আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মমতা

ভোর

নাজমা বেগম নিউমার্কেটের মোড়ে এসে রিক্সা থেকে নামলেন । এখান থেকে লেগুনায় উঠবেন, যাবেন ফার্মগেটে মেয়ের বাড়িতে । নাতনীটার জন্মদিন আজকে, মেয়ে কিছু জানায়নি, তবু যাচ্ছেন । নাতনীটার মুখটা বড় দেখতে ইচ্ছা করছে । নাজমা বেগমের স্বামী জহুরুল হোক সাহেব কিছুদিন হলো সরকারী চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন ।

এখন আজিমপুরে একটা ভাড়া বাসায় বুড়ো-বুড়ি থাকেন। ছেলে খোকন বহুদিন হলো কানাডা প্রবাসী । মাঝে মাঝে নাতি-নাতনীর ছবি পাঠায়, ওই ছবি দেখেই যা সুখ । কিন্তু এই যে নাতনীকে দেখতে যাচ্ছেন তার সাথে ঠিকমত কথাই বলতে পারেন না । নাতনী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে ।

শেষ যেদিন গিয়েছিলেন সেদিনও নাতনী কোচিং, প্রাইভেটে পড়ে এসে ভীষণ ক্লান্ত ছিল, এসেই ট্যাব নিয়ে বসলো । নাজমা বেগম নাতনীকে কাছে টানলে নাতনী বলে উঠলো,'নানী, আমি অনেক টায়ার্ড। তুমি যাও তো । ' নাজমা বেগম এখনকার বাচ্চাকাচ্চাদের বুঝতে পারেন না । এরা কেমন ফটফট করে ইংরেজি বলে, নাজমা বেগমের ইংরেজি বলতে গেলেই উল্টোপাল্টা লেগে যায়।

ছেলে একবার কানাডায় নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে গিয়ে তো যাচ্ছেতাই অবস্থা । তবে নাতনী যাই করে তাতেই নাজমা বেগম মুগ্ধ হন, নাতনীর ক্লাসে ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়ার ছবি তিনি তাদের বাসার ড্রয়িং রুমে টাঙিয়ে রেখেছেন । বাসায় কেউ বড় একটা আসে না, আসলে ঘটা করে ওই ছবি দেখানো হয়, ছবির ইতিহাস শোনানো হয় । জহুরুল হক সাহেব বের হওয়ার সময় কিছু টাকা দিলেন নাতনীর জন্য গিফট কিনে নিতে । এখনকার বাচ্চারা কী পছন্দ করে তা নাজমা বেগম জানেন না, তাই মেয়ের হাতে টাকাটা দিয়ে কিছু কিনে দিতে বলবেন ।

টাকা সামান্য হলেও নানার দেয়া টাকা, অন্তত আদরটা তো চোখে পড়বে । আর তিনি নিজের হাতে বানানো একটা কেক নিয়েছেন, তার ছেলেমেয়ে এই কেক খুব পছন্দ করত । ছেলেমেয়ের বড় হওয়ার সময় জীবনের উপর দিয়ে যে ঝড়টা গেল, ছেলেমেয়ের জন্মদিন করবেন কী ! জহুরুল হক সাহবের চাকরি যায় যায় অবস্থা হয়েছিল, সব ঘটনা নাজমা বেগম জানেন না । জহুরুল হক সাহেব একটু চাপা স্বভাবের, এমনকি ছেলেমেয়েদেরকে কখনো খুব আদর দিয়ে কথা বলতেন না, বাপকে ছেলেমেয়ে দুইই ভয় পেত । ওই বিপদের মধ্যেও জন্মদিন এসেছে, নাজমা বেগম কেক তৈরী করেছেন, ছেলেমেয়ের মুখের হাসি দেখে কষ্ট ভুলেছেন ।

গতবারও নাজমা বেগম এই কেক তৈরী করে নিয়ে গিয়েছিলেন, কেকটা কেউ খায়নি । জামাই কুপার'স থেকে কেক কিনে এনেছে, তিনতলা কেক, নাতনী খুশিতে নাচছে - বেলুন-টেলুন দিয়ে ঘর সাজিয়ে একেবারে জমজমাট অবস্থা । অনেক অতিথি এসেছিল, নাজমা বেগম বেশিক্ষণ থাকেননি । রাতে ঘরের রান্না করতে হবে, জহুরুল হক সাহেব বাইরের খাবার খেতে পারেন না । মেয়ে কেকটা ফ্রিজে তুলে রাখতে রাখতে বলেছে, 'মা, পরে ওকে খাওয়াব ।

' নাজমা বেগম জানেন না, ওই কেকটা দুইদিন পর ফেলে দেওয়া হয়েছিল, নাতনী ওই কেক খেতে চায়নি। লেগুনা একটা এসে দাঁড়ালো । মঙ্গলবার বলে তেমন ভিড়-বাট্টা নেই । উঠে একপাশে বসলেন । লেগুনার হেলপারের বয়স আট-নয় হবে ।

সে জোরে 'ফারামগেট' 'ফারামগেট' বলে চিল্লাচ্ছে । লেগুনা আস্তে আস্তে ভরছে । দুইটা সিট খালি আছে, একেবারে ভেতরের দুইটা সিট । নাজমা বেগমের পাশ ভর্তি হয়ে গেছে, অন্য পাশে চারজন লোক । এক মেয়ে এসে বললো, 'একটু ভিতরে যান তো ।

' অমনি যে সবচেয়ে বাইরে বসে আছে সে বললো, 'ক্যান আপনে ভিতরে যাইতে পারেন না?' নাজমা বেগম লোকটার দিকে তাকালেন । লোকটা মধ্যবয়স্ক, মত গোঁফ আছে, হয়তো ঘরে মেয়েও আছে, তার মেয়েও যে একদিন এই সমস্যায় পড়তে পারে লোকটা কী তা বোঝে না? নাকি জেনেবুঝেই এমন করছে? মেয়েটা চলে গেল । কিছু পরে আরো দুই ছেলে বইপত্রের গাট্টি নিয়ে ওই ভিতরে ঢুকলো । লেগুনা ছেড়ে দিল । ছেলেটা এতক্ষণ বাইরে ডাকাডাকি করছিল দেখে নাজমা বেগম তেমন খেয়াল করতে পারেননি, এখন দেখলেন ।

ছেলেটার পরনে একটা গেঞ্জি আর ট্রাউজার । মনে হয় অনেকদিন ধোয়া হয়নি । চুলটায় তেল দেয়া হয়না বহুদিন, কেমন যেন বাদামী রং ধারণ করেছে । নাজমা বেগম বললেন, 'এই তোমার নাম কী?' এসব ক্ষেত্রে মানুষ তুই বলে সম্বোধন করে । ব্যাপারটা নাজমা বেগমের একেবারেই আসে না, ছেলেমেয়েকে পর্যন্ত তুই করে বলতে পারেননি ।

উত্তর দিল,'বাদশা মিয়া । ' উল্টো দিকের ওই গোঁফঅলা লোকটি এবার হেসে উঠলেন, 'গরিবের পুলা নাম রাখছে বাদশা মিয়া, আফা কারবারডা দেহেন । কিরে,কোন দেশের বাদশারে তুই ?' বাদশা মিয়া কোন উত্তর দিল না । 'এগুলা বদের হাঁড়ি বুজছেন আফা, এগুলার শইলে কোন ব্যথা বেদনা নাই, মারলে আফনেই ব্যথা পাইবেন । এহনি নিশ্চয় সিগারেট খায়, ঠোঁট দেখছেন কেমুন কালো ?এগুলারে লাই দিবেন না ।

' নাজমা বেগম বিরক্ত চোখে লোকটার দিকে তাকালেন, লোকটা চুপ করে গেল । বাদশা মিয়া বললো,' ভাড়াডা দেন তো। ' নাজমা বেগম পার্স বের করে দশ টাকা দিলেন। একলোক পাঁচশ টাকার নোট দিল। বাদশা মিয়া বললো, 'ভাংতি দেন, আইজকা মাত্র দুই ট্রিপ দিছি, দুই ট্রিপে কী পাঁচশ টাকা হয়,কন ?' আবার গোঁফঅলা চেঁচিয়ে উঠলেন,' ভাংতি নাই মানে? আমরা কী পকেটে ভাংতি লইয়া লইয়া ঘুরুম নাকি? তর কাছে না থাকলে তোর ওস্তাদরে জিগা।

'তারপর সবার দিকে ফিরে বললেন,' টাকা ঠিকই আছে, দিব না । এগুলারে মাইরের উপর রাখন কাম। ' সিগনালে আটকা পড়ার পর বাদশা মিয়া ঠিকই ওস্তাদের কাছ থেকে ভাংতি এনে দিল। গোঁফঅলা বিজয়ের ভঙ্গিতে বললেন, ' দেখলেন ব্যাপারডা?' তিন-চারজন যাত্রী নেমে গেল গ্রিনরোডে , গোঁফঅলা সহ । নাজমা বেগম বাদশা মিয়াকে ডেকে বললেন, 'ভিতরে এসে বস।

' বাদশা মিয়া বললো,'এনেই আরাম। গায়ে বাতাস লাগে । ' - পড়াশুনা কর? - এ বি সি ডি কইতাম পারি । - কই শিখছ? - এক আপায় রাইতে ফুটপাতে পোলাপাইনরে পড়ায়, মন চাইলে যাই মাঝে মইধ্যে, গেলে বিস্কুট দেয় । - পড়াশুনা ভালো লাগে না? -নাহ, পইড়া কী হইব?এই ওস্তাদ ডাইনে চাপায়া যান, বাঁয়ে পেলাস্টিক ।

বলে বাদশা মিয়া একটা হাসি দিল, নাজমা বেগম লক্ষ্য করলেন তার উপরের পাটির দুইটা দাঁত নেই, তবু হাসিটা কেমন যেন মানিয়ে গেছে । খোকনের ছোটবেলার হাসির সাথে কেমন যেন একটা মিল আছে । লেগুনাটা পান্থপথ সিগনাল ক্রস করতেই কয়েকটা চার-পাঁচ বছরের ছেলে লাফাইয়া উঠলো লেগুনার পাদানিতে. নাজমা বেগম শিউরে উঠলেন । - আরে পড়ে যাবে তো! বাদশা মিয়া বললো, 'পড়ত না, এগুলান এমনেই সবসময় লাফাইয়া উডে । ' কিছুদূর গিয়েই সব আবার একবারে নেমে গেল।

নাজমা বেগম নামবেন আইবিএ হোস্টেলের সামনে । বাদশা মিয়াকে বললেন, গাড়ি থামাতে । বাদশা মিয়া গাড়িতে চাপড় দিল, গাড়ি স্লো হলো । কিন্তু নাজমা বেগম নামতে না নামতেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল, তিনি নামতে পারলেন না । বাদশা মিয়া আবার চাপড় দিয়া গাড়ি থামালো, দৌড় দিয়ে সামনে গিয়ে ড্রাইভারকে থামিয়ে রাখতে বললো, নাজমা বেগম নামলেন।

বাদশা মিয়া আবার সেই ফোকলা দাঁতের হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে । নাজমা বেগমের একবার মনে হলো, কেকটা বাদশা মিয়াকেই দিয়ে দেন, নাতনীর জন্য বড় কেক তো আসছেই, আর সে মনে হয় নানির কেকটা পছন্দ করে না। কিন্তু নাজমা বেগম দিতে পারলেন না। কেন পারলেন না, তিনি নিজেও জানেন না । আমিও জানি না ।

মানুষ তো কত কিছুই করতে চায়, কেউ দেশোদ্ধার করতে চায়, কেউ শুধু দিনাতিপাত করতে চায়, কয়জন চাওয়া আর পাওয়ার মেলবন্ধন ঘটাতে পারে? নাজমা বেগমের কেক হয়তো ফ্রিজে পড়ে থাকবে, তারপর ফেলে দেওয়া হবে, তবুও মমতার উপহারটা অপাত্রেই যাবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।