"দ্যাখ, দ্যাখ! পোলাপানদের অবস্থা দেখ!"
একটা ছবির দিকে তাকালাম। এইরকম ছবি এখন অনেক দেখা যায়। দেশের 'সংস্কৃতি' ধ্বংসের প্রোগ্রেস রিপোর্ট। ছেলে মেয়েরা শীশা ক্লাবে গিয়ে হুক্কা টানছে, নাইট ক্লাবে ডান্স করছে। কাপড় চোপড়ের হাল দেখে মনে হচ্ছে শরীর ঢাকা নয়, বরং দেখানোর জন্যই সেটা পড়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের আগ্রহই বেশি দেখা যাচ্ছে! শার্টের উপরের দিকে যে কিছু বোতাম আছে, মেয়েগুলো যেন সেটা জানেই না!
একই মেয়েকে দেখলাম অনেকগুলো ছেলের সাথে জড়াজড়ি করে ছবি তুলছে। বয়ফ্রেন্ড কে, অনলি ফ্রেন্ড কে, রেন্ডম গাই কে, কিছুই বুঝার উপায় নাই। ছেলেগুলোর চেহারা দেখে নিঃসন্দেহে বলা যায়, তারা যথেষ্ট পুলকিত। তাদেরকে আর কষ্ট করে আগুন পর্যন্ত যেতে হয় নি, আগুনই নিজে থেকে এসে তাদের পুড়িয়ে দিয়েছে!
এসব দেখতে দেখতে এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে শুধু বললাম, "হু!"
"সব ঐ হিন্দী সিরিয়ালের দোষ, বুঝলি!"
এইবার মুখ খুললাম, "হিন্দী সিরিয়াল কী করলো এখানে?"
"আরে ওসবে থাকেটা কী? শুধুই কূটনামি, আর পরকীয়া! বোগাস বোগাস গল্প নিয়ে কী সব সিরিয়াল তৈরী করে! ওরাই আমাদের সমাজটাকে ধ্বংস করে দিল!"
অস্বীকার করবো না, দেশে থাকাকালীন আমি নিজেও কিছু হিন্দী সিরিয়াল দেখেছি।
টিভির দখল থাকতো মা বোনের হাতে। আমাদের উপায় কী ছিল? "কাহানী ঘর ঘর কী" নামের একটা সিরিয়াল ছিল। সেখানে পল্লবী নামের এক নারী চরিত্র ছিল, যে কূটনামীকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। আসলেই যদি কেউ কূটনামী শিখতে চায়, তাহলে পল্লবী হতে পারে তার আদর্শ। কিন্তু একই সাথে গল্পটিতে পার্বতী নামেরও আরেকটা নারী চরিত্র ছিল।
আদর্শ নারী কাকে বলে, সে ছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মানুষ যদি সিরিয়াল দেখেই সবকিছু শিখে ফেলে, তাহলে পার্বতীর চরিত্র থেকে কেন কিছু শিখলো না?
আমি আমার মাকেই বলেছিলাম, "বাংলা নাটক দেখ না কেন?"
আম্মু বাংলার বর্তমান প্রজন্মের কয়েকজন বিখ্যাত নির্মাতার কয়েকটা নাটকের উদাহরণ দিল, যারা আর যাই হোক, "বাংলার সংস্কৃতি উন্নয়ন প্রকল্পে" অংশ নেয়ার দাবী করতে পারবে না। পরকীয়া সেখানেও আছে, কূটনামি সেখানেও আছে। গল্পটাও খুব একটা আহামরি কিছু না।
আমাদের জাতিগত সমস্যা হচ্ছে আমরা নিজদের দোষ অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেই।
বিখ্যাত অভিনেতা হাসুন মাসুদ ভাইতাঁর বাসাতেই একদিন এক আড্ডায় বলেছিলেন, "রাজীব! একটা জিনিস তুমি খেয়াল করলে দেখবে, সেই সমস্ত ছেলে মেয়েরাই স্কুলের ভাল রেজাল্ট করে, যাদের বাসার ফ্যামিলি এনভায়রনমেন্ট ভাল। "
তিনি আমাদের ক্রিকেট দল এবং বিসিবিকে নিয়ে মন্তব্য করছিলেন। তবে ঘটনা সত্যি। সে সমস্ত ছেলে মেয়েরাই ভাল থাকে, যাদের বাসার এনভায়রনমেন্ট ভাল।
বাবা দিনরাত অফিসে থাকেন, মা আড্ডা, শপিং এবং পার্টিতে ব্যস্ত থাকেন, ছেলে মেয়েরা বড় হয় আয়া বুয়াদের তত্বাবধানে।
শ্রদ্ধেয় পিতা অফিস থেকে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে রাতে বাড়ি ফিরে আসেন। ঘুমানোর আগে ছেলে মেয়েদের সামনেই তিনি এক পেগ স্কচ, অথবা ভদকা কিংবা বিয়ারের বোতল হাতে তাদের খোঁজ খবর নেন। আর সেই সন্তানেরাই যখন ক্লাবে গিয়ে মদ খায়, আমরা তখন নাক সিঁটকে বলি, "সব হিন্দী সিরিয়ালের প্রভাব!"
বউ পালিয়ে গেছে স্বামীর বন্ধুর সাথে, দোষ সেই হিন্দী সিরিয়ালের। স্বামীর সাথে তার কী কারণে বনলো না, এইটা তলিয়ে দেখার সময় দুইজনের একজনেরও নেই।
মেয়ে বেশি সাজগোজ করছে, দোষ হিন্দী সিরিয়ালের।
অতিরিক্ত মেকাপের ফলে মুখে তিনশো প্রজাতির ব্রণ উঠে গেছে, এখানেও দোষ হিন্দী সিরিয়ালের!
আমরা পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে চাইতাম কেবল মাত্র এই ভয়েই যে রিপোর্ট কার্ডে আব্বুর সিগনেচার লাগতো।
বিড়ি সিগারেট বা মদের কবল থেকে শতহাত দূরে থেকেছি কেবল এই ভয়েই যে মায়ের হাতে ধরা পড়লে পিঠের চামড়া নতুন করে রিপ্লেসড হবে।
আমাদের শৈশবেই সুপারম্যান দেখে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে কিছু বাচ্চা হাত পা ভেঙ্গে ফেলেছিল। গর্ধব কাকে বলে!
একবার এক 'হিমু'কে দেখেছিলাম রিকশাওয়ালার সাথে পাঁচটাকা ভাড়া নিয়ে তর্ক করছে। শালা আহাম্মক! বেকুবটা কেবল হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে খালি পায়ে হেঁটে ফকিরদের সাথে ভাত খাওয়া পর্যন্তই হিমুগিরি ফলায়, বইয়ের হিমু যে একবার এক রিকশাওয়ালাকে নিজের পকেটের দশ হাজার(অঙ্কে ভুল হতে পারে, তবে পরিমাণটা এরকমই) টাকা দিয়ে দিয়েছিল, সেটা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যায়।
আমার বোন দেশে থাকতে বিরাট কোটিপতি এক পরিবারের দুই বাচ্চাকে টিউশ্যন পড়াতো। বাচ্চাগুলো একদম ছোট ছোট। কেজি ওয়ান টুতে পড়তো। এই সমস্ত বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য প্রাইভেট টিউটরের প্রয়োজন নেই। মায়েরাই যথেষ্ট।
কিন্তু বড়লোকের কাম কাজই আলাদা, আমরা মধ্যবিত্তের বুঝবো কিভাবে?
বাচ্চাগুলো দেখতে ছিল একদম গ্রীক দেবশিশুর মতন। ওদের দেখলেই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করতো। আপু তাদের খুব একটা বকা ঝকা করতো না। আদর পেয়ে তারাও মাথায় উঠে গিয়েছিল।
একদিন কিছুতেই তারা পড়তে চাইছিল না।
আপু বাধ্য হয়েই তাদের ধমক দিল।
তখন ছোট মেয়েটা বলল, "চুপ মাগী!"
আমার বোনের মুখ মেশিনগানের(অবশ্যই গালাগালি না) মত চলে। কেউ একটা কথা বলে পার পেয়ে যাবে, সেটা কখনই হয় না। সেই বোনটাও মাত্র পাঁচ বছরের এক পুঁচকে মেয়ের কথায় হতভম্ব হয়ে গেল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
"কী বললা তুমি? কী বললা?"
মেয়েটা হয়তো বুঝে ফেলেছিল সে খারাপ কিছু বলে ফেলেছে। ঐ বয়সী বাচ্চাটা এই গালির মর্মার্থ বোঝার কথা না। তবে তার ভাই খুব উৎসাহী গলায় বলল, "ও বলতে চায়, তুমি একটা শাউয়ার পুৎ!"
আপু ঐরাতেই ঐ টিউশ্যন ছেড়ে দেয়।
বাচ্চাদুটোর কী আসলেই দোষ ছিল? তারা বড় হচ্ছে কাজের বুয়াদের হাতে। কাজের বুয়ারা তাদের শিখাবে টিচারদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়? এসব শিখতে হয় মা বাবার কাছ থেকে।
কিন্তু টাকা কামানোয় ব্যস্ত বাবা, শপিং এবং পার্টিতে ব্যস্ত মায়ের সময় কোথায় ছেলে মেয়েদের খোঁজ খবর নেয়ার? কাজের লোক আছে কিজন্যে? এত এত টাকা বেতন দিয়ে তাদের পোষা হচ্ছে কিজন্যে?
"কীরে? কোথায় হারিয়ে গেলি?"
বাস্তবে ফিরে বললাম, "না ভাবছিলাম। "
"কী?"
"ভাবছিলাম যে দোষ আসলেই কেবল হিন্দী সিরিয়ালের! দেশটাকে এক্কেবারে শেষ করে দিল!"
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।