আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'ক্রুসেড, জেহাদ ও শ্রেণীসংগ্রাম'- সাহসের স্পর্ধা



তিন বছর ধরে বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলায় যেতে পারি না। প্রতিবার একটাই বাধা- পরীক্ষা। তো সেই গ্যাপটা পূরণ করার চেষ্টা করি চট্টগ্রামের প্রাচীন, বাতিঘর আর নন্দন-এ ঘুরে ফিরে। এই দোকানগুলোতে নেড়েচেড়ে বই দেখার সুযোগ আছে। এভাবে একদিন বই ঘাটছি।

হঠাৎ ছোট একটা বইয়ে চোখ আটকে যায়- ‌‌'ক্রুসেড, জেহাদ ও শ্রেণীসংগ্রাম'। ক্রুসেড ও জেহাদের সাথে 'শ্রেণীসংগ্রাম' শব্দটাই আমাকে বইটা কিনতে প্ররোচিত করে। মূলত বইটি 'আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা'র নিয়মিত সভাগুলোর ধারাবাহিক কার্যবিবরণী। তারা ২০০১ সালের ২৩ নভেম্বর 'আফগানিস্তানে পশ্চিমা আগ্রাসন ও আমাদের কর্তব্য' শীর্ষক একটা সভা করে। বইটা ঐ সভার কার্যবিবরণী।

পড়তে গিয়ে চমকে উঠি। ফরহাদ মজহার, রেহনুমা আহমেদ (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের সাবেক প্রফেসর, গতানুগতিক পঠন-পাঠনের বাইরে গিয়ে রচিত 'নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ' তার অসাধরণ রচনা), সলিমুল্লাহ খান -- এমন সব বাঘা বাঘা আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের সাথে আহমেদ আবদুল কাদেরও আমন্ত্রিত ছিলেন ঐ সভায়। আহমেদ আবুদল কাদেদের পরিচয়টা খোলাসা করি, তিনি হলেন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, পরে শিবির থেকে বহিস্কৃত হয়ে এখন ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় নেতা। ফরহাদ মজহার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন সভায়। নিঃসন্দেহে অনেকের মনে প্রশ্নগুলো খোঁচালেও, বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায়, সাহসের অভাবে কেউ প্রশ্নগুলো তোলেন নাই।

যদি মৌলবাদী হয়ে যাই, গায়ে যদি প্রতিক্রিয়াশীলতার ছাপ পড়ে যায়- এতসব 'যদি'র পরোয়া না করে ফরহাদ মজহার যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, এক কথায় তিনি সাহসের সীমানা স্পর্শ করেছেন। তার প্রশ্নগুলো ছিল: সাম্রাজ্যবাদকে ইসলামী মতাদর্শ দিয়ে যারা প্রতিরোধের কথা বলেন, তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তার, আলাপ আলোচনার বা কাজের কি কোনই সুযোগ নেই? তালেবান বা যে কোন ইসলামপন্থী দল সম্পর্কে এতো ঘৃণা, শংকা, ভীতির কারণ কী? বাংলাদেশের একাত্তর সালের ইতিহাস একটা কারণ অবশ্যই এবং তাকে যথারীতি মনে রাখা দরকার। কিন্তু তালেবানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার ষোল আনা না হোক, সাড়ে আট আনা কি পশ্চিমা প্রপাগাণ্ডার ফল নয়? বিশেষত 'আধুনিকতা', 'প্রগতি', কিম্বা সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার কি একটা বড়ো কারণ নয়? যে 'সভ্যতা'কে আমরা সভ্যতা জ্ঞান করি আসলেই কি সেটা 'সভ্য'? তাহলে উন্নত সমাজ সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলো আসলে কি? যুদ্ধ, হত্যা ও বিপুল সমরাস্ত্রের ভার ছাড়া যে সভ্যতা টিকে থাকতে পারে না, মুনাফা উৎপাদনই শুধু নয়, নিত্যদিন সারা দুনিয়ায় অনাহার, মহামারী এবং ন্যূনতম বেঁচে থাকার শর্তসমূহের ক্ষয় ঘটানোই যে সভ্যতার ধর্ম, তাকে আমরা প্রতিদিন মেনে নিচিছ কোন যুক্তিতে? তালেবান কী জিনিস আমরা কি তা সত্যি সত্যিই জানি? নাকি সাম্রাজ্যবাদী প্রচার মাধ্যমগুলোর প্রপাগাণ্ডাকেই সত্য বলে গ্রহণ করেছি? ধর্ম কী জিনিস, ইসলাম কী, কিম্বা অন্যান্য ধর্মের ইতিহাস ও মতাদর্শটাই বা কী? এই সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ থাকাই পছন্দ করি। এটাই আমাদের অধিকাংশের কাছে 'প্রগতিশীলতা'। অন্যান্য আরও অনেক প্রশ্নের মধ্যে এই প্রশ্নগুলো আমাদের আছে।

আমরা নির্ভয়ে প্রশ্নগুলো তুলতে চাই। 'আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা'-য় আশা করি ক্রমে ক্রমে সেই সুযোগ আমরা করে নিতে পারবো। নিপীড়িত শ্রেণী ধর্ম, ভক্তি, হিংসা, অহিংসা, শান্তি কিম্বা নৈরাজ্য-- নানান ভাষায় কথা বলে। বিপ্লবী রাজনীতির কর্তব্য হলো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর এই ভাষাকে ধরতে পারা। নিপীড়িত শ্রেণী বা জাতি মাত্রই কমিউনিস্ট নয়- এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু থাকা উচিত।

ফরহাদ মজহার মজহারের লিখিত বক্তব্যের পর আহমেদ আবদুল কাদের বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যের অংশবিশেষ হুবুহু তুলে দিচ্ছি, আমরা সেদিনও বলেছিলাম সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে আপনারা যেভাবে বলছেন সেভাবে হবে না, হতে পারে না, হয়নি। ........ পশ্চিমা সভ্যতার চরিত্র বুঝতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। পুরোপুরি হয়েছি বলব না, কিছুটা সফল হয়েছি, কিছুটা ব্যর্থ হয়েছি। ....... উপনিবেশবাদের ইতিহাস পড়ুন ভাস্কোদাগামা কে ছিলেন, কলম্বাস কে ছিলেন, ইসাবেলা কে ছিলেন,ফার্দিনান্ড কে ছিলেন তারা সবাই খ্রিস্টের বাণী বা তাদের ধর্মের আধিপত্য বিস্তারের জন্য সারা দুনিয়ায় অভিযান চালিয়েছিলেন।

তার সঙ্গে ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং তাদের সধর্মের অথবা মতাদর্শের আধিপত্য বিস্তার তৎসঙ্গে বস্তুগত শক্তি অর্জন। এর কোন পরিবর্তন হয়নি। ........... অনেক বাম চিন্তাবিদদের লেখা কমজোর দু'পৃষ্ঠা পড়ার পরই একগাদা গালাগাল ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। আর তত্ত্ব যা পাওয়া যায় তা বুঝা যায় না। আপনারা সাধারণ মানুষদের নিয়ে চিন্তা করছেন, ভাবছেন, সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন, সেই কথাটা সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে।

আপনাদের কথা শুনে মনে হয়, আপনারা সাধারণ মানুষের 'চিন্তা-চেতনা' মননের ও তাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিরোধী, ঐতিহ্যের বিরোধী, তাদের আত্মপরিচয় রক্ষার বিরোধী। এভাবে কেবল বক্তৃতা করা যাবে, সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে না, যেতে পারে না। মজহার সাহেব সম্ভবত একজন ব্যতিক্রম। তিনি চেষ্টা করছেন সাধারণ মানুষের ভাষা বুঝার জন্য, তিনি আজকে উপস্থাপন করেছেন আজকের শ্রেণীসংগ্রামের ভাষা জেহাদ ও ক্রসেড। ......... আমি বিশ্বাস করি ডায়ালগ হওয়া প্রয়োজন।

আমাদের সম্পর্কে আপনাদের অনেক ভুল বোঝাবুঝি আছে। আমরা এক কথায় জানি কমিউনিস্ট মানে নাস্তিক। আর আস্তিক কখনো নাস্তিকের পক্ষ নিতে পারে না। এটা সবাই বুঝি। অন্যদিকে আপনাদের ধারণা হচ্ছে যারা ইসলামের কথা বলছে তারা সেকেলে, দানবীয়।

কিছু কিছু পত্রিকাও আমাদের সম্পর্কে লেখে: আমরা যেন দুনিয়া সম্পর্কে বেখবর, আমরা নারীদের তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখে অসূর্যম্পশ্যা বানাতে চাই, শিক্ষা বন্ধ রাখতে চাই। এসব কথা আপনারা শুনে থাকবেন। আমি মনে করি ডায়ালগ যদি ওপেন হয় তবে অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। এবং আমাদের সমস্ত ভুল আপনারা বুঝবেন, আপনাদের ভুল আমরা বুঝবো। এই দুই জনের পর রেহনুমা আহমেদ, সলিমুল্লাহ খান, মেসবাহ কামালসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন।

তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্যে ক্রুসেডের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিস্তারিত এসেছে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিতুমীর ওয়াহাবীদের লড়াই সম্পর্কে প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে ইন্টারেস্টিং আলোচনা করেছেন তিনি। বাংলাদেশে কমিউনিস্টদের এই সাহসী উচ্চারণগুলো নিঃসন্দেহে অনেক ভুল বোঝাবুঝির সমাপ্তিতে ভূমিকা রাখবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.