ভাবনাগুলো শেয়ার করার ইচ্ছে ছিল সবার সাথে।
একুশের বইমেলায় স্বল্প পরিচিত একটি স্টলের সামনে আমার চোখ আটকে যায়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক বলেই জানি উনাকে আমি। উনার সাথে কথাও হয়েছে বেশ কয়েকবার। স্বভাবতই উনাকে সালাম জানিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করা আমার শেষ হতে না হতেই।
দ্রুততার সাথে উনি আমাকে একটি বই আমার সামনে মেলে ধরেন। পরক্ষনেই বলে উঠেন- এই যে আমার বই বেরিয়েছে। আমি তো পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ভাবিনি উনি আসলে এইভাবে ব্যাপারটি উপস্থাপন করবেন! এরই মধ্যে আমার কান থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত গরম হয়ে গিয়েছে। আগে উনি আমার কুশল বিনিময়ের উত্তরটা দেয়ার পর্যন্ত সমুচিত মনে করছেন না এই ভেবে।
আবার ঠিকই আমাকে উনার পাঠক বানানোর চেষ্টায় মত্ত! অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে উনার হাত থেকে সে বইটি না নিয়ে। স্টলে সাজানো সে বইটি আমি হাতে নিলাম এবং দেখানোর ভঙ্গীতেই দু-এক পৃষ্ঠা উলটে পালটে আমিও বললাম- বাহ! বেশ তো। অভিনয়ই করতে হলো আসলে! এই ভেবে মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো। সাইকোলজির ছাত্র না হয়েও বলতে পারি- উনি আসলে আমার কুশল বিনিময় এর চেয়ে উনার বইটা বিক্রি করতেই আগ্রহী ছিলেন মনে হয়। লেখক মানেই যে সামাজিক হতে হয়।
আর লিখলেই যে লেখক হওয়া যায় না। আর কিছু না বুঝি, একজন পাঠক হিসেবে তো বুঝতে পারি তা। এরপর তো নতমস্তিস্কে বইটি না কিনেই ব্যথাহত মন নিয়ে সরে যাই সে স্টল থেকে। আমার মাথায় তখনও ঘুরপাক খাচ্ছে- কুশল এর উত্তর এর চেয়েও কি বড় হয়ে গেলো উনার বিলেত ভ্রমণ কাহীনি! আবার উনারাই নাকি শিক্ষকতাও করেন। যার সামান্য সৌজন্যতাবোধটুকু নেই একজন পাঠকের জন্য!
এই বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরিতে থাকাকালীন তিনজন ছোট শিশুকে দেখতে পাই।
শিশু এই জন্য বললাম। তাদের বয়স সর্বোচ্চ হবে আট কি দশ বৎসর মনে হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি শিশুর গায়ে সাদা-কালো শাড়ি পরিপাটি করে জড়ানো। মাথায় একুশের শ্লোগান এ ভরা মাথার ক্যাপ। বেদিতে যেতে তখনও আমাদের অনেক দেরি।
প্রভাত ফেরির মিছিল থেকে বের হয়েই এক দৌড়ে ওদের কাছাকাছি। সবাই যেখানে রঙ্গিন অথবা ব্যবহার্য কাপড়ই পরিধান করে এসেছে। সেখানে সে ক্ষুদেদের একজন শাড়ি পড়ে এসেছে! যদিও রঙ্গীনও গায়ে জড়ানো ছিল। বললাম একটা ছবি তুলতে চাই তোমাদের? ওরা তৈরিই ছিল যেন! এমন ভঙ্গীতে তিনজনই দাঁড়িয়ে গেলো একই কাতারে। পাশেই তাকিয়ে দেখি ভ্রাম্যমাণ একটি ফুলের দোকান।
সামনেই ওদের ছবিটা তুলছিলাম। ঠিক সে মুহূর্তেই একটি লোক তার কেনা ফুলগুলো বিক্রেতার কাছ থেকে নিচ্ছিল। এরই মধ্যে ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে ভালো ভাবে খেয়াল করলাম ছবি দেখে। মেয়েটির চোখ ছিল ফুলগুলোর দিকে।
সেই মুহূর্তে ওদের প্রতি এতটাই কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসায় মগ্ন ছিলাম। ওদের হাতে একতোরা ফুল দিয়ে দেবো তা আর খেয়াল হয় নাই, আফসোস! ছবি তোলার পর ধন্যবাদ দেয়ার সাথে সাথে। নির্বিকার ভাবে ওরা আবার একই ভঙ্গীতে হাটা ধরল মূল বেদির দিকে। যেন তিনজনেরই একটি প্রভাত ফেরির মিছিল। হাতে সত্যিকারের ফুল ছাড়া শুধুমাত্র মনের ফুলই সাথী করে নিয়েছিল যেন ওরা।
আহা! এই আমিও তো নত ঐ শিশুগুলোর কাছে। শুধুমাত্র এইকারনেই ওদেরকে আমার ক্যামেরার ফ্রেমে বন্ধী করলাম। তা আর কিছুই না- ওদের চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
বইমেলায় গিয়েছি কয়েকবার। এর মধ্যে যে ব্যাপারটি আমার কাছে প্রতিটি বারই খারাপ লেগেছে।
তা হল লিফলেটকে মাড়াচ্ছি আমরা পায়ে। এই হাজার হাজার লিফলেট মানে বর্ণমালা দিয়ে সাজানো এক একটি সুদৃশ্য কাগজ আমরা অনায়াসেই পা দিয়ে মাড়াচ্ছি! কারোই কোণ বিকার নেই। তাও আবার বাংলা একাডেমীর বইমেলায়! কি পরিমাণ সাঙ্গর্ষিক যে ব্যাপারটি বই মেলার ভাবগাম্ভির্যের সাথে। এই আমি বলছি, আমিও তো মাড়াচ্ছি সে বর্নমালা। তা হয়ত আমরাই পারতাম হাতে রাখতে।
নতুবা এ ধরনের লিফলেট না বিতরন করতে কতৃপক্ষের যদি নির্দেশ থাকতো। ভালো হতো মনে হয় খুব। অবশ্য এর মধ্যে আমি আমার মতো করেই প্রতিবাদ করেছি। কে শোনে কার কথা! আর কয়জনকেই বলে শেষ করা যায়। আমরা তো আর সুশীল না।
হয়ত সুশীল হলে শুনত উনারা। আফসোস আমি সুশীল না, একজন সাধারণ মানুষ।
বই এর কাটতি বাড়ানোর জন্য এবং প্রচারের জন্য কি এতটাই দরকার ছিল? যা আমার কাছে অবাক লেগেছে- নামীদামী লেখক মানে যাদের বই এমনিতেই মানুষ কিনে থাকে। তাদের লিফলেটই বেশি! কে নেই সে লিফলেটগুলোতে মানে কোন লেখক নেই সে তালিকায়! আমরা তাদেরকেও মাড়াচ্ছি পা দিয়ে! আরও অবাক কাণ্ড একদিন বিকেলে বইমেলায় ঢোকার পথটিতে। একটি পথ শিশু কিছুটা ময়লা কাপর আর মুখটা ধূলায় মলিন চেহারা নিয়ে লিফলেট বিলাচ্ছে।
কৌতূহলী হয়ে তার সামনে গিয়ে আইল্যান্ড এ বসে দেখলাম প্রায় মিনিট পাঁচেক। এরই মধ্যে আমার হাতেও চলে এসেছে সে লিফলেটটি। যার মধ্যে ছিল একুশের বাংলা একাডেমীর বইমেলার পর, এদেশেরই একটি নামীদামী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের বইমেলা শুরু করার প্রচারমুলক লিফলেট। সে বইমেলায় গুনে গুনে কয়েকজন বিখ্যাত লেখকেরই বই বিক্রি হবে। এই মর্মে একটি ঘোষণা পত্র যেন।
যেহেতু ছেলেটিকে বলে কোণ লাভ নেই। তবু জানার জন্যই জিজ্ঞেস করেছিলাম- তোমার নাম কি? চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়ার প্রয়োজনই বোধ করলো না। বরঞ্চ মনে হল মহা-বিরক্ত হয়েছে যেন। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন- এই লিফলেট তোমাকে কে বিলাতে দিয়েছে? কোন উত্তরই নেই। অগত্যা আরও কাছাকাছি হয়ে ওর দিকে ঝুঁকে ওর মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কত টাকা পাও তুমি? এইবার উত্তর- জানি না।
অবাক হয়ে পালটা পালটি প্রশ্ন আমার- তাহলে কে জানে?
-আমার বড় ভাই।
- তোমার বড় ভাই কি আপন বড় ভাই?
সহজ কথা ওকে দিয়ে কাজটি করাচ্ছে কেউ। এর মধ্যে দেখলাম ছেলেটির চোখে একটু ভয় ভয় ভাব। হয়ত ভেবেছে কোণ সমস্যা হয় নাকি আবার। কারণ যেহেতু আশে পাশে অনেক নিয়ম-কানুন এর জৌলুশ আর আইনশৃংখলাবাহীনির লোকজন আছে।
এই রকমই মনে হল আমার কাছে তখন। এরপর হতাশা নিয়েই আর কোন প্রশ্ন করি নি। শুধু ভেবেই দেখলাম সেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের এবং লেখকদের অবস্থা ভেবে। উনাদের কি এতটাই লোকজন কমে গিয়েছিল! যার ফলে বাংলা একাডেমীর সামনেই একজন পথ-শিশু দিয়ে তাদের পণ্য থুক্কু বই এর প্রচার করবেন! আর সে লিফলেট গুলো মাড়াবে সব বয়সী মানুষ! একদিকে সুসজ্জিত স্টলগুলোতে বাংলা ভাষায় লিখা মায়া মোড়ানো সব লিখা এবং লেখকের বই। আর একদিকে বর্ণমালা মানুষের পায়ের নিচে! আর শ্রম দিচ্ছে একজন পথশিশু!
কাকে বললে যে তা বন্ধ হবে।
ভেবে পাইনি আসলে। তবে এই আশা করা কি অমূলক হবে! যেন বাংলা একাডেমীর বইমেলায়। কোথাও যেন অবান্তর লিফলেট না বিলানো হয়। অথবা আমরাই সচেতন হই নিজেরাই। লিফলেট নিলে নিজের কাছেই যেন গচ্ছিত রাখি।
কারণ এতে অন্তত বাংলা একাডেমীর, ভাষা শহীদদের মাস এই ফেব্রুয়ারির বইমেলার পদচিহ্ন পরা জায়গাগুলোতে যেন কোণ বর্ণমালাই কষ্ট না পায়। তা শুধু নিজেদের মানসিকতাকেই এবং পরিবেশটাকেই উৎকৃষ্ট করবে বৈ কমবে না একটুকুনও।
যা আমার হাতে, তাই তো আমার বুকে, তাই তো আমার মস্তিষ্কে। নাকি লোকদেখানো শুধু আমরা উপরের জৌলুশটাকেই দেখবো। তাও তো আমাদেরই ভাবতে হবে।
নাকি ভাবনাগুলো হয়ে যাবে ফ্যাশন?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।