি অনেক আগেই । কিন্তু নিজের গাল বেয়ে নেমে আসা জলকে লুকোনো আজো শিখি নি ।
ক্রিং ক্রিং শব্দে কোন এক বৃদ্ধ এসে হাজির হন তাঁর চেয়েও বয়সী সাইকেল নিয়ে ।
নিশ্চুপ নিশ্চল দাঁড়িয়ে আমায় দেখেন । কোন প্রশ্ন না করে চুপচাপ বসে পড়েন সেই বৃদ্ধ । পরম মমতায় কাঁধে হাত রেখে আলতো চাপ দেন । সমস্ত পৃথিবীর বোঝা যেন আমার কাঁধে চাপিয়ে বলে যান, ঝিনুক নীরবে সহো । এক পৃথিবীর বোঝা নিয়ে বসে থাকি একাকী, ক্লান্ত ।
আশা করি তুমি আসবে । নারী তোমার প্রতি ভালবাসার কথায় আমি হয়ত অকপট কিন্তু বড় আনাড়ী, অপটু ।
আমি আজও বসে আছি সেই কালভার্টে । সেই বুড়োর দেয়া বোঝা কাঁধে নিয়ে । পাঁচদুপুরের নির্জনতা খুন করা নারী তুমি কি আসবে? শুধু হাত ধরে বসে থাকবে আমার পাশে, এই প্রতীক্ষায় কাটিয়ে দিতে পারি সহস্র কোটি বছর ।
তোমার গন্ধ কখনো পুরনো হয়না আমার কাছে । সেই গন্ধের মতই তোমায় মনে পড়ে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।