আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দূতাবাস বন্ধের ঘোষণায় আমরা চ্যাম্পিয়ন!!!!!



মনজুরুল হক, টোকিও থেকে | তারিখ: ১৭-০৩-২০১১ জাপানের নাগরিক জীবনে আসলেই বড় ধরনের সংকট দেখা দিচ্ছে কি না, তা জানতে পারার সহজ একটি উপায় হচ্ছে দেশের শিশু-কিশোরেরা কীভাবে দিন কাটাচ্ছে সেদিকে তাকানো। শুধু জাপানই নয়, বিশ্বের যেকোনো দেশেই সংকটের মুখে শুরুতে যেসব প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তার কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেই তালিকায় সর্বাগ্রে হচ্ছে স্কুলের অবস্থান। আজ দুপুরে আমি যখন এই লেখার কাঠামো ঠিক করে নেওয়ায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই কানে ভেসে আসে একদল বালক-বালিকার প্রাণোচ্ছল কথাবার্তা। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, স্কুলের পাঠ শেষ করে ওরা বাড়ির পথে ফিরছে। তাৎক্ষণিকভাবে যে চিন্তা আমার মনে তখন খেলে যায় তা হলো, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায় না এই দৃশ্য! যে বক্তব্য গতকাল তিনি সাংবাদিকদের সামনে দিয়েছেন, তাতে যেকোনো বাংলাদেশির মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মাতে বাধ্য যে গভীর এক সংকটে ক্রমেই অতলে তলিয়ে যাচ্ছে জাপান এবং সেখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়াই এখন হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।

বাংলাদেশের মানুষের মনে এ রকম ধারণা সেই বক্তব্যের পর আসলেই যে আরও কঠিন হয়ে দানা বাঁধে, সেই প্রমাণ আমি গত রাতেই পেয়েছি দেশ থেকে আসা একাধিক ফোনকলের মধ্য দিয়ে। সবাই উদ্বিগ্ন আমার আর আমার পরিবারের সদস্যদের অবস্থা নিয়ে। কেউ আবার এ রকম আভাস দিতেও ভোলেননি যে বিলম্ব না করে দেশের পথে রওনা হওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। জাপান থেকে অনেক দূরের পথ বাংলাদেশে অবস্থান করে আমাদের শরীর-স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন, তাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারা আদৌ কঠিন নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন স্বয়ং ঘোষণা দেন, তেজস্ক্রিয় বিপদের আশঙ্কায় দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে কোনো কিছু না জানা মানুষের মনে ভীতি দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক।

আর সেই ভীতি থেকেই কাল প্রায় সারা রাত ধরে বাংলাদেশের অনেকেই ফোনে কথা বলেছেন জাপানে বসবাসরত তাঁদের আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে। অথচ জাপানের পরিস্থিতি যে সে রকম ভীতিকর আদৌ নয়, ওপরের বর্ণনা থেকেই কিন্তু এর পরিষ্কার আভাস পাওয়া যায়। টোকিও ও আশপাশের কয়েকটি জেলার একটি স্কুলও তেজস্ক্রিয়তার ভীতিজনিত কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। বালক-বালিকারা আগের মতোই নিয়মিত স্কুলে হাজিরা দিচ্ছে, যদিও বাধ্যতামূলক লোডশেডিংয়ের কারণে এলাকা বিশেষে স্কুল কোনো কোনো দিন বন্ধ থাকছে কিংবা আগেই ছুটি হয়ে যাচ্ছে। একটি দেশের সরকার কি চাইবে দেশের আগামী দিনের নাগরিকেরা বিপদের মুখে পড়ুক? নিশ্চয় নয়।

অন্তত জাপানের বেলাতে তো নয়ই। এ কথা ঠিক যে দোকানপাটে ও পেট্রল স্টেশনগুলোতে ভীতিমূলক কেনাকাটা জাপানজুড়েই চলছে। সুপার মার্কেটে এখন আর সহজে চোখে পড়ে না বিশুদ্ধ পানির বোতল, ইনস্ট্যান্ট নুডল এবং আরও কিছু খাদ্যসামগ্রী। কেনাকাটা করায় দেরি হয়ে গেলে রুটির আর দেখা পাওয়া যায় না। তবে এই ভীতিমূলক কেনাকাটার কারণ কিন্তু তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নয়।

বরং তা হচ্ছে আরেকটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাবনার মুখে বাড়িতে খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করে রাখা। বলার অপেক্ষা রাখে না, শুক্রবারের ভূমিকম্প স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত থাকার ওপর এত দিন ধরে মানুষের রাখা আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। মানুষ এখন আর ভাবতে পারছে না, আগামীকাল নিরুদ্বেগ জীবন কাটানো তাদের পক্ষে সম্ভব হবে কি না। বিশেষ করে শুক্রবারের বড় ভূমিকম্পের পর থেকে প্রায় বিরতিহীনভাবে চলতে থাকা ভূমিকম্প-পরবর্তী কম্পন আগের সেই আস্থায় ধস নামাতে অনেক বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে জাপানের নাগরিক জীবনে এই অবস্থাকে কিন্তু ব্যতিক্রমী বলে ভেবে নেওয়া যায় না।

কেননা সরকার, বিশেষ করে, সরকারের দুর্যোগ প্রতিরোধ বিভাগ হাতের কাছে পানি ও প্রয়োজনীয় খাদ্যের মজুদ সব সময় জমা রাখার উপদেশ অনেক আগে থেকেই নাগরিকদের দিয়ে আসছে। টোকিও ও আশপাশের এলাকাগুলোতে দীর্ঘদিন বড় কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানেনি বলে মানুষ প্রায় ভুলতেই বসেছিল প্রয়োজনীয় সেই উপদেশের কথা। শুক্রবারের ভূমিকম্প সেই ভুলে যাওয়া কথাই তাদের পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয় এবং জাপানের নাগরিকেরা সুপার মার্কেটের শেলফ খালি করে কেনাকাটা করতে শুরু করে। এবার দেখা যাক, বিদেশিরা কীভাবে দেখছে জাপানের সাম্প্রতিক এই পরিস্থিতি। বিদেশে, বিশেষ করে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিয়ে উদ্বেগ দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান।

সেই সব দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎবিরোধী আন্দোলনও যথেষ্ট শক্তিশালী। বিশেষ করে, চেরনোবিল ও তার আগের কয়েকটি দুর্ঘটনার শিক্ষা নাগরিক মনোভাব অনেকাংশেই পরমাণু জ্বালানিবিরোধী করে তুলেছে এবং পশ্চিমের অনেক দেশের সংবাদমাধ্যমও এর সঙ্গে মোটামুটি একমত পোষণ করে আসছে। ফলে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার আলোকে এক ধরনের ভীতি পশ্চিমের লোকজনের মধ্যে দেখা দেওয়া মনে হয় খুবই স্বাভাবিক এবং পশ্চিমের কিছু কিছু দেশের নাগরিকের জাপান ছেড়ে যাওয়ার পেছনে বাস্তব অবস্থার চেয়ে সেই ভীতিই বরং কাজ করেছে অনেক বেশি। ইউরোপও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান জাপানে তাদের কর্মকাণ্ড পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর সীমিত করে আনলেও এদের কেউই কিন্তু পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যায়নি। বরং যে পদক্ষেপ তারা নিয়েছে, তাকে বলা যায় পরিস্থিতির ওপর নজর রেখে যাওয়া।

অন্যদিকে জাপানে বিদেশি দূতাবাসগুলোর মধ্যে কেউই বন্ধ করে দেওয়ার কোনো ঘোষণা দেয়নি। সেদিক থেকে বলা যায়, আমরা হচ্ছি এই ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন। ধন্যবাদ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে, অন্তত একটি বিষয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে পারার স্বাদ তিনি আমাদের জন্য এনে দিতে পেরেছেন। একমাত্র যে বিদেশি দূতাবাস টোকিওর কার্যাবলি ওসাকায় তাদের আগে থেকে চালু থাকা কনসুলেটে স্থানান্তরিত করার ঘোষণা দিয়েছে, সেই দেশটি হচ্ছে অস্ট্রিয়া। ওসাকায় অনেক আগে থেকেই অফিস চালু থাকায় অস্ট্রিয়ার বেলায় নতুন করে সেখানে সরে যাওয়া সেটা বোঝায় না।

আমাদের বোধের অগম্য, বাংলাদেশ কেন এত তড়িঘড়ি করে দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিল। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে অবশ্য এ নিয়ে নানা রকম গুজব শোনা যায়। তবে গুজব যেহেতু গুজবই, তা সেগুলোর উল্লেখ করে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা জাপানে বাংলাদেশের দূতাবাসকে হেয় প্রতিপন্ন করার কোনো রকম মনমানসিকতা এই প্রতিবেদকের নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে রকম বক্তব্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে ক্ষতি যেদিক থেকে করেছেন তা হলো, বন্ধুপ্রতিম একটি দেশের চরম দুর্দিনে সংকট সামাল দেওয়ায় দেশটির চালানো সর্বাত্মক প্রচেষ্টার প্রতি চূড়ান্ত অবমাননার নিদর্শন তুলে ধরা। আগেই বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্য কোনো দেশ টোকিওতে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়নি।

সে রকম অবস্থায় রাজধানীতে বাংলাদেশের দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে জাপান কীভাবে নেবে, তা অনুমান করে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকদের ওপর আমি ছেড়ে দিচ্ছি। আমি কেবল ছোট একটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানার পর আমার এক পরিচিত জাপানি সাংবাদিককে এ কথা আমি বলেছিলাম। তিনি যে প্রতিক্রিয়া এতে ব্যক্ত করেছেন, তা এ রকম, ‘ওদের বলবেন, শুধু টোকিও থেকেই নয়, বরং এই দেশটি থেকেই ওরা যেন চলে যায় এবং আর যেন ফিরে না আসে। ’ অনুমান করা যায়, দেশের চূড়ান্ত সংকটের সময় অবমাননাকর এক ঘোষণা আসার কারণেই বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের মনোভাব পোষণ করা সেই জাপানি নাগরিক মনের দুঃখেই কথাগুলো বলেছেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টোকিও থেকে দূতাবাস হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকিতে সরিয়ে নেওয়ার উল্লেখ করলেও কী পরিমাণ অর্থ সেই কাজে ব্যয় হতে পারে, তার কোনো রকম আভাস দেননি। আমাদের অনুমান, বিশাল অঙ্কের খরচ এতে জড়িত। খরচের বিষয়টি খুলে বলা হলে আমরা হয়তো আরেকটু ভালোভাবে পুরো বিষয়টি বুঝে উঠতে পারব। বেফাঁস কথা না বলার শিক্ষা রাজনীতিবিদদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। তবে রাজনীতিবিদেরা যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসীন হন, তখন বোধ হয় সে রকম এক শিক্ষার পর্ব তাঁদের সেরে নেওয়া খুবই দরকার।

কেননা, জনগণের ভাগ্যের অনেকটাই তখন তাঁদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং বেফাঁস কিছু বলে আমজনতা, সেই সঙ্গে দেশকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেওয়ার দায়ভার শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই বহন করতে হয়। সে রকম অবস্থার মুখোমুখি হওয়া নিশ্চয় কোনো রাজনীতিবিদেরই কাম্য নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল ঠিক সে রকম এক বেফাঁস মন্তব্য করে দেশের জন্যই কেবল বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করে দেননি, সেই সঙ্গে জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের জীবনেও নিয়ে এসেছেন অশান্তি। টোকিও, ১৬ মার্চ ২০১১ Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.