কর্ণেল তাহেরের সাথে আমার যোগাযোগ অনেক দূরের।
আমাদের ছেলে বেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোয়ার্টারে থাকতাম, তার নীচের তলায় থাকতেন ডঃ আনোয়ার, যার ব্যাপারে জনশ্রুতি শুনতাম তিনি "কর্ণেল তাহেরের" ভাই। ব্যাপারটার মধ্যে একটা সমীহ এবং রহস্যের বাতাবরণ আছে, তা তখনও আঁচ করতাম কিছুটা। কিন্তু, তার ছেলে ছিলো আমাদের (জুনিয়র) খেলার সাথী, এবং তাকে জিজ্ঞেস করার মত কৌতুহল কখনও জাগেনি, সম্ভবত তার সাথে বয়সের ব্যবধানও এর একটা কারণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল লিখন থেকে কর্ণেল তাহেরের ব্যাপারে প্রথম জানাশোনা, কিন্তু সে তাহের আর ডঃ আনোয়ারের ভাইয়ের মধ্যে যোগসূত্র তৈরী হয় অনেক পরে, যখন কিছুটা পড়াশোনার মাধ্যমে কর্ণেল তাহেরের সম্পর্কে জানতে পারি।
খুব সম্ভবতঃ এন্হনি ম্যাসকারেনহাসের বইটি থেকে কর্ণেল তাহেরের সাথে আমার প্রথম পরিচয়...
যে আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কর্ণেল তাহের প্রাণ দিয়েছেন, তার বিপরীত মেরুতেই আমার অবস্হান। তার পরও তার ব্যাপারে সবসময় আমার একটি মিশ্র অনুভূতি কাজ করে... আজ এ লেখাটির উপরে মন্তব্য করতে গিয়ে সে অনুভূতিতে আবার আক্রান্ত হলাম, এবং মনে হলো এটা ব্লগে শেয়ার করা যায়। ইংরেজী বাক্যাংশটাই আসলে আমার অনুভূতির প্রকাশক, যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ না পাওয়াটা আমার ভাষাজ্ঞানের দৈন্যতা!
যারা সত্যই সাম্যবাদে বিশ্বাসী, তাদের কাছে একজন কর্ণেল তাহের এবং সে সময়ে সিপাহীদের হাতে নিহত অফিসারদের প্রাণের মূল্য একই হওয়ার কথা। নাকি শোষণহীন চেতনা ধারণ না করার অপরাধে তাদের জীবনের মূল্য খানিকটা ওজনহীন, কে জানে... সুতরাং একজন কর্ণেল তাহেরের মৃত্যুর বিচার যদি হয় (যদিও তা একটি বিচারিক অবিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছিলো, তবুও), তবে যারা কোন প্রকার আভাস ছাড়াই বিপ্লবীদের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন, তাদের প্রাণ কি এতই মূল্যহীন যে সেটা নিয়ে শোক করাও যাবেনা কিংবা নিদেনপক্ষে মনে রাখা?
আসলে মোটের উপরে কথা হোল, আমার পক্ষের না হলে তারা আমার বিপক্ষে এবং তাদের জীবনের মূল্য খুব একটা ধর্তব্য নয়, এটাই আমাদের নৈতিকতা বোধ!
কর্ণেল তাহেরের জন্য একটা শ্রদ্ধার জায়গা হলো, যে আদর্শকে তিনি গণমানুষের কল্যাণকর মনে করেছেন, তার জন্য তিনি জীবন দিতে কুন্ঠিত হননি! কিন্তু, বিপ্লবের প্রবল আকাংখার কাছে, জনমানসে সে বিপ্লবের জন্য ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে কিনা, সেটাকে আদৌ বিবেচনা করার প্রয়োজন বলে মনে করেন নি, কিংবা হয়তো ভেবেছেন, জনসাধারণ ভেড়ার পালের মত, যেদিকে বাতাস সেদিকেই পাল তোলার মানসিকতা লালন করে। যাহোক, তার সে বিপ্লব সফল হলে, এ দেশের জন্য একটি অনিশ্চিত ভবিতব্য নেমে যে আসতো তা অনস্বীকার্য।
তবে বর্তমানের "একজন ক্রাচের কর্ণেলের" আবেগঘন পটভূমিতে তার এ অবতারণা অনেকের কাছেই তেতো ঠেকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই...
কর্ণেল তাহেরের বিপ্লবের প্রয়াস এবং জীবন উৎসর্গ করা থেকে, নির্মোহ দৃষ্টিতে তাই এ দেশে আদর্শিক বিপ্লবের ধারক (ডানপন্হী কি বামপন্হী) সকলের জন্য কিছু শেখার আছে। প্রথমটা হোল, আদর্শের জন্য ডেডিকেশন, সবকিছুকে পেছনে দলে এগিয়ে যাওয়ার তীব্র স্পৃহা। আর দ্বিতীয়টি হোল, যে কোন আদর্শিক বিপ্লবের জন্য গণমানসে একটি অনুকূল মনোভাব তৈরী করে, বিপ্লবের চুড়ান্ত সোপানে আরোহন করা। আমার সীমিত বোধে, কর্ণেল তাহেরের বিপ্লবের প্রয়াসে গণভিত্তি তৈরীর পূর্বেই ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা ছিলো।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, কর্ণেল তাহের এবং তার বিপ্লবের প্রয়াসকে তাই এড়িয়ে যাওয়ার কোন অবকাশ নেই...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।