এয়ারপোর্ট স্টেশনে ট্রেনটা যখন থামল তখন রাত সাড়ে দশটা । এখন দশটা পঁয়ত্রিশ । ওয়েটিং রুমে বসে আছে অনূপ । চিটাগং থেকে হেড অফিসে মাসিক মিটিংয়ের জন্য এসেছে সে । প্রতিবার ঢাকায় এসে খিলখেতে বন্ধুর বাসায় ওঠে।
ট্রেইন থেকে নেমে যথারীতি গেইট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে সবাই । কিন্তু অনূপ ওয়েটিং রুমের দিকে হাঁটতে লাগল উদ্দশ্যহীনের মত । দরজা দিয়ে ঢুকেই হাতের ডান দিকের প্রথম সারির দ্বিতীয় চেয়ারে বসল সে । নাহঃ কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে না ! প্রথম চেয়ারটি ফাঁকা । রুমে আরো অনেকগুলো চেয়ার ফাঁকা ।
কয়েকজন এদিক-ওদিক বসে আছে । কয়েকজন আসছে-যাচ্ছে...। কেমন যেন উদভ্রান্ত লাগছে সবাই কে । উত্তর পাশের এক কোণায় ছোট্ট একটা বাচ্চা কে কোলে নিয়ে নিরিহের মত বসে আছে এক মহিলা । বয়স কত হবে...বাইশ/তেইশ ।
পাশে এক বৃদ্ধ আরাম করে ঘুমাচ্ছে । তার নাসিকা গর্জন ট্রেইনের হুইসেলকেও হার মানায় । হই-চই আর শব্দের মধ্যে কিভাবে যে ঘুমায় । ভেবে পেল না সে । একজন ওয়াশ রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর মাঝে মাঝে পায়চারি করছে ।
প্রথম চেয়ারের দিকে চোখ পড়ল অনূপের । না...কেউ নেই ! এই এখানেই শেষবারের মত দেখা হয়েছিল রিনির সাথে । সম্পর্কের ইতি হয়েছে বছর দুই আগে । কিন্তু কথা হত মাঝে মাঝে । নতুন করে সম্পর্কটাকে জোড়ানোর চেষ্টা করেছে বহুবার ।
পারেনি...
মাঝে মাঝে দেখাও হতো দু'জনার । কয়েকমাস আগের কথা । তিনদিন যাবৎ রিনির প্রচন্ড জ্বর । অনূপ তখন ঢাকায় । সে বারও হেড অফিসে মাসিক মিটিংয়ের জন্য এসেছিল ।
রিনি ফোন করে জানালো তার জ্বর । হোস্টেল প্রায় ফাঁকা । অন্য রুম ম্যাটগুলোরও জ্বর । অধিকাংশই বাড়ি চলে গেছে । কিন্তু রিনি বাড়ি যেতে নারাজ ।
এমন কি বাড়িতে তার অসুস্থতার কথা জানায়ওনি । হোস্টেলের কাউকে জানাতেও দেয়নি । ঘটনা জেনে প্রচন্ড বকুনি দিয়েছিল অনূপ ।
-আচ্ছা তুমি কি পাগল হয়ে গেছ ? আন্টি কে অন্তত জানাও প্লিজ ।
-না ।
এই সামান্য জ্বরের কথা বলে আম্মুকে চিন্তায় ফেলার দরকারটা কি ! তাছাড়া আমি নিজেই নিজের টেক কেয়ার করতে পারি ।
-তোমার এখন জ্বর কত ?
-একশ দুইয়ের কাছাকাছি । শরীর খুব ব্যথা করছে । ...
-মানিক ! প্লিজ তুমি আন্টিকে জানাও...
-ন্যাকামো করো না তো। ওষুধ খাচ্ছি, সাপোসিডার দিয়েছি , আশা করি কমে যাবে ।
-মাথায় পানি...
-প্রতি ঘন্টায় ওয়াশ রুমে যখন যাই তখন মাথায় পানি দিয়ে আসি । জ্বরটাকে খুব এনজয় করছি...
দেখি নিজেকে দেখাশুনা করতে পারি কিনা ।
-তুমি এত স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলছ কিভাবে ! তোমার মাথা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে...
তাহলে আমাকে জানালে কেন ?
-জানি না !
সেদিন রাতে রিনির বোন কে সব জানিয়েছিল অনূপ । কিন্তু রিনি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে তার অসুস্থ্যতার বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছিল ।
রিনি কে সে ভালোবাসে ।
বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা । কিন্তু দু'বছর আগে পারিবারিক আর চাকুরির সমস্যার কারণে রিনি কে দূরে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়েছিল সে । গলা টিপে হত্যা করতে হয়েছিল ভালোবাসা কে । ভুল বোঝাবুঝি সব কিছু কে তছনচ করে দিয়েছে । এটাই খুব স্বাভাবিক ।
রিনির কোন দোষ ছিল না । প্রতিটি মানুষই তার ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে হাজার হাজার স্বপ্ন দেখে । রিনিও এর ব্যতিক্রম ছিল না ।
মহিলার কোলে বাচ্চাটি কেঁদে উঠল । চমকে তাকালো অনূপ ।
ঘড়িতে দশটা সাইত্রিশ । বৃদ্ধ লোকটির ঘুম ভেঙে গেছে । ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে আবার ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে । যে লোকটি ওয়াশ রুমের সামনে পায়চারি করছিল তাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না । বোধয় ওয়াশ রুমের ভেতরে ।
নতুন আরো কয়েকজন বিচ্ছিন্নভাবে আশপাশে বসে আছে । শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে বাচ্চাটিকে দুধ খাওয়াতেই কান্না বন্ধ । অদ্ভুত পবিত্র দৃশ্যটি মুগ্ধ চোখে দেখছে সে । যদিও দেখা ঠিক হচ্ছে না তারপরও দেখছে । রিনি মাঝে মাঝে খুব আবেগ তাড়িত হয়ে বলত
-আমরা যখন বিয়ে করব আমাদের খুব কিউট একটা বেবি হবে ।
-হুমম...ঠিক তোমার মত ।
-না । তোমার মত । আচ্ছা তুমি কি চাও ? ছেলে নাকি মেয়ে ?
-মেয়ে !
মিষ্টি আর লাজুক হাসিতে ভরে উঠত রিনির মুখ । উষ্ণতায় বিভোর হয়ে দু'জনেই স্বপ্নের মধ্যে বুদ হয়ে থাকত অনেকক্ষণ ধরে ।
সব এখন শুধুই স্মৃতি !
পরদিন রিনি কে দেখার উদ্দেশ্যে তার হোস্টেলের সামনে গিয়ে সেল ফোনে কল দিয়েছিল অনূপ । দুপুর বারটা । একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু রিনির কোন খবর নেই । বাড়িতে ফোন করে তার জ্বরের কথা জানানোয় খুব রেগে গিয়েছিল সে । দুই তিনটা এস এম এস দিয়ে আধা ঘন্টা পর ফিরে এসেছিল সেদিন ।
খুব দুঃচিন্তা হচ্ছিল । ঢাকায় একা অসুস্থ্য একটা মেয়ে হোস্টেলে কেমন করে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না । মনে মনে রিনির ওপর খুব রাগ হচ্ছিল । সব সময় এত জেদ দেখায় ! এভাবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে কিসের প্রতিশোধ নিতে চায় সে ! সম্পর্কটাকে নতুন করে বাঁধার জন্য অনূপ চেষ্টা করেছে । প্রথম দিকে কথা বলতে চাইত না রিনি ।
ফোন রিসিভ করত না । অচেনা নম্বার থেকে ফোন করে শুধু তার কন্ঠ শুনত ।
-হ্যালো কে বলছেন ? হ্যালো...হ্যালোওওও...
ধূর কথা বলছেন না কেন ?
বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিত রিনি । সেটুকু শুনতেই ভালো লাগত অনূপের । কষ্ট হতো ।
তারপরও পরিচয় দিত না । অনেকদিন পর বিষয়টিকে স্বাভাবিক করে নিল রিনি নিজেই । মাঝে মাঝে ধানমন্ডি লেকে দু'জন মুখোমুখি বসে থেকেছে । কিন্তু রিনির জেদ আর একরোখাপনা নতুন করে সম্পর্কটাকে জোড়া লাগাতে পারেনি ।
-হ্যালো তুমি কোথায় ? আমি গোছল করছিলাম ।
স্যরি !
-আমি এখন মহাখালীর কাছাকাছি ।
-ওখানে নেমে অন্য বাসে ওঠো । আর একটু ওয়েট করলে কি হতো শুনি ?
-তুমি এই জ্বর নিয়ে এতক্ষণ গোছল করলে কেন ?
-ওয়াশ রুম নোংরা ছিল । পরিষ্কার করে গোছল করলাম । তাই দেরি হয়েছে ।
কি হলো ? তোমাকে না আমি নামতে বললাম ?
-এখন আর নামব না । পৌনে চারটায় ট্রেইন ।
-তো কি হয়েছে ? এখন একটা বাজে । এসে দেখা করে ট্রেইন ধরতে পারবে । আসো না প্লিজ !
-রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ।
এখন তোমার ওখানে গেলে সত্যি সত্যি ট্রেইন মিস হবে । তাছাড়া আমি খুব ক্লান্ত ।
বুঝতে চাইল না রিনি । জেদ করে ফোন রেখে দিল । অনূপ খিলখেতে নেমে পড়ল ।
খুব মন খারাপ হয়েছিল সেদিন । ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও বাস থেকে নামতে পারেনি ।
দুপুর তিনটার দিকে হঠাৎ রিনির ফোন । দ্রুত তৈরি হচ্ছিল অনূপ ।
-হ্যালো...
-শোন, তুমি আমাকে প্লিজ বকা দিও না আর বাসায় ফোন করো না ।
আমি এখন স্টশনের ওয়েটিং রুমে বসে আছি...
-কি বলছ তুমি !
-প্লিজ কথা বাড়িও না । তুমি তাড়াতাড়ি এসো...
ফোনটা রেখেই উদভ্রান্তের মত ঝড়ের বেগে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো সে । মনে মনে ঠিক করল, প্রচন্ড ধমক দিতে হবে রিনিকে । একেকটা মিনিট কে এক একটা বছর মনে হতে লাগল । বিশ মিনিট লাগল পৌঁছাতে ।
হন্তদন্ত হয়ে ওয়েটিং রুমে গিয়ে দেখল ডান দিকের প্রথম সারির প্রথম চেয়ারটাতে রিনি বসে আছে । পাশে গিয়ে বসল অনূপ । কয়েকদিনের জ্বরে এ কি চেহারা হয়েছে ওর ! বিধ্যস্ত , ক্লান্ত , চোখের নিচে কালি...। কপালে হাত দিয়ে দেখল গরম । ইচ্ছে করল বুকের মধ্যে তার ভালোবাসার মানুষটিকে জড়িয়ে ধরতে ।
-তুমি এরকম পগলামি কেন করলে !
-এমনি । তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হল...তাই ।
-তুমিতো আমাকে এখন আর ভালোবাসনা...
-হ্যাঁ । বাসিই না তো ।
-তাহলে এলে কেন ?
-এমনি...
-আমার সাথে চিটাগং চলো ।
যাবে ?
-না । আমার মুখে, শরীরে লাল লাল হামের মত মনে হচ্ছে গোছলের পর থেকে । খুব চুলকাচ্ছে...
-তোমাকে পিটুনি দিতে ইচ্ছে করছে । তুমি কেন এসেছ !
অনূপের কথার জবাব না দিয়ে সে বলতে লাগল
-এখানে পৌঁছে ওয়েটিং রুম পর্যন্ত হেঁটে আসতে মনে হচ্ছিল পড়ে যাব । পা চলতে চাইছিল না ।
এখন ঠিক আছি ।
-তুমি আমাকে এত ভালবাস কেন মানিক !
-হাঃ হাঃ হাঃ কি যে বলো । আমি তোমাকে ভালোবাসি না...
সেদিন নিষ্ঠুরের মত রিনিকে রেখে চলে যেতে হয়েছিল ! ইদানিং রিনির সাথে খুব বেশি কথা বলা হয়ে উঠে না । ইচ্ছে করেই রিনি তাকে এড়িয়ে চলে । প্রতি মাসেই ঢাকায় দেখা করতে ইচ্ছে করে ।
রিনি ব্যস্ততা দেখায় ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দশটা তেতাল্লিশ । ওয়েটিং রুমে আবারো এক নজর চোখ বুলালো । বৃদ্ধ লোকটি পাউরুটি খাচ্ছে । বাচ্চাসহ মহিলাটি আগের মতই বসে আছে ।
ওয়াশ রুমের সামনে যে লাকটি দাঁড়ানো ছিল সে এখন অলস ভংগিতে পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছে । আরো কয়েকজন চুপচাপ বসে আছে । অনূপ উঠে দাঁড়াল । প্রথম চেয়ারটির দিকে শেষবারের মত চোখ বুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে হাঁটতে লাগল । পেছনে পড়ে রইল শেষবার দেখা তার ভালোবাসার স্মৃতি আটকে রইল ওয়েটিং রুমের প্রথম সারির প্রথম চেয়ারটিতে...
অনূপ জানে রিনি তাকে এখনো পাগলের মত ভালোবাসে ।
কিন্তু আর কোনদিন হয়ত ওয়েটিং রুমের প্রথম চেয়ারটিতে রিনি অপেক্ষায় থাকবে না ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।