দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই সমাজ পরিবর্তন করতে পারে।
আমাদের দেশে হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসন ও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকৃতি সম্বন্ধে প্রায় সব ব্লগ ও পত্রপত্রিকায় বেশ লেখালেখি হচ্ছে। এটি আশার কথা যে বিষয়টি সম্বন্ধে সবাই সচেতন হচ্ছে। আরও আশার কথা যে এই সচেতনতা বৃদ্ধির হার দিন দিন বাড়ছে। অনেকেই এই সমস্যার কারন ও তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করছেন।
কারন হিসেবে অনেকে আমাদের অসচেতনতা, হিন্দি মুভি, টিভি চ্যানেল, হিন্দি গানের সহজলভ্যতা, হিন্দি ভাষার সহজবোধ্যতা ইত্যাদিকে দায়ী করেছেন। প্রতিকার হিসেবে সচেতনতা সৃষ্টি, হিন্দি টিভি চ্যানেল নিষিদ্ধ করা, উচ্চহারে ট্যাক্স আরোপ ইত্যাদির কথা বলছেন। আমার মনে হয় চ্যানেল নিষিদ্ধ করা জাতীয় কাজ অথবা হিন্দি চ্যানেল না দেখতে বাধ্য করা ইত্যাদি সমস্যার প্রকৃতি সমাধান নয়। আমার মতে এই সমস্যা সমাধান ও প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের রুচি ও মূল্যবোধের পরিবর্তন করা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। আমাদের ও ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে এবং মানুষের ধর্মই হচ্ছে সমজাতীয় হলে অপেক্ষাকৃত ভালোটাই বেছে নেবে।
বাংলা সিনেমার চেয়ে বাঙ্গালীদের কাছে তাই হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে এবং এটাই স্বাভাবিক। বাংলা সিনেমার বর্তমান অবস্থা ও ইংরেজী সিনেমার ক্ষেত্রে ভাষা না বোঝার সমস্যা ইত্যাদি কারনে ধরে নেওয়া যায় যে হিন্দি সিনেমার ধাপট বাংলাদেশে আরো অনেক বছর থাকবে। তার সঙ্গে বুঝে না বুঝে হিন্দি গানের কলি আমাদের ইয়ং পোলাপানের মুখে মুখে থাকবেই।
রুচির পরিবর্তন প্রসঙ্গে আসি। আমরা ছোটবেলায় ‘নিশা লাগিলোরে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলোরে’ অথবা ‘আমায় এতো রাতে কেনে ডাক দিলি, প্রান কোকিলারে’ টাইপের গান শোনে বড় হেয়েছি।
কিশোর বয়সে অনেক গানের পাশাপাশি আইয়ুব বাচ্চুদের ‘মন চাইলে মন পাবে, দেহ চাইলে দেহ’ টাইপের গান অথবা ‘দুই দিনের এই দুনিয়া, কি হইবে দিন গুনিয়া, করোনা ফুর্তি করোনা’ , হাল আমলে জনপ্রিয় গায়িকা সালমার ‘দিওনাগো বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া, অন্ধকারে বন্ধ ঘরে যাবো মরিয়া......’ ইত্যাদি গান শুনেছি অথবা শুনছি। শিশু অথবা কিশোর মন আবেগপ্রবন ও বিবেচনা শক্তি কম হওয়ায় তাদের মনে এই সব গানের কথা বিরুপ প্রভাব ফেলবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ভাবতে খটকা লাগে যখন ক্যাটরিনা কাইফের মতো সুন্দরী আবেদনময়ী নায়িকার মুখে শোনা যায় ‘জারা জারা টাচ মি, টাচ মি, টাচ মি/ কিস মি, কিস মি, কিস মি’ ইত্যাদি গান তখন তাদের মনের তা কি প্রভাব ফেলে। অশ্লীল গানের কথা বাদ দিলেও আমরা ছেলে বুড়ো সবাই গান বলতে রোমান্টিক গানকেই বুঝি। ছোটবেলা থেকেই আমরা এই ধারনার সঙ্গেই পরিচিত।
বলা বাহুল্য, বর্তমানেও প্রচলিত ও প্রকাশিত গানের সম্ভবত ৯৯ ভাগই প্রেমের গান। যেন প্রেম ছাড়া গান অসম্ভব, নচিকেতার মতো গায়ক কোন গায়কই নয়। সিনেমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এতে করে ছোটবেলা থেকেই একটা শিশু প্রেম ভালোবাসা সম্বন্ধে ভালোই শিক্ষা পাচ্ছে। এই পর্যন্ত হলেও হয়তো সমস্যা হতো না কিন্তু বর্তমানে পার্কে, অথবা রাস্তাঘাটে প্রেমের রুপ দেখে মাঝে মাঝে শিউরে উঠতে হয়।
এটা কি সংস্কৃতির বিকৃতির পাশাপাশি মানসিক বিকৃতিও নয় ? এর জন্য দায়ী কি ? ছোটবেলা খেকেই আমরা মনরে ভাষা প্রকাশকারী গানের পাশাপাশি দেহের ভাষা প্রকাশকারী গান শুনে বড় হয়েছি। সিনেমার ক্ষেত্রেও মনের প্রেমের পাশাপাশি দেহের প্রেমটাও আজকাল ঘটা করে দেখানো হচ্ছে। হিন্দি সিনেমা এটাকে যেন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। দেশী সিনেমার অদক্ষতার জন্য আমাদের ইয়ং পোলাপান হিন্দি সিনেমার মনজ+দেহজ প্রেম দেখে এতে অভ্যস্থ হচ্ছে। তাছারা তারা এখন বাংলার মধ্যে দুই একটা ইংলিশের পাশাপাশি হিন্দিও ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
আমাদের বাবা মা রাও হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে অনেক স্মার্ট হয়েছেন। তাদের ছেলেমেয়েদের প্রেম ভালোবাসাকে তার ‘সুন্দর মনের সরল সম্পর্ক’ হিসেবে দেখছেন। তারা কুমার শানুর সেই গান, “এখন প্রেমের বড় অসময়, বাগিচায় ফুল আর ফুটছেনা। / দেহের ভাষায় নয়, মনের ভাষায়, কথা বলার লোক জুটছেনা। ” হয়তো শুনেননি অথবা আমাদের সমাজের সাংস্কিৃতিক বিকৃতি সম্বন্ধে তারা খোজ খবর রাখেন না।
তারা হয়তো জানেন না তাদের ছেলেরা আজকাল ‘আবার জিগায়’ এর বদলে বলে ‘আবার জিগস’। তারাই নিশ্চই বুঝতে পারেন যে, তাদের ছেলেমেয়ে পর্নো ভিডিও লুকিয়ে দেখলেও হিন্দি গানের আধা পর্নো ভিডিও সবার সামনেই দেখছে। এসময় তারাও হয়তো লজ্জায় টিভি সেটের সামনে থেকে উঠে যান। বভিষ্যতে হয়তো তারা আরো স্মার্ট হয়ে যাবেন, তখন সবাই মিলে তা দেখবেন এবং এটাও হয়ে যাবে সেই ‘সুন্দর মনের সরল সম্পর্ক’ টাইপ কিছু।
সংস্কৃতিক আগ্রাসন হলে আমাদের ভাষা আক্রান্ত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
এটা এমন আগ্রাসন যা হুট করে হয়না। বছরের পর বছর এমনকি যুগ যুগ ধরে হয় যা হয়তো আক্রান্তরা সহজে বুঝতে পারেনা এবং দ্রুত তার সমাধানরে পথও থাকেনা। আজ আমরা আমরা সচেতন হয়েছি এবং সমাধান অনুসন্ধান করছি কারন আমাদের মাতৃভাষা ও আমাদের সংস্কৃতি আক্রান্ত হয়েছে। এজন্য আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। আমাদরে নতুন প্রজন্মকে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পথ দেখাতে হবে, ভালো মন্দ সম্পর্কে সচেতন করাতে হবে।
প্রেম বা দেহ নির্ভর সংস্কৃতি সম্পর্কে এখনই সচেতন হতে হবে। কথার মধ্যে অন্য ভাষা ঢুকিয়ে দেওয়াকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। গায়ক’ সুরকার’ গীতিকাররা সুস্থ গান রচনা করার উদ্যেগ নিতে হবে। পরিচালকরা সুস্থ সিনেমা বানাতে হবে।
আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিল থাকায় হিন্দি সিনেমা অনেকের মতো আমারও প্রিয়।
কিন্তু অবসর সময়ে গান শুনার ক্ষেত্রে আমি অবশ্যই বাংলা গান শুনি কারন হিন্দি বা ইংলিশের চাইতে আমার মতে অবশ্যই বাংলা গান অনেক সমৃদ্ধশালী। আজ থেকে বছর তিনেক আগে আমার মেসে বন্ধুদের মধ্যে আমারই কম্পিউটার ছিলো। সবাই বিনোদনের জন্য হলেও আমার কম্পিউটার ব্যবহার করতো। তখন আমার কম্পিউটার ইংলিশ এবং বিশেষ করে হিন্দি গান মুক্ত করার উদ্যেগ নেওয়ায় বেশ বাধার মুখে পেড়েছিলাম। ভাবতে ভালো লাগে এই তিন বছর পরে আমার দলে আমার বন্ধু বান্ধদের বেশ সমারোহ ঘটেছে।
সবাই আস্তে আস্তে সচেতন হচ্ছে। আমাদের ব্লগার ভাইয়েরাও এই কৃতিত্বের দাবিদার। সবাই অন্তত যার যার অবস্থানে থেকে চেষ্টা করলে আমি মনে করি আমাদের বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধ অবশ্যই করা যাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।