আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওপার বাংলার সচেতনতাও বেশী : জনতার প্রতিরোধে ল্যাংটো রাজনীতি



ওপার বাংলার ইভটিজারদের বেপোরোয়া মনোভাব দেখে কাল (১৬ ফেব্রুয়ারি) যতটা খারাপ লেগেছে; আজ (১৭ ফেব্রুয়ারি) তার চেয়ে অনেক বেশী ভালো লাগা বোধ তৈরী হয়েছে জনতার প্রতিরোধের খবর জেনে। তাই আজ স্বিকার করতেই হচ্ছে- ওপার বাংলায় সচেতনতাও অনেক বেশী। আজও আনন্দবাজার পত্রিকা তার প্রধান প্রতিবেদন করেছে গতকালের সেই ঘৃণ্য ঘটনার ফলো-আপ প্রতিবেদন। এই ঘটনায় এ পত্রিকাটির ভূমিকা নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তাদের বলিষ্ঠ লেখনি যে ভাবে রাজনৈতিক নেতাদের ল্যাংটো করেছে; এপার বাংলার কোন কাগজে তেমন রিপোর্টিং কল্পনাতীত।

আজ তারা এ সংক্রান্ত মোট ৫টি প্রতিবেদন ও ১টি বিশ্লেষণ ছেপেছে। এগুলো আপনাদের জন্য তুলে ধরছি। শব দখলে রক্তারক্তি দিয়ে শেষ ‘পাশে দাঁড়ানো’র দিনভর টক্কর নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ষোলো বছরের এক কিশোরের নিথর দেহ ঘিরে বুধবার দিনভর নির্লজ্জ রাজনৈতিক টানা-পোড়েনের সাক্ষী রইল বারাসত। আর তার জেরে বাড়ির তরতাজা একটি ছেলে নৃশংস ভাবে খুন হওয়ার পরে এ দিন শোক করারও অবকাশ পায়নি দাস পরিবার। রাজনৈতিক নেতাদের সান্ত্বনা আর প্রতিশ্রুতির ধাক্কায় তাঁদের চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে।

দুপুর তখন সাড়ে বারোটা। বাণীকণ্ঠ নগরের একচিলতে ঘরের একফালি দরজার সামনে কার্যত ধাক্কা খেলেন দু’জন। এক জন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অন্য জন তৃণমূল নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৌগত রায়। নিহত রাজীব দাসের পরিজনদের সঙ্গে কথা বলে সৌগতবাবু যখন ওই বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন, তখন ভিতরে ঢুকছেন মুখ্যমন্ত্রী।

আবার তিনি বেরিয়ে যেতেই সৌগতবাবু-সহ তৃণমূল নেতাদের আর এক প্রস্ত আবির্ভাব! সৌগতবাবু সিপিএম-কে টেক্কা দিয়ে আগে রাজীবের বাড়িতে পৌঁছে গেলেও প্রতিশ্রুতি শোনানোর ক্ষেত্রে তাঁকে ‘হারিয়ে’ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী রাজীবের বাড়িতে প্রায় আধ ঘণ্টা ছিলেন। রাজীবের মা গায়ত্রীদেবীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কান্নায় ভেঙে পড়ে গায়ত্রীদেবী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সুবিচার চাইলে বুদ্ধবাবু তাঁকে বলেন, “দোষীরা শাস্তি পাবেই। ” রিঙ্কুকে বলেন, “দু’দিন পরে তোমার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করো।

একটা কিছু ব্যবস্থা করবই। ” এর পরেই শেষ বিকেলে মহাকরণে সাংবাদিকদের ডেকে মোবাইল-ফোন মারফত অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের ঘোষণা শোনান তাঁর ব্যক্তিগত সচিব। অসীমবাবু তখন মহাকরণে ছিলেন না। তাই রীতিমতো ‘আয়োজন’ করে মোবাইলের লাউড স্পিকার খুলে সচিব শুনিয়ে দেন অর্থমন্ত্রীর আশ্বাসবাণী— ‘রাজ্য সরকার নিহত রাজীব দাসের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। রাজীবের দিদি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে ওঁদের অন্য ভাবে অতিরিক্ত কী সাহায্য করা যায়, সে ব্যাপারেও মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন।

’ অবশেষে অর্থমন্ত্রীর আগ্রহী প্রশ্ন— “সাংবাদিকেরা আমার সব কথা ঠিকঠাক শুনতে পেয়েছেন তো?” দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী রাজীবের বাড়ি থেকে বেরোনোর পরে তিলমাত্র অপেক্ষা করেননি তৃণমূল নেতারা। ফের সৌগতবাবু বাড়ির ভিতরে ঢোকেন। সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার এবং জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। মুখ্যমন্ত্রী ‘কিছু একটা’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জেনে চাকরির প্রতিশ্রুতির সঙ্গে ‘বাড়তি’ হিসেবে রাজীবের দিদি রিঙ্কুর হাতে কুড়ি হাজার টাকাও তুলে দিয়ে তাঁরা বলেন, “এটা মমতাদি পাঠিয়েছেন। এই পরিবারের এক জনের চাকরির ব্যবস্থা উনি করবেন।

পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব এখন দিদিরই। ” বাইরে তখন চিৎকারে গলা ফাটাচ্ছেন সিপিএম সমর্থকেরা। তাঁদের দাবি: মৃতের বাড়িতে ঢুকে রাজনীতি করা চলবে না। যদিও কিছু ক্ষণ আগে যখন মুখ্যমন্ত্রী ভিতরে ছিলেন, তখন একই স্লোগান ছিল তৃণমূল কর্মীদের গলায়। মুখ্যমন্ত্রী ভিতরে থাকাকালীন বাইরে সিপিএম-তৃণমূলের কর্মী-সমর্থক ও পুলিশের ভিড় উপচে পড়েছে।

চলেছে চিৎকার-ধাক্কাধাক্কি। গোলমাল এড়াতে বাড়ির দরজাটা কেউ ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাইরে থেকে লাথি মেরে তা ভেঙেই ফেলা হয়। কে আগে পৌঁছলেন, কে আগে প্রতিশ্রুতি শোনালেন, কে রাজীবকে আগেভাগে দলের সমর্থক বলে ঘোষণা করলেন, দিনভর চলল তারই টক্কর। যা কদর্যতম চেহারা নিল দুপুর তিনটে নাগাদ, যখন বারাসত থানায় পৌঁছল রাজীবের মৃতদেহ।

সেখানে মালা দেওয়ার নাম করে ম্যাটাডোর থেকে দেহ নামিয়ে তা মধ্যমগ্রাম পুরসভার পাঠানো শববাহী গাড়িতে তুলে দেন তৃণমূলের নেতা কর্মীরা। ওই শববাহী গাড়িতে তৃণমূলের পতাকাও লাগানো ছিল। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে বচসা বাধে দাসবাড়ির পাড়াপড়শি-বন্ধুদেরও, যাঁরা সোমবার রাত থেকে হাসপাতালে ছিলেন রাজীবের পরিবারের পাশে পাশে। মৃতদেহে রাজনৈতিক দখলদারির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাঁরাও মার খান। রাজীবের অভিন্নহৃদয় বন্ধু সমর দাস ও নয়ন হালদারের জামা-কাপড় ছিঁড়ে যায়, রক্ত ঝরতে থাকে।

এই অবস্থায় পাড়ায় ফোন করেন রাজীবের পরিজনেরা। গলির মুখে জড়ো হন উত্তেজিত জনতা। শববাহী গাড়ি আসামাত্র তার থেকে নামিয়ে নেওয়া হয় রাজীবের দেহ। বন্ধু-পরিজনদের কাঁধে কাঁধে রাজীব যখন শেষ বারের মতো বাড়িতে যাচ্ছেন, তখন শববাহী গাড়ি থেকে দলীয় পতাকা খুলে দেন জনতা। তাঁদের রুখে দাঁড়াতে দেখে রাজনৈতিক নেতারাও টের পেয়ে যান, পরিস্থিতি বেগতিক।

খানিকক্ষণের মধ্যে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন তাঁরা। বাড়ি থেকে ফের ম্যাটাডোরে করে নিমতলা শ্মশানের পথে রওনা হয় রাজীবের দেহ। তাতেও অবশ্য হাল ছাড়েননি রাজনীতির কারবারীরা। আজ, বৃহস্পতিবার বারাসত মহকুমায় ১২ ঘণ্টার বন্‌ধ ডেকেছে এসইউসি। তাকে ‘নৈতিক সমর্থন’ জানিয়েছে কংগ্রেস।

বস্তুত কংগ্রেস এ দিন আসরে নামে অনেকটা দেরিতে। কংগ্রেস নেতারা রাজীবের বাড়িতে যান বিকেলে। অন্য দিকে তৃণমূল কংগ্রেস আজ জেলা জুড়ে ‘কালা দিবস’ পালনের কথা ঘোষণা করেছে। সোমবার রাতে জেলাশাসকের বাড়িতে যে পুলিশকর্মীদের ডিউটি ছিল, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের গ্রেফতার না-করা হলে ডিএমের বাড়ি ও অফিস ঘেরাও করার হুমকিও দিয়ে রেখেছে তৃণমূল। জনতার প্রতিরোধের মুখে মুখ্যমন্ত্রী-সাংসদ অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য • কলকাতা রেল অবরোধের রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়েছিল বারাসতের বামুনগাছি।

সেই বারাসতের আমজনতাই এ বার ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করে খুন হওয়া কিশোরকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির দড়ি টানাটানির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। পথে নেমে, স্লোগান দিয়ে তাঁরা দাবি জানালেন, ভোটের দিকে তাকিয়ে মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করা বন্ধ হোক। নিহত কিশোরের বাড়িতে যাওয়ার সময়ে সেই বিক্ষোভে আটকে পড়লেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সাংসদ। মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় ঘুরপথে নিয়ে যেতে হয়। আমজনতার বিক্ষোভ গড়ায় সড়ক থেকে রেলপথেও।

প্রতিবাদ এতটাই তীব্র ছিল যে, নিহত কিশোরের শেষ যাত্রার জন্য মধ্যমগ্রাম পুরসভার পাঠানো ফুলে সাজানো শববাহী গাড়িও প্রত্যাখান করে জনতা। ম্যাটাডোরে চাপিয়ে তাঁরাই রাজীবের মৃতদেহ নিয়ে যান শ্মশানে। শেষ যাত্রায় রাজনৈতিক নেতা বা প্রশাসনকে ঘেঁষতে দেয়নি বারাসত। গত সোমবার রাতে বারাসত স্টেশন থেকে বাণীকণ্ঠ নগরে বাড়ি ফেরার পথে দিদি রিঙ্কু দাসের শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করায় খুন হতে হয় ১৬ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব দাসকে। রাস্তায় ফেলে তাকে পিটিয়ে-কুপিয়ে মারে তিন মদ্যপ যুবক।

ভাইকে বাঁচাতে রিঙ্কু অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলোর গেট ধরে চিৎকার করে কেঁদে কাকুতিমিনতি করলেও সাহায্যের জন্য আসেননি কেউ। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর প্রত্যাশিত ভাবেই তৎপরতা শুরু হয় শাসক ও বিরোধী মহলে। শুরু হয় সহানুভূতি জানানো এবং মৃত কিশোরকে নিজেদের লোক বলে প্রমাণ করার প্রতিযোগিতা। আর তখনই রুখে দাঁড়ান বীতশ্রদ্ধ, ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। বুধবার সকাল থেকে বাণীকণ্ঠ নগর ও তার লাগোয়া এলাকায় সব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে আমজনতার যে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে, তাতে ৮০ বছরের বৃদ্ধ থেকে ক্লাস সিক্স-সেভেনের বাচ্চারাও সামিল।

দূরদূরান্ত থেকে এসে সেই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন এমন মানুষেরা, যাঁদের সঙ্গে দাস পরিবারের কোনও আত্মীয়তা বা যোগাযোগই নেই। তাঁরাও রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে গলা ফাটিয়ে বলেছেন, “এখন বাড়ি এসে নাম কিনতে চাইছেন? বদমাইশ ছেলেগুলো যখন দিনের পর দিন রাস্তায় মদ খেয়ে মাতলামো করেছে, মেয়েদের উত্যক্ত করেছে, তখন কোথায় ছিলেন? মেয়েটা যখন সাহায্য চাইল, কোথায় ছিলেন প্রশাসনের কর্তারা?” এ দিন সকালে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজীবদের বাড়ি যাবেন খবর পাওয়ার পরেই বারাসত হাসপাতালের সামনে যশোহর রোড আটকে দেন স্থানীয় জনতা। তাঁদের সঙ্গে কোনও দলের পতাকা ছিল না। প্রায় তিন ঘণ্টা পার হতে চললেও অবরোধ ওঠে না। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে।

এই অবস্থায় ছুটে আসেন পুলিশের বড় কর্তারা। অনেক বুঝিয়েও আমজনতাকে তাঁরা নরম করতে পারেন না। তত ক্ষণে ওই রাস্তা দিয়েই রাজীবদের বাড়ি যাবেন বলে চলে এসেছেন তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার। বাধায় তাঁর গাড়িও আটকে যায়। তার পিছনেই আটকে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়।

মুখ অন্ধকার হয়ে যায় পুলিশ কর্তাদের। জনতা তত ক্ষণে চিৎকার করতে শুরু করেছেন, “কোনও নেতার দরকার নেই আমাদের। কোনও নেতার গাড়ি ঢুকতে দেব না। কোনও রাজনৈতিক দলের গাড়ি ঢুকবে না। রাজনীতি করতে দেব না।

গো ব্যাক সিএম, গো ব্যাক এমপি। ” এই ভাবে মিনিট পাঁচ-সাত আটকে থাকার পর বাণীকণ্ঠ নগরের দিকে ঘুরতে না-পেরে সোজা বামুনগাছির দিকে চলে যায় মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়। সেখান থেকে ফের ঘুরে পিছন দিক দিয়ে রাজীব দাসের বাড়ির প্রায় ৫০০ মিটার দূরে দাঁড়ায় তাঁর গাড়ি। সেখান থেকে গলির মধ্যে দিয়ে বাকি পথটা হেঁটেই যেতে হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। দু’তিন মিনিটের সেই যাত্রাপথে আশপাশে দাঁড়ানো ভিড় থেকে লাগাতার উড়ে আসে টুকরো-টুকরো বাক্য, “এখানে আসছেন কেন? দরকার নেই।

রাজনীতি করতে দেব না। ” মুখ্যমন্ত্রী বেরিয়ে যাওয়ার পরেই ফের ওই চত্বরের দখল নিতে উদ্যত হয় তৃণমূল। বাড়ির সামনে লটকে দেওয়া হয় তৃণমূলের পতাকা। সেখানে যান কাকলি ঘোষদস্তিদার, সৌগত রায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তখনই পাশের বাড়ির বাসিন্দা অনিতা হালদার চেঁচিয়ে বলতে থাকেন, “কী শুরু করেছেন আপনারা? কখনও মুখ্যমন্ত্রী আসছেন, তৃণমূলের লোক বিক্ষোভ দেখাচ্ছে।

কখনও আপনারা আসছেন, সিপিএমের লোক বিক্ষোভ দেখাচ্ছে! রাজনীতি হচ্ছে? বাচ্চাটা মরার পরে মুখটা পর্যন্ত এখনও দেখতে পেলাম না। কোথায় ছিলেন, যখন সবাই মিলে পিটিয়ে ওইটুকু ছেলেটাকে মেরে ফেলল?” চারপাশে থাকা মহিলারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে বলতে থাকেন, “সামনে তো ভোট, তাই আসছেন। কপালে নানা দলের পতাকা বেঁধে আসছেন। দূর হন আপনারা সবাই। ” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন অনেকে।

প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের উপরে বীতশ্রদ্ধ মানুষ সকাল দশটা নাগাদ জেলাশাসকের অফিসে বিক্ষোভ দেখান। সেই সময় অফিসের পাশে রাখা একটি মোটরবাইক চুরি করে পালাতে যায় দু’জন। বিক্ষোভরত জনতাই তাদের ধাওয়া করে ধরে ফেলে। তার পর শুরু হয় গণপিটুনি। পুলিশের গাড়ি তাঁদের উদ্ধার করতে এলে ক্ষুব্ধ জনতা সেই গাড়িকে হটিয়ে দেয়।

বলতে থাকে, “মদ-গাঁজা যারা বিক্রি করে, যারা সে সব খেয়ে মস্তানি করে, তাদের ধরতে পারিস না। আবার চোরদের বাঁচাতে এসেছিস?” পুলিশকে কার্যত পালিয়ে যেতে হয়। যাওয়ার সময় এক জনকে তারা কোনওক্রমে গাড়িতে তুলে নেয়। বাকি এক জনকে জনতা ছাড়ে না। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গিয়েছে।

কিন্তু এত সহজে কি রাজনৈতিক দলের নেতাদের ঠেকানো যায়? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ থেকে ম্যাটাডোরে চাপিয়ে রাজীবের মৃতদেহ বেলা তিনটা নাগাদ আনা হয় বারাসত থানায়। সেখানে মালা দেওয়ার নাম করে মৃতদেহ নামানো হয় নীচে। তার পরই ভিড় করে থাকা তৃণমূল নেতারা মৃতদেহ তুলে দেন মধ্যমগ্রাম পুরসভা পাঠানো শববাহী গাড়িতে। তাতে তৃণমূলের পতাকা লাগানো। তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে গায়ের জোরে এঁটে ওঠেননি রাজীবের প্রতিবেশী, বন্ধু ও আত্মীয়েরা।

প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাঁদের কেউ কেউ মারও খান। জামা ছিঁড়ে যায় রাজীবের দুই বন্ধুর। ওই শববাহী গাড়িতে চাপিয়েই মৃতদেহ আনা হয় রাজীবের বাড়ির গলির মুখে। রাজনীতির কারবারীদের জবরদস্তির খবর পেয়ে জড়ো হওয়া উত্তেজিত জনতা সেখানে শববাহী গাড়ি থেকে মৃতদেহ নামিয়ে নেন। খুলে দেওয়া হয় তৃণমূলের পতাকাও।

রাজীবের বন্ধুরা ষ্ট্রেচারে চাপিয়ে দেহটি বহন করে গলির ভিতরে নিয়ে যান। তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছে গোটা এলাকা। কিন্তু সেই কান্নাকে রাজনীতির কোনও রঙ যাতে স্পর্শ না-করে, তার অঙ্গীকার করেছেন সকলেই। মৃতদেহ রাজীবের বাড়ি থেকে বের করে বন্ধুরা তুলে দেন ম্যাটাডোরে। পিছনে আরেকটি ম্যাটাডোর।

ফুলে ফুলে ঢাকা রাজীবের দেহ নিয়ে ম্যাটাডোর চলে যায় নিমতলা শ্মশানের দিকে। এক কোণে তখন অবহেলায় দাঁড়িয়ে তৃণমূল পরিচালিত মধ্যমগ্রাম পুরসভার ফুলে সাজানো শববাহী গাড়ি। মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদের সাক্ষী হয়ে। সিপাই সাসপেণ্ড, খুনিদের নাগালই পায়নি পুলিশ নিজস্ব প্রতিবেদন মুখ্যমন্ত্রী নিজে এলাকায় ঘুরে গিয়েছেন। এসেছেন আইজি, ডিআইজি-সহ পুলিশের বড় কর্তারা।

কিন্তু বারাসতে রাজীব দাসের হত্যাকাণ্ডে বুধবার রাত পর্যন্ত কাউকেই গ্রেফতার করতে পারল না পুলিশ। বারাসত স্টেশনের কাছে একটি ক্লাবের দুই সদস্যকে মঙ্গলবারেই আটক করেছিল তারা। তদন্তকারীরা বুধবার দিনভর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। রাজ্য পুলিশের সঙ্গে তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে সিআইডি-কেও। অগ্রগতি বলতে এটুকুই! তবে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে সোমবার রাতে বারাসতের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জার বাংলো পাহারার দায়িত্বে থাকা রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল নিত্যগোপাল কর্মকারকে সাসপেণ্ড করেছে রাজ্য সরকার।

(রাজীবের দিদি রিঙ্কু দাস ভেবেছিলেন, ওটা জেলাশাসকের বাংলো। পরে জেলাশাসকের বাংলোর গেটে গিয়েও তিনি কাউকে পাননি)। সোমবার রাতে নিত্যবাবুর কাছে সাহায্য চেয়ে কাকুতি-মিনতি করেছিলেন রিঙ্কু। বুধবার সকালে সংবাদপত্রে ওই খবর প্রকাশের পরে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজেই চলে যান রাজীবদের বাড়িতে।

যান আইজি, ডিআইজি-রাও। ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও মুখ্যসচিব, এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) হাজির হন মহাকরণে। ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার রাতে। রাজীব মারা গিয়েছে মঙ্গলবার সকালে। কিন্তু রাজ্য সরকার এত দেরিতে জাগল কেন? আসলে মদ্যপ দুষ্কৃতীদের বেধড়ক মারধরে রাজীবের মৃত্যু, পুলিশের সাহায্য চেয়েও তাঁর দিদি রিঙ্কুর খালি হাতে ফিরে আসা ইত্যাদি ব্যাপারে মঙ্গলবার উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারকে প্রায় কিছুই জানানো হয়নি।

রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ এ দিন বলেন, “সোমবারের ওই ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে এবং আমাদেরও ঘটনার কথা জানাতে দেরি হল কেন, জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এত দেরি হওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল না। ” এ ব্যাপারে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের কাছে কৈফিয়ত চেয়েছেন মুখ্যসচিব। রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ করপুরকায়স্থ বলেন, “ওই ঘটনার একটি প্রাথমিক রিপোর্ট দিলেও যতটা গুরুত্ব দিয়ে খবরটা আমাদের কাছে আসা উচিত ছিল, জেলা প্রশাসন তা করেনি। তা হলে মঙ্গলবার পুলিশ করলটা কী? আসলে মঙ্গলবার সারা দিন পুলিশের তরফে কোনও তদন্তই করা হয়নি।

ওই দিন রাত দেড়টা নাগাদ র‍্যাফ-সহ একটি বড় বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন বারাসতের মহকুমাশাসক মেহমুদ আখতার। রাজীবের মোবাইল ফোন আততায়ীরা কোথাও ফেলে দিয়েছে কি না, সেই ব্যাপারে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। তার পরে পুলিশ যায় স্টেশনের কাছে একটি ক্লাবে। সেখান থেকে ক্লাবের দুই সদস্যের ঠিকানা জেনে তাঁদের বাড়ি যায় তারা। বাড়ি থেকেই আটক করা হয় ওই দুই সদস্যকে।

বুধবার সকালে পুরো বিষয়টি প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের নজরে আসার পরে রাজ্য পুলিশের সঙ্গে ঘটনার তদন্তে নামানো হয় সিআইডি-কেও। মুখ্যসচিব বলেন, “খুবই খারাপ ঘটনা। সিআইডি তদন্ত শুরু করেছে। ” রিঙ্কুর দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী আততায়ীদের আঁকা ছবি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি শুরু হয়েছে। প্রসেন দাস নামে এক যুবক সোমবার রাতে রাজীবকে রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ভ্যানরিকশায় তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।

এ দিন তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ঘটনার সময় ট্রেন থেকে নেমে একটি ভ্যানরিকশায় চেপে বারাসতের চার বাসিন্দা বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁদের সামনেই রাজীবকে বেধড়ক মারধর করা হচ্ছিল। তাঁরা রাজীবকে বাঁচাতে গেলে আততায়ীরা তাঁদেরও ভয় দেখায়। আততায়ীদের এক জন ভ্যানরিকশার চালককে রিভলভারের বাট দিয়ে মারে।

ভ্যানচালক এবং সেই আরোহীদের ডেকে পাঠিয়ে দুষ্কৃতীদের আঁকা ছবি দেখানো হয়েছে। পুলিশের দাবি, এক আরোহী আততায়ীদের এক জনকে চিনতে পেরেছেন। সোমবার রাতের ঘটনার সঙ্গে আটক দুই ব্যক্তি কতটা যুক্ত? পুলিশ জানায়, যেখানে রাজীবকে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়, সেখান থেকে ৩০০ মিটারের মধ্যে একটি ক্লাব রয়েছে। সদস্যেরা অনেক রাত পর্যন্ত ক্লাবে থাকেন। পুলিশের সন্দেহ, বারাসত আদালতের সেরেস্তায় বসে যারা মদ খায়, তাদেরই কয়েক জন রাজীবকে খুন করেছে।

ওই ক্লাবের সদস্যেরা তাদের চেনেন কি না, পুলিশ তা জানতে চাইছে। সেই জন্যই ক্লাবের দুই সদস্যকে আটক করেছে তারা। মঙ্গলবার রাতেই রিঙ্কুকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। কোন জায়গায় তাঁদের সাইকেল থামানো হয়েছিল, ঠিক কোথায় তাঁর ভাইকে রাস্তায় ফেলে পেটানো শুরু হয়, কোন কোন বাংলোয় গিয়ে তিনি ভাইকে বাঁচানোর সাহায্য চেয়েছিলেন— পুলিশকর্তাদের সবই দেখান রিঙ্কু। ওই ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেফতার করা গেল না কেন? এডিজি সুরজিৎবাবু বলেন, “খুব স্পর্শকাতর ঘটনা।

তাই ঠিক লোককে গ্রেফতার করতে হবে। সবিস্তার তদন্তের পরেই সেটা করা হবে। ” সিআইডি-কে কোনও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে কি? মুখ্যসচিব বলেন, “এমন ভাবে কোনও সময়সীমা দেওয়া হয়নি। তবে আমরা চাই, সিআইডি পারলে আজকেই ব্যবস্থা নিক। সেই সঙ্গে এমন ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না-ঘটে, তা দেখতে হবে।

” এই ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্য জুড়ে তোলপাড় হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সমরবাবু। রাত-বিরেতে বিপদে পড়লে পুলিশের কাকে জানাতে হবে, তাঁর ফোন নম্বর কী— এ-সব তথ্য লোককে জানানোর ব্যবস্থা নেই কেন? মুখ্যসচিবের জবাব, “আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাজার, বাসস্ট্যাণ্ডের মতো জনবহুল প্রকাশ্য স্থানে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ এবং তাঁর টেলিফোন নম্বর টাঙিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। ” বারাসতের ওই ঘটনাস্থলের মতো গোটা রাজ্যেই রাতের দিকে পুলিশি টহলদারির ব্যবস্থা করতে হবে বলে জানান মুখ্যসচিব। এডিজি বলেন, “রাতের পুলিশি টহল আছে। তবে তা আরও জোরদার করতে হবে।

” চোলাই মদ বিক্রির বাড়বাড়ন্তও ঠেকানো যায়নি, কার্যত তা স্বীকার করে নিয়ে এডিজি-র অসহায় বক্তব্য, “নির্দেশ তো দেওয়াই আছে। আবারও নির্দেশ পাঠাচ্ছি। ” তাঁর কথায়, “আসলে চোলাই মদ বিক্রেতাদের জরিমানা ও শাস্তি খুবই কম। তাই ধরা পড়লেও ছাড়া পেয়ে আবার ওরা সেইব্যবসা শুরু করে দেয়। ” পাশে দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক, বলছেন কর্তারা সাহায্য না-করে পুলিশ বিপাকে ফেলল শাসক দলকেও নিজস্ব প্রতিবেদন ভাইকে রাস্তায় ফেলে মারছে দেখে অসহায় দিদি সাহায্য চেয়ে তাঁর কাছে কাকুতি-মিনতি করেছিলেন।

কিন্তু সব জেনেও তিনি কোনও রকম সাহায্য করেননি বলে অভিযোগ। ওই অভিযোগের ভিত্তিতেই বুধবার সাসপেণ্ড করা হয়েছে রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল নিত্যগোপাল কর্মকারকে। ঘটনার সময় বারাসতের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জার বাংলো পাহারার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নিত্যগোপালবাবু জানিয়েছেন, ভাইকে বাঁচানোর জন্য রিঙ্কু দাস তাঁর সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলো (রিঙ্কু প্রথমে ভেবেছিলেন, ওটাই জেলাশাসকের বাংলো।

ঘটনার পরে তিনি তেমনই জানিয়েছিলেন। ) ছেড়ে যেতে পারবেন না বলে রিঙ্কুকে জানান। রিঙ্কুকে থানায় ফোন করে সব কিছু জানাতে বলেন তিনি। কিন্তু ওই কনস্টেবল তাঁকে থানার ফোন নম্বর দেননি। রিঙ্কুও তাঁর কাছে থানার ফোন নম্বর চাননি বলে তাঁর দাবি।

তিনি জানিয়েছেন, হাসপাতালের সামনে পুলিশের যে-গাড়ি রয়েছে, তার কাছে গিয়ে সাহায্য চাওয়ার জন্য তিনি রিঙ্কুকে পরামর্শ দেন। পুলিশ জানায়, ওই বাংলো থেকে হাসপাতাল অন্তত ৫০০ মিটার দূরে। সোমবার রাতে দুষ্কৃতীরা তখন রিঙ্কুর ভাই রাজীব দাসকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। রিঙ্কুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেলা পুলিশের কর্তারা জানতে পেরেছেন, ওই অবস্থায় ভাইকে দুষ্কৃতীদের কবলে ফেলে তাঁর অতটা দূরে যাওয়ার মতো মনের অবস্থা ছিল না। নিত্যগোপালবাবু ফিরিয়ে দেওয়ার পরে তাই তিনি সাহায্যের জন্য জেলাশাসকের বাংলোয় যান।

কিন্তু সেখানকার কোনও রক্ষীই গেট খুলে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। কারও সাড়াও পাননি রিঙ্কু। পুলিশের এই ভূমিকা বিধানসভা ভোটের আগে চিন্তায় ফেলেছে সিপিএম-কেও। এমনিতেই ভোটের আগে রাজ্য জুড়ে সন্ত্রাস এবং হিংসার মোকাবিলায় পুলিশের ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে বিরোধী শিবির থেকে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে রয়েছে প্রশাসন এবং সেই সূত্রে শাসক দলও। বারাসতের ঘটনা যে-হেতু রাজনৈতিক সংঘর্ষ নয়, তাই সাধারণ মানুষের মনে তার আরও খারাপ প্রভাব পড়বে বলে সিপিএম শিবিরেরই আশঙ্কা।

দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর মন্তব্যেও তার কিছুটা ইঙ্গিত মিলেছে। বিমানবাবু এ দিন পুরুলিয়ায় বলেন, “অন্যায় কাজ হয়েছে। রাগ, দ্বেষ থেকেই এই কাজ হয়েছে। পুলিশ আসার আগেই ঘটনাটি ঘটে। তবে তৎক্ষণাৎ পুলিশের আসা উচিত ছিল।

আর এমন ঘটনা যাতে না-ঘটে, তার জন্য দোষীদের আইনানুগ শাস্তি হওয়া উচিত। ” এই ধরনের ঘটনা কি রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রমাণ নয়? বিমানবাবুর জবাব, “রাজ্যের সাড়ে আট কোটি মানুষের পিছনে তো আর পুলিশের ঘোরা সম্ভবনয়। ” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “জেলাশাসকের বাংলোয় কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের যদি ঘটনাস্থলে যাওয়ার উপায় না-ও থাকে, তা হলেও মেয়েটিকে সাহায্য করার অন্য পথ ছিল। মেয়েটিকে ফোন নম্বর দেওয়ার বদলে তাঁরাই থানায় খবর দিতে পারতেন। পুলিশের টহলদার বাহিনীকে জানাতে পারতেন।

জেলাশাসক বা পুলিশ সুপারের বাংলো বা দফতরে ওয়্যারলেস ব্যবস্থা থাকে। তার মাধ্যমেও থানা বা অন্যত্র পুলিশবাহিনীকে জানানো যায়। কিন্তু ওখানে কোনওটাই করা হয়নি। ” ঘটনাচক্রে বুদ্ধবাবুই পুলিশ দফতরের দায়িত্বে আছেন। আর এখন ভোটের আগে পুলিশের ‘অকর্মণ্যতা’ নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে ক্ষোভ প্রশমন করতে তাঁকেই ‘তৎপর’ হতে হচ্ছে।

স্থানীয় মহলের ক্ষোভের মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও ‘ঝুঁকি’ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী যে নিহত রাজীবের বাড়ি গেলেন, সেটা সেই তৎপরতারই অঙ্গ। রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বুধবার মহাকরণে বলেন, “ওই মহিলা (রিঙ্কু) সাহায্য চেয়েও পাননি। তাঁর কান্না শুনে সঙ্গে সঙ্গে ওই কনস্টেবলের (নিত্যগোপালবাবুর) ঘটনাস্থলে যাওয়া উচিত ছিল। তিনি কর্তব্যে গাফিলতি করেছেন। সেই কারণেই তাঁকে সাসপেণ্ড করা হয়েছে।

” রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ করপুরকায়স্থও বলেন, “কোনও মানুষ বিপদে পড়ে পুলিশের কাছে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে কারও প্রাণ বাঁচানোর প্রশ্ন উঠলে সেই কাজটাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। ” তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষ যদি এই কাজ করতে এগিয়ে আসেন, তা হলে আমরা তাঁর প্রশংসা করি। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে এই কাজ করা বাধ্যতামূলক।

” রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা বলছেন ‘বাধ্যতামূলক’। কিন্তু কী বলছেন ভিআইপি বাংলোয় পাহারার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীরা? এ ধরনের কাজ যে ‘বাধ্যতামূলক’, হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বর্ধমান এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ভিআইপি বাংলো পাহারার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীদের বেশির ভাগই তার খবর রাখেন না। বেশির ভাগেরই বক্তব্য, যদি এ-রকম ঘটনা কোনও ‘ফাঁদ’ হয়, তা হলে চাকরি যাবে সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্মীরই। কয়েক জন বলেছেন, “বারাসতের ঘটনার পরে দায়ে পড়ে পুলিশকর্তারা এ-সব কথা বলছেন। যদি সত্যিই তাঁরা এ-রকম চান, তা হলে এত দিন মৌখিক ভাবেও জেলার কর্তারা রক্ষীদের ওই নির্দেশ দিয়ে রাখেননি কেন?” হাওড়ার জেলাশাসক বা পুলিশ সুপারের বাংলোর পরিস্থিতিও বারাসতের মতোই।

রাত ৯টা থেকেই ওই এলাকা সুনসান হয়ে যায়। চোলাই মদের বিক্রিও চলে অবাধে। হাওড়ার জেলাশাসকের বাংলোয় পাহারার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশকর্মী বলেন, “কোনও আক্রান্ত ব্যক্তিকে গেটের বাইরে গিয়ে সাহায্য করা যাবে কি না এবং সেই ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম আছে কি না, আমি তা জানি না। অন্তত আমাদের কাছে তেমন কোনও নির্দেশ নেই। মানবিকতার খাতিরে সাহায্য করতে যাওয়া উচিত।

কিন্তু চাকরির কথা ভেবে অনেকেই এই দায়িত্ব নেবেন না। ” পুলিশ সুপারের বাংলো তথা সার্কিট হাউসের গেটের এক রক্ষী বলেন, “বারাসতের মতো ঘটনা হলে কী করব জানি না। এ ব্যাপারে কোনও নিয়ম বা নির্দেশ নেই। ” একই কথা বলেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক বা জেলা পুলিশ সুপারের বাংলো পাহারার দায়িত্বে থাকা সিপাইরা। তাঁদের বক্তব্য, “নিজেদের কাজ ছেড়ে অন্যকে সাহায্য করতে গেলে তো উল্টে কর্তাদেরই ধমক খেতে হবে।

চাকরি যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। ” এক পুলিশকর্মী বলেন, “এটা যে বাধ্যতামূলক, তা তো আগে কেউ জানাননি। বরং এ-যাবৎ উল্টোটাই দেখে এসেছি। ” বর্ধমানের জেলাশাসক, পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত জেলাশাসকের বাংলোয় যে-সব রক্ষী আছেন, তাঁদেরও একই মত। পুলিশ সুপারের বাংলোর এক রক্ষী বলেন, “আমার কাজ এই বাংলোর নিরাপত্তা দেখাশোনা করা।

তাই বাংলোর আশেপাশে যদি কোনও ঘটনা ঘটে বা কেউ সাহায্য চান, তা হলে বড়জোর থানা বা বাংলোর মধ্যে থাকা অন্য রক্ষীদের সেটা জানাতে পারি। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ” অতিরিক্ত জেলাশাসকের বাংলোর এক রক্ষীও জানান, এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তিনি থানায় জানাবেন। কিন্তু নিজের কাজ ফেলে এগিয়ে যাবেন না। পশ্চিম মেদিনীপুরে পরিস্থিতি অবশ্য ওই সব জেলার থেকে কিছুটা আলাদা।

সেখানে রাতে নিরাপত্তারক্ষীদের বাইরে যাওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কান্নার শব্দ বা কোনও কাতর আবেদন কানে এলেও বাইরে যাওয়ার নির্দেশ নেই। পুলিশ জানিয়েছে, পশ্চিম মেদিনীপুর মাওবাদী উপদ্রুত জেলা হওয়ায় নানা ধরনের আশঙ্কা থাকে। কেউ কান্নার অভিনয় করে ধ্বংসাত্মক কাজও করতে পারে। তাই সব সময় বাংলোর গেটে কড়া নিরাপত্তা রাখা হয়।

বন্ধ রাখা হয় দরজাও। তাই এই ধরনের ঘটনা ঘটলে জানানো হবে থানাকে। তাঁদের দাবি, দরজা খুলে নিরাপত্তারক্ষীরা কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেলে যতটা সময় লাগবে, তার থেকে আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে টহলদার ভ্যান। মাওবাদীদের ‘জুজু’ তাড়া করে বেড়াচ্ছে রাজ্যের সর্বত্র। এক পুলিশকর্মীর কথায়, “এ ভাবে বাইরে ডেকে, কর্তাদের উপরে আক্রমণের ছক থাকতে পারে।

আর সে-রকম কিছু হলে প্রথম কোপ পড়ত ওই সিপাইয়ের উপরেই। প্রথম প্রশ্নই করা হত, কার অনুমতি নিয়ে গিয়েছিলে? তখন কী জবাব দিত সেই সিপাই?” কনস্টেবলদের বক্তব্য, ওই তরুণী সিপাইকে নিয়ে যেখানে যেতে চেয়েছিলেন, সেখানে একাধিক সশস্ত্র দুষ্কৃতী থাকতে পারে। এক জন সিপাইয়ের পক্ষে তাদের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়। উল্টে তাঁর আগ্নেয়াস্ত্রও ছিনতাই হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক পুলিশকর্মীর কথায়, “বন্দুক চলে যাওয়ার অর্থ চাকরি চলে যাওয়া।

ডিপার্টমেন্ট কি তখন ছেড়ে দেবে?” তা হলে এ-রকম ঘটলে পুলিশকর্মীরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন? ‘পুলিশ রেগুলেশন’ বা পুলিশি কার্যবিধি কিন্তু তা বলছে না। সেখানে বলা হয়েছে, এ-সব ক্ষেত্রে ওই পুলিশকর্মীর উপরে যিনি আছেন, তাঁকে জানাতে হবে। তাঁর অনুমতি নিয়ে সক্রিয় হতে হবে পুলিশকর্মীকে। বারাসতে রিঙ্কুর কাতর আবেদন শুনেও নিত্যগোপালবাবু তা করেননি বলেই জেলার পুলিশকর্তারা এ দিন জানিয়েছেন। পুরোটা পোষ্ট করা যাচ্ছে না।

তাই দুটি লেখা বাদ দিতে বাধ্য হলাম। তবে আগের পোষ্টি দেখুন এখানেই ক্লিক করে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।