মুক্তমত প্রকাশের প্লাটফর্ম ব্লগ। তাই ব্লগে বসতে ভা্ল লাগে....।
একটু পড়েই ট্রেন ছাড়বে ঢাকার উদ্দেশ্যে। মোটামুটি লম্বা জার্নি। আমার পাশের সিটে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক বসল।
কিছুক্ষণের মধ্যে নাক ডেকে ঘুমিয়ে গেল। আজব লোক তো। এত তাড়াতাড়ি মানুষ ঘুমিয়ে যেতে পারে? মুখোমুখি সামনের সিটে বসেছে এক জোড়া বয়স্ক দম্পতি। আমিও শরীরটা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লাম। ঝক ঝক শব্দে ট্রেন এগিয়ে চলল।
রাতের ট্রেনের জানালায় দেখছিলাম স্তব্ধ আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো, পাহাড়গুলো। কোথাও আবার আদিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ। সিমেন্ট কারখানাগুলো এখনো লোকে লোকারণ্য। আলো জ্বলছে, মেশিন ঘুরছে, মানুষগুলো কাজ করছে। অদ্ভূত সুন্দর সেই দৃশ্য।
ইয়ারফোনে গান বাজিয়ে চোখ বুজে রইলাম কিছুক্ষণ। মনে হলো কি যেন মিস করে ফেলছি। সামনের সিটের ভদ্রলোক খুবই ফিসফিস করে কথা বলছে। মায়া হচ্ছে অপরপ্রান্তের মানুষটার কথা ভেবে। আহা, বেচারী কি কিছু শুনতে পাচ্ছে?
ট্রেন থামল ভৈরব ষ্টেশনে।
ফ্লাটফর্মের দোকানগুলো খুব ছোট হলেও মোটামুটি সবই পাওয়া যায়। নেমে একটা সিগারেট ধরালাম। এরপর ট্রেনে এসে বসার পর দেখি পাশের ভদ্রলোক ফোন নিয়ে ব্যস্ত। ফিসফিস করে কথা বলছে। দেখে বুঝা যায় স্বাভাবিক কথা বলছে না।
হয়ত বৌয়ের সাথে কথা বলছে। দারুন রোমান্টিক লোক মনে হলো লোকটাকে। এত রাতে বাড়ি থেকে ফিরলেও ট্রেনে বসে বসে বউকে সঙ্গ দিচ্ছে। কথার মাঝে মাঝে চাপাস্বরে হেসে হেসে উঠছে। উনাকে দেখে আমারও কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল।
কিন্তু আমি কাকে ফোন করবো? যাকে ফোন করবো সেতো এখন ঘুমুচ্ছে নয়তো জেগে বসে আছে। কিন্তু কথা বলার অবস্থায় নেই। সেকি জানে যে প্রায় রাতে আমি তার বন্ধ ওয়ারিদ নাম্বারটা প্রেস করে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি? আমার আর ডায়াল করা হয়না। ইয়ারফোনটা আবার ওন করলাম। বেজে উঠলো মৌসুমী ভৌমিকের,‘এখন নাকি শব্দগুলো এক মূহুর্তে সাগর পেড়োয়, এখন নাকি যন্ত্রগুলো এপার থেকে আমার কথা তোমার পারে পৌছিয়ে দেয়!! দারুন কোইন্সিডেন্টতো!
ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো।
আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে মেসেজ লিখতে লাগলাম। এটা আমার রোজকার রুটিন। প্রতি সকালে ফোন খুলে তার কম করে হলেও দু’টা মেসেজ পাওয়া চাই-ই চাই। নয়তো অনুরাগ। কিছুক্ষণ পর পাশের সিটের লোকটি উঠে কোথায় যেন গেল।
আমি একা একা বসে গান শুনছি আর মেসেজ লিখছি। সামনে বসা দম্পতিদের দিকে তাকালাম। মহিলাটা পুরুষটার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। দুজনেই ঘুমিয়ে আছে। এবার পুরুষটা জেগে গেল।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কি যেন দেখলো। মহিলার গায়ের চাদরটা ঠিক করে পরিয়ে দিয়ে আবার চোখ বুজলো। এই বৃদ্ধ বয়সে বৌয়ের প্রতি যতœ বা ভালবাসা দেখে খুব ভাল লাগলো। আসলে বয়সে কি আসে যায়। সব বয়সেই ভাল বাসা যায়।
একটা লোক এসে বলল-ভাই এই সিটটা খালি। বললাম -না। একজন আছে। কোথায় যেন গেল। একটু বসি ভাই।
টিকেট ছাড়া উঠেছি তো এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। উনি এলে উঠে যাবো। বললাম -ঠিক আছে বসেন। ট্রেনের বয়গুলো হাতে ট্রেতে করে এটা ওটা কতকিছু যে আনা নেয়া করছে। কেউ কিনছে, খাচ্ছে।
আবার কেউ অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। লোকটা দু’পা সিটে তুলেই বসে পড়লো। বসাটা একেবারেই পছন্দ হলো না আমার। কেমন যেন বিরক্তি লেগে উঠলো লোকটির প্রতি। বসার একটু সুযোগ পেলে কি পা তুলে বসতে হয়? কিছুক্ষন পর পা দুলাতে আরম্ভ করলো সিটে বসেই।
আমার যেন মাথা গরম হতে লাগলো। লোকটি কখন ফিরে আসবে অপেক্ষা করতে লাগলাম। লোকটি জিজ্ঞেস করল -ট্রেন কয়টার সময ঢাকা পৌছোবে? বললাম –জানি না। আসলে জানি কিন্তু বলতে ইচ্ছে করলো না। আবার মুখ ফিরিয়ে রোকটা পা দেলানো শুরু করলো।
এবার সত্যি মাথাটা গরম হয়ে উঠলো। কিন্তু কিছু বলার আগেই সিটের লোকটি ফিরে এলো। সিটে বসা লোকটি কিছু না বলেই উঠে পড়লো। আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
লোকটি বসে আবার ফোনে কথা বলা শুরু করলো।
আর গান শুনতে ইচ্ছে করলো না। ইয়ারফোনটা অফ করলাম। কিন্তু কান থেকে খুললাম না। লোকটি একটু জোরেই কথা বলা শুরু করলো। হয়ত ভাবছে আমি তো গান শুনতেছি।
কিছু শুনা যাবে না। আমারও আসলে কিছু শুনার ইচ্ছে করছিল না। স্বামী-স্ত্রীর একান্ত কথা অন্য কেউ শোনা ঠিকও না। কিন্তু শব্দগুলো আমার কান পর্যন্ত এসে পড়তে লাগলো। হটাৎ কানে এলো -আমার বৌ এতো কিছু খেয়াল করতে পারে না, সারাদিন তো কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়।
কোথায় কি হলো দেখার সময় কোথায় তার। তুমি যখন-তখন ফোন করো সমস্যা নাই। আমার কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হলো। বৌয়ের অগোচরে অন্য কারো সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে মনে হলো। ট্রেন চলছে।
আর লোকটি কথা চালিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে মনে হলো এডাল্ট প্রসঙ্গে চলে গেল কথোপকথন। আমার আর শুনতে ইচ্ছে হলো না। লোক আর ওপারের মেয়েটির ব্যাপারে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করলাম। ইয়ারফোনটা অন করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম।
মনে হলো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন তেঁজগাও রেল গেইটে এসে গেছি। সামনের সিটে বসা দম্পতিদ্বয় নেই। মনে হয় ক্যান্টনমেন্ট ষ্টেশনে নেমে গেছে। পাশে বসা লোকটি ওই সিটে গিয়ে বসে জানালায় তাকিয়ে আছে।
আমি মোবাইলটা বের করে সময় দেখলাম। তারপর একটা মেসেজ লিখলাম। ট্রেন কমলাপুর এতে থামলো। নামার আগে দেখলাম লোকটি কাল রাতের মেয়েটিকে ফোন করলো -বাসায় গিয়েই তোমাকে ফোন করতেছি। অফিস যাওয়া পর্যন্ত কথা বলবো কেমন? এরপর বৌকে ফোন করলো -আমি এসে পৌছেছি।
তুমি মার প্রতি খেয়াল রেখো। বাসায় গিয়ে সময় পেলে ফোন করবো। না হয় রাতে কথা হবে।
অনেকদিন পর দেখেছিলাম ঢাকার ভোর। খুব সকালে কখনোই উঠা হয় না আমার।
অচেনা এবং অপূর্ব। অনেকদিন পর আজ আবার সেই চেনা ভোর। ঢাকা। সেই চেনা শহর। সেই চেনা কমলাপুর স্টেশন।
কোলাহল নেই, খুব পরিষ্কারও মনে হলো। টানা তিনদিন পর আজ থেকে আবার আমার যান্ত্রিক জীবন শুরু হতে যাচ্ছে।
ট্রেনের দু’টি বিপরীত চরিত্র নিয়ে আর কিছু ভাবলাম না। নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় মনে হলো ভাবাটা। #
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।