আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝিনুক নীরবে সহো

বসে আছি পথ চেয়ে.... আবুল হাসানের একটি বিখ্যাত কবিতা 'ঝিনুক নীরবে সহো'। পুরো কবিতায় লাইন ৩টি 'ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও! আবুল হাসানের এই কবিতার মতো আমরা সব ‘বিষের বালি’ বুকে ধারণ করে মুখ বুজে নীরবে ‘সহে’ ‘মুক্তা’ ফলানোর চেষ্টা করে চলেছি। যদিও মুক্তা ফলাতে পারিনি। কিন্তু আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। কাগজ-কলমে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও নিরক্ষর; কিন্তু এদেশের মানুষকে ‘অশিক্ষিত’ বলা যাবে না কোন মতেই।

লিখতে-পড়তে না জানলে কি হবে, প্রত্যেকেই নিজের মতো করে ঠিকই ‘শিক্ষিত’ হয়েছে। বাংলাদেশকে সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষের দেশ বললেও বড় বেশি বাড়িয়ে বলা হয় না। অনেকেই ভ্রূ কোঁচকাতে পারেন, যে দেশের বেশিরভাগ মানুষ লিখতে-পড়তে জানে না তারা আবার শিক্ষিত হয় কিভাবে? হ্যাঁ, এর বাইরেও শিক্ষিত হওয়া যায়। শুধু সাক্ষর জ্ঞান থাকলেই শিক্ষিত হয় না, লিখতে-পড়তে জানলেই তাকে শিক্ষিত বলা যায় না। শিক্ষা হলো একটা বিশেষ গুণ।

এ গুণ মানুষ দেখেশুনে, ঠেকে-ঠকে কিংবা ‘নিরুপায় হয়ে’ও অর্জন করতে পারে। এ ধারার শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের স্বশিক্ষিত বলা যায়। আমাদের দেশের মানুষ তেমনই স্বশিক্ষিত। শিক্ষা সম্পর্কে পৃথিবীর বড় বড় পণ্ডিত যেসব কথা বলেছেন, তার মূল কথা হচ্ছে আত্মত্যাগ বা আত্মদান। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে আত্মত্যাগ বা আত্মদান করতে শেখায়।

আত্মদান বা আত্মত্যাগের এ শিক্ষা আমরা ভালভাবেই আয়ত্ত করেছি। প্রতিনিয়ত আক্ষরিক অর্থে এটার প্রয়োগও করছি। এদেশে বর্তমানে চলছে আত্মত্যাগ ও আত্মদানের মহড়া। অবশ্য এ ত্যাগ ও আত্মদানের উৎসবে ক্ষমতাসীন হোমরা-চোমড়ারা নীরব দর্শক। অনেক ক্ষেত্রে তারা আয়োজকও বটে।

তাদের সুনিপুণ ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে ত্যাগ ও আত্মদানের উৎসব। এ উৎসবে অংশগ্রহণকারীরা হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। দেশজুড়ে এখন কেবল সে আত্মদানের উৎসব। সড়ক দুর্ঘটনায় মরা, সন্ত্রাসীদের হাতে মরা, ক্ষমতাসীনদের সমর্থকদের হাতে মরা। পুলিশ, র‌্যাবের হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ মরা।

গণপিটুনিতে মরা। প্রতিদিনই আমরা কেউ না কেউ মরছি আর আত্মদানের মতো মহৎ শিক্ষার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছি। আমাদের দেশে বজ্রপাতে মরা, অতি-গরমে হিট-স্ট্রোকে মরা, রোগে ভুগে মরা, মঙ্গায় মরা, অভাব আর দারিদ্র্যের কষ্টে ধুঁকে ধুঁকে মরা, ভুল চিকিৎসা বা বিনা চিকিৎসায় মরা, রাজনৈতিক খেয়োখয়িতে মরা-খুব সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাস-নৈরাজ্য আর দুঃশাসনের মাঝে বসবাস করে প্রতিবাদহীন আমরা প্রতিকারহীন মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দিয়ে চলেছি। আমাদের সবার বুনিয়াদী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বা সৌভাগ্য হয় না, বুনিয়াদী শিক্ষা আমাদের তেমন কিছু শেখাতেও পারে না।

তবু আমরা অনেক কিছুই শিখেছি। ধর্মগ্রন্থের কাছে আমরা শিখেছি ‘ধৈর্যই ধর্ম’, ‘যে সহে সেই রহে। ’ আমরা পথে-ঘাটে, এমনকি বাসগৃহে পর্যন্ত বীভৎস লাশ হচ্ছি, তবুও সইছি। শিক্ষাঙ্গনে আমাদের সন্তানরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়ার পরিবর্তে লাশ হয়ে ঘরে ফিরছে, আমরা সইছি। অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জুলুম, নির্যাতন, মিথ্যাচার, ভণ্ডামিসহ নেতানেত্রী-আমলা-প্রশাসকদের সীমাহীন অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার পরও আমরা কাউকে ঘৃণা করছি না, কারণ আমরা সইছি।

আমাদের নিদানের ভার যাদের হাতে সেই ক্ষমতাবান সমাজপতিদের শঠতা, মিথ্যাচার, অন্যায়-অবিচার- সব অপকর্মই মুখ বুঁজে সইছি। কারণ আমরা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে শিক্ষা পেয়েছি-‘ধৈর্যই ধর্ম। স্রষ্টা ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন। ’ এদেশে বর্তমানে আইনের প্রয়োগ বা আইনের শাসন নেই, অপরাধীদের বিচার নেই, অপরাধের প্রতিকার নেই, সংবিধানস্বীকৃত অধিকারের বাস্তবায়ন নেই, অনেক ক্ষেত্রেই মানবাধিকার অদৃশ্য, ন্যায়বিচার অন্তর্হিত, তবুও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা এতটুকু বিচলিত বা লজ্জিত নন, বরং তাদের মুখে সারাক্ষণ মিথ্যা সাফল্যের বয়ান ও আত্মপ্রসাদ লক্ষ্য করা যায়। সবার সব অপকর্ম, অপতৎপরতা আমরা মেনে নিয়েছি।

সব আঘাত নীরবে সয়ে যাচ্ছি। সয়ে যেতে যেতে, মেনে নিতে নিতে আমরা আমাদের চূড়ান্ত সর্বনাশকেই নিশ্চিত করেছি। সবকিছু এমনকি অস্তিত্ব পর্যন্ত হুমকির সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর তাগিদ নেই। রুখে দাঁড়ানোর পৌরুষ নেই। নীরবে-নিভৃতে সারমেয়র মতো আত্মত্যাগ অথবা কোরবানির পশুর মতো আত্মদানের শিক্ষায় শিক্ষিত এমন জাতি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না।

এদেশের প্রতিটি মানুষ যেন আত্মত্যাগ ও ধৈর্যের একেকটি মর্মর ভাস্কর্য। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।