যদি মানুষ না হই তবে যেন আবার জন্ম নিই মানুষ হয়ে. . .
‘বাবা’ ‘বাবা’ করে আড়াই বছরের শিশু মিলন বাড়িময় হেঁটে বেড়াচ্ছে। ছয় বছর বয়সের বোন সুমনা বাবার একটি ছবি হাতে নিয়ে তাকে বলছে, ‘বাবা আসবে। ’ দুই শিশুর কেউই বুঝতে পারছে না তাদের বাবা চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। দিনমান এই দৃশ্য দেখে কেঁদে চলছেন মা মিনারা বেগম। সেই কান্না ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশীদেরও।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শান্তিরাম ইউনিয়নের পরান গ্রামে শরিফুল ইসলামের বাড়ি। গত শুক্রবার জামায়াত-শিবিরের হামলায় নিহত হন শরিফুল।
টানা তিন দিনের হরতালের শেষ দিন ছিল গতকাল মঙ্গলবার। গাইবান্ধার বিভিন্ন সড়কের গাছের গুঁড়ি, টায়ার-জ্বলা আগুন ঠেলে বিকেলে গাইবান্ধা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের পরান গ্রামে পৌঁছা। শান্ত এই গ্রামে ঢুকে শরিফুলের বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে লোকজন দেখিয়ে দিলেন।
বাড়িতে ঢুকতেই পথের ধারে শরিফুলের কবর। বাড়ির ভেতরে সন্তানের জন্য আহাজারি করছেন শরিফুলের বৃদ্ধ বাবা আবদুল মালেক ও মা সামান্তা বেগম।
পরিবারের সদস্যরা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বাড়ির পাশের গনসারহাট বাজারে শরিফুলের বড় ভাই নূরন্নবীর দোকান ভেঙে দেন। শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাইয়ের সঙ্গে ওই ভাঙা দোকানের মালামাল আনতে গিয়েছিলেন শরিফুল। এ সময় আবার জামায়াত-শিবির হামলা চালিয়ে শরিফুলকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ শরিফুলকে তাদের কর্মী বলে দাবি করেছে। শরিফুলের পরিবার বলছে, আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও সক্রিয় রাজনীতি করতেন না শরিফুল।
স্ত্রী মিনারা বেগম কাঁদতে কাঁদতে জানান, তাঁদের বিয়ে হয়েছে আট বছর। তিনি কুমিল্লায় রিকশা চালান। সেখানেই থাকেন।
কিছু টাকা রোজগার করে প্রতি মাসে একবার বাড়িতে আসেন। দুই সন্তানকে নিয়ে কয়েক দিন আনন্দ করে আবার চলে যান। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাড়িতে আসেন। আর শুক্রবার সকালে মারা যান। এরপর মিনারার আহাজারি, ‘হামার ছইলটাকে (মেয়েকে) এবার ইশকুলত ভরতি করব্যার চাইছিনু।
কিন্তু ওমরা হামার স্বামীক কাড়ি নিলো। হামার ছইল দুটো ফটো নিয়া বাপক খুঁজি বেড়াবার নাগছে। ছইল দুটোকে নিয়ে হামি কী করি বাঁচি থাকমু। ’
শরিফুলের বাবা আবদুল মালেক বলেন, ‘বাবা হামরা গরিব মানুষ। দুই বেলা খাইয়া কষ্ট করি দিন কাটাই।
হামরা রাজনীতি বুঝিনে। হামার ছেলেটাক কিষোক (কেন) ওমরা (তারা) মারল? হামরা বিচার চাই। ’
শরিফুলের মা সামান্তা বেগম ছেলের শোকে খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরপর আহাজারি করে ওঠেন।
বাজারের আরও দুই দোকানদারকে কুপিয়েছে শিবির: শুক্রবারের ওই হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে কাঁতরাচ্ছেন দুই ভাই ফুল মিয়া (৪৮) ও সাজু মিয়া (৩২)।
ফুল মিয়ার মাথায় আটটি সেলাই আর সাজু মিয়ার চারটি।
সাজু মিয়া জানান, গনসারহাটের বাজারে তাঁর চায়ের দোকান। টেলিভিশনে সবাই সেখানে খবর দেখে। বৃহস্পতিবার সাঈদীর মামলার রায় হওয়ার পর জামায়াতের কিছু লোক এসে তাঁকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যেতে বলেন। তিনি ভয়ে দোকান বন্ধ করে দেন।
কিন্তু সন্ধ্যার পর কয়েক শ লোক এসে তাঁর দোকানসহ কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করে। খবর পেলেও রাতে ভয়ে আর বের হননি। শুক্রবার সকালে দোকানের অবস্থা দেখে যদি কোনো মালামাল থাকে তা উদ্ধার করার আশায় দোকানে যান। এ সময় জামায়াত-শিবির লাঠিসোঁটা ও রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।
ফুল মিয়া ও সাজু মিয়া জানান, জীবন বাঁচতে তাঁরা দৌড়ে পালান।
কিন্তু ওরা শরিফুলকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে মেরে ফেলে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন বলছে, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সুন্দরগঞ্জের বামনাডাঙ্গা রেলস্টেশন ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে জামায়াত-শিবির আগুন ধরিয়ে দেয়। হামলায় চার পুলিশ সদস্যসহ মোট আটজন মারা গেছেন। ওই হামলার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে গঠিত কমিটি একটি প্রতিবেদন দিয়েছে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবীব বলেন, জামায়াত-শিবিরের ওই তাণ্ডবে দুই কোটি ৬৯ লাখ ৩২ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামলায় মুসলমানদের ১৬৭টি দোকান, হিন্দুদের ৫৫টি দোকান, আটটি মুসলিম ও তিনটি হিন্দু বাড়ি, চারটি মন্দির, দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগের স্থানীয় চারটি কার্যালয়, দুটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কার্যালয়, বামনডাঙ্গা রেলস্টেশন ও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র তারা গুঁড়িয়ে দেয়।
সূত্র: প্রথম আলো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।