দিলের দরজা ২৪/৭ খুইলা রাখি মাছি বসে মানুষ বসে না। মানুষ খালি উড়াল পারে! এক দিন আমি ও দিমু উড়াল, নিজের পায়ে নিজে মাইরা কুড়াল...
*
আমাদের এক বন্ধু বলল এ যাত্রা হবে আমাদের অনিন্দ্য সুন্দর এক যাত্রা। আর আমরা সব বন্ধুরা সেই সুন্দরের পানে অনিন্দ্য সব যাত্রী। ১৯৯০ সালের কথা। মন্ট্রিয়লে আমরা ক'জন বাংলাদেশী বন্ধু মিলে অনিন্দ্যযাত্রিক নামে একটা গ্রুপ করে ছিলাম।
ইচ্ছে, বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধরে দূর পরবাসে কিছু একটা করা।
তৌফিক ভাই, শামীম, নাসিম, আশরাফ ভাই, তোতন ভাই, মেহেদী, স্কাউট সোহেল, আমি আমরা কয়জন মিলে সিএফএমবি রেডিও মন্ট্রিয়ল থেকে সপ্তাহে দেড়শো ডলার করে ভাড়া নিলাম আধা ঘন্টা এয়ার টাইম। প্রত্যেকে নিজের পকেট থেকে চাঁদা দিয়ে প্রতি শনিবার সন্ধ্যে সাতটায় মন্ট্রিয়লের সিএফএমবি বেতার কেন্দ্র হতে একদিন শুরু করে ছিলাম মন্ট্রিয়লের প্রথম বাংলা বেতার অনুষ্ঠান উত্তরঙ্গ। সে প্রায় একুশ বছর আগের কথা!
তখন ত আর এখনকার মত ডিজিটাল জীবন ছিল না, না টেলিফোনের এমন সুবিধা না ইন্টারনেট ব্লগ ফেইস বুক ইত্যাদি! প্রতিসপ্তাহে রেডিওর অনুষ্ঠানে খবর প্রচারের জন্য ঢাকায় ফোন করে সপ্তাহের পত্রিকার শিরোণাম গুলো সব সংগ্রহ করতে হত। টেলিফোন কলের জন্য বরাদ্দ থাকত সাপ্তাহে পঞ্চাশ ডলার।
মিনিটে তিন ডলার করে লাগত তখন ফোন কলে। খবর ছাড়া গান, আবৃত্তি, নাটক স্বাক্ষাৎকার আরো কত কি থাকত সেই অনুষ্ঠানে!
রেকর্ডিং যন্ত্র বলতে ছোট্ট একটা টেপ রেকর্ডার। না কোন মাইক্রোফোন না কোন সাউন্ড মিক্সার। আমাদের অনুষ্ঠান গুলো এডিট করত নাসিম ওর একটা ডুয়েল টেপরেকর্ডার সিটিজেন ডেকসেট ছিল সেটায়। হাতের মাপে রেকর্ড প্লে আর পজ বাটন মেরে মেরে এডিট করত নাসিম।
আমার কাছে আমাদের গ্রুপের একটা ছবি ছিল, কোথায় যে রেখেছি আজ তার খোঁজ নাই।
নব্বুই এর একুশে ফেব্রুয়ারীতে প্রচারের জন্য একটা ছোট নাটক লিখলাম নাম "দুই অন্কের পালা"। শহুরে মানুষের দেখা ফেব্রুয়ারী আর গ্রামের মানুষের জীবনে ফাল্গুন মাস। এই তুলনা করে সাত সমুদ্র তের নদী সেন্ট লরেন্টে পারের শহর মন্ট্রিয়লে বসে লিখলাম মিনি নাটক, দুই অন্কের পালা। অভিনয় আমরা মিলেমিশে করব বলে ঠিক করলাম।
দুই অন্কের পালা করতে যেয়ে আমাদের দরকার হয়ে ছিল দেশী কিছু সাউন্ড ইফেক্ট, আবহ সংগীত। গ্রামের আবহ, হাসের ডাক, গরুর ডাক, ঝিঝি'র ডাক ইত্যাদি। এমনিতে হাতুড়ে প্রোডাকশন সেখানে সাউন্ড ইফেক্টের স্টক থাকবে কই থেকে। সেন্ট লরেন্ট স্ট্রীটের ভারতীয় গ্রোসারী মদীনাতে শুধু পাওয়া যেত হিন্দী ছবি। কেন যেনো এই এইটুকু একটু কাজ করতে আমাদের সে কি আয়োজন! আপন দেশ সংস্কৃতি থেকে হাজার মাইল দূরে এসে এই হিম শীতল জীবনে আমাদের শুনতে ইচ্ছে হল, মহেষের মত কোন গরুর ডাক, সাঝেঁর মায়ায় একদল হাস পাখি'র ঘরে ফিরবার শব্দ, অদ্ভুত কোন ঝিঁঝিঁ ডাকা গ্রামীন মেঠো পথের মায়া আমাদের পেয়ে বসল যেনো।
এই যোযন দুরে কে শোনাবে আমাদের সেই ডাক, কোথায় গেলে পাবো ফেলে আসা অমন মেঠো পথ!
কোন উপায় না পেয়ে আমি আর নাসিম মদীনা থেকে বেছে বেছে এক গাদা হিন্দী ছবি ভাড়া করে আনি। তার পর ঐ ছবি গুলো চালিয়ে চালিয়ে খুজে খুজে বার করেছি সাউন্ডের টুকরাটাকরা ইফেক্ট। এখনো মনে পড়ে নাটকে ব্যবহার করা গরুর ডাকটা নিয়ে ছিলাম শ্যাম বেনেগাল মন্থন ছবি থেকে। ঝিঝি'র ডাক হাসের প্যাকপ্যাক অনেক কিছু পেয়ে গেলাম আমরা পেলাম না শুধু রিক্সার শব্দ। হায়রে তন্ন তন্ন করে খুজলাম।
হিন্দি সিনেমায় ত রিক্সার কোন দৃশ্য থাকার কথা না। অবশেষে বুদ্ধি খোলে নাসিমের কিচেনের ছোট্ট একটা বাটিতে চামচ পিটিয়ে বের করে ছিলাম সুন্দর রিক্সার টুংটাং শব্দ। আজকের সময়ে দাড়িয়ে এখন এসব কথা ভাবলে নিজেরই বিশ্বাস হয় না। এইত সেদিনের কথা, অথচ লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে ইতিহাসের কোন বিবর্ন পৃষ্ঠার মত!
গতবার ঢাকায় ফেরার সময় আমার অটোয়ার বাড়ির বেইজমেন্ট এ এক গাদা বাক্সো ঘেটে আমি পুরোনো কিছু অডিও ক্যাসেট এর মাঝে খুজেপাই উত্তরঙ্গের কয়েকটা পর্ব। টেপটা হাতে নিয়ে চোখ দুইটা ছল ছল করে উঠল।
কত স্মৃতি মেশানো আমাদের সেইসব অনিন্দ সময়!
ঘরে ক্যাসেট প্লেয়ারে আর কেউ গান শোনে না। এখন ইউটিউব, আইটিউন আর আইপডের যুগ। বেইজমেন্ট হাতরে পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ারটা পাওয়া গেল। আমি সাথে সাথে অনুষ্ঠান কয়টা আমার হাতের অলিম্পাস রেকর্ডারটায় ডিজিটাইজ করে রেখে দিলাম।
সেই রেডিও অনুষ্ঠান থেকে একুশের অনুষ্ঠানের একটা অংশ শেয়ার করার শখ হল।
এখন অডিও আপলোড করার আলাদা কোন একাউন্ট আমার না থাকায়, অডিও ফাইলটার ওপর একটা স্টিল ছবি বসিয়ে ভিডিও বানিয়ে আমার ইউটিউব একাউন্টে আপলোড করে এইখানে লিংন্কটা শেয়ার করলাম। জীবনে অভিনয় করবার সখ ছিল অনেক। সেই সাধ মিটিয়েছিলাম এই রেডিও অনুষ্ঠান করতে যেয়ে।
পত্রিকা, ব্লগ, টিভি ইন্টারনেট এসব এখন পান্তাভাতের মত কেন ব্যাপার না। আজকের ব্লগাব্লগীর এই সময়ে আমার নিজেরই ভাবতে অবাক লাগছে ঐরকম একটা সময় কখনো ছিল!
শামীম আর নাসিম এখন থাকে টরন্টোতে।
আশরাফ ভাই এনজিও'র চাকরী নিয়ে কখনো আফগানিস্থান কখনো আজারবাইজান। তৌফিক ভাই বিয়েশাদী করে মন্ট্রিয়লে সেটেল্ড। মেহেদী দেশে ফিরে ব্যান্ডের কীবোর্ড বাজায়। তোতন ভাই এখন মন্ট্রিয়লে বাড়ী কেনাবেচা করেন। সোহেল নিউইয়র্কে।
ফেসবুকে প্রায়ই ডেকে ওঠে মামু বলে। আর আমি এখনো যাযাবর, দেশবিদেশ করে বেড়াই। আজ এখানে ত কাল ওখানে, আমার তেমন কোন ঠিকানা নেই। অনেক দিন পর নিজের লেখা দুই অন্কের পালা শুনতে যেয়ে মনে হল, জীবনটাই বুঝি এমন দুই অন্কের এক বিপরীত টিকে থাকা...
* কাল রাতে ব্লগটা লিখতে যেয়ে আধা লিখে পোস্ট করে ঘুমিয়ে পরি। সকালের দিকে লেখাটায় চোখ বুলাতে যেয়ে আরো কিছু স্মৃতিকথা জুড়তে যেয়ে লেখটা এলোমেলো করে ফেলি।
পড়তে যেয়ে দেখি কি লিখেছি না লিখেছি আমি নিজেই ঠিক ধরতে পারছি না! খচখচানি থেকে রেহাই পেতে ব্লগের শিরোনামটা বদলে আবারো একটা পোস্ট লিখে কাজে মনোযোগী হই। তার পর সারা দিন কাজের ফাকে ফাকে একটু একটু করে লেখাটা মনে হয় আরেকবার লিখে ফেলেছি। সে কারনে পুরোনো পোস্ট গুলো মুছে এই স্মৃতি জাগানিয়া ব্লগটা নতুন করে আবার পোস্ট করা। যারা আগের লেখা পরে মন্তব্য করে গেছেন তাদেরকে আবারো ধন্যবাদ।
সকলের জন্য শুভ কামনা।
* আজ এই মাত্র, বন্ধু শামীম কে দেখলাম ফেইস বুক এ এই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি'র ছবিটা আপলোড করেছে। দেখে এক মুহূর্ত দেরী না করে ছবিটা এই পোস্টের সাথে জুড়ে দিলাম। যাই শামীমকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসি!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।