প্রতিটি রাষ্ট্রের মূল মন্ত্র ধর্ম নিরপেক্ষতা হওয়া উচিত। যেমনটি আমাদের রাষ্ট্রের ”৭২” এর সংবিধানে অন্তভর্’ক্ত ছিল। সেই সময় শ্লোগান ছিল -
”ধর্ম যার যার – কিন্তু রাষ্ট্র সবার”
কেননা দেশ স্বাধীন হয়েছিল পাকিস্থানের তৈরি দ্বিÑজাতি তত্ত্ব ভেঙ্গে ফেলার জন্য।
আর এ কাজে অংশ নিয়েছিল হিন্দু মুসলিম সবাই। দেশকে স্বাধীন করতে সকল ধর্মের লোক সমান ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিল।
সব ধর্মের লোক মিলে দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে। জাতি ভেদ গঠন করতে দেশ স্বাধীন করেনি। তাই আমাদের পবিত্র সংবিধানে মূল মন্ত্রছিল চারটি :
ধর্ম নিরপেক্ষতা,
জাতীয়তাবাদ,
গণতন্ত্র,
সমাজতন্ত্র।
এই চারটি মূল ধারার উপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত ছিল। যেখানে ছিল সবার জন্য সমান অধিকার।
সব ধর্মের মানুষের জন্য রাষ্ট্রের উপর সমান অধিকার। প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ এমনটি ভাবার কোন অবকাশ ছিল না। এই চার ধারা যেন ছিল বাংলার মানুষের বহুদিনের দাবি। বাংলার হাজার বছরের দাবি ছিল এটি । অহিংসা, অসাম্প্রদায়িকতা, সৌহার্দ ভাবাপন্ন মানুষের নিবেদিত প্রাণের দাবি ছিল এই চারটি মূল মন্ত্র।
কিন্তু এই মূল মন্ত্র বেশি দিন টিকতে পারল না। বাঙ্গালি জাতির পিতার মৃত্যুর সাথে সাথে এটিরও মৃত্যু হয়ে গেল। ৭৫ এর পরবর্তি ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সাথে সাথে বাঙ্গালির চেতনার প্রতি আঘাত হানা হয়। ধর্মের নাম করে বাঙ্গালি স্বত্তাকে হত্যা করা হয়। তাদের নিজেদের ধর্ম মানবার কোন বালাই ছিল না, শুধু শুধু অপরকে বুঝাতে এমন ব্যবস্থা।
তারা ধর্ম মানলে ক্ষমতা পাকা পোক্ত করবার খাতিরে হাজার হাজার আর্মি দের হত্যা করত না।
যা হোক, এই চারটি মূল মন্ত্র কেটে সংবিধানে লিখা হলো ”বিসমিল্লাহ” শব্দটি। তারপর লেখা হলÑ১. আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস।
২. জাতীয়তাবাদ
৩. গণতন্ত্র
৪. সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ণ (সমাজতন্ত্র)।
কৌশলে ধর্ম নিরপেক্ষতা শব্দটি কেটে দেওয়া হলো।
আমাদের দেশের মানুষ ধর্মভীরু। তাই ধর্মের নামে তাদের উপর ধর্মের রাজনীতিও চাপিয়ে দেওয়া হলো।
ধর্ম নিরপেক্ষতার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য স্থাপন করা হলো।
আসুন ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে কি বুঝায় তা দেখা যাক। ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে আমরা বুঝি ধর্ম কর্মের স্বাধীনতা।
সকল ধর্মে সমান অধিকার। অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতা অর্থ ধর্মহীনতা বা অধর্মতা বুঝায় না। যে যার ধর্ম পালন করবে কিন্তু কারও ধর্মে কেউ হস্তক্ষেপ করবেনা। রাষ্ট্রের সকলের সমান অধিকার সুনিশ্চিত হবে। এটাই হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতা।
আসুন দেখি ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ইসলাম কি ভাবে দেখে থাকে ঃ
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ব প্রথম যে সংবিধান লেখা হয়েছিল, তা লিখেছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। তিনি যখন মদিনায় রাষ্ট্র গঠন করেন তখন মদিনায় মুসলিম সহ আরও তিন গোত্রের লোক বাস করত, তারা হলো ইহুদি, নাসারা, ও পৌত্তলিক। সবাই কে নিয়ে মদিনা সনদ লেখা হয়।
সনদটি নিম্নে সংক্ষিপ্ত লিখা হলো ঃ
”মদিনার ইহুদি, নাসারা, পৌত্তলিক এবং মুসলিম সকলেই এক দেশ বাসী। সকলেরই নাগরিক অধিকার সমান।
ইহুদি, নাসারা, পৌত্তলিক এবং মুসলমান সকলেই নিজধর্ম পালন করিবে, কেহই কাহারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে না। কেহই হযরত মুহম্মদের বিনা অনুমতিতে কাহারও সহিত যুদ্ধ করিবে না। নিজেদের মধ্যে কোন বিরোধ উপস্থিত হইলে আল্লাহ ও রসূলের মীমাংসার উপর সকলকে নির্ভর করিতে হইবে। ————যদি কোন শত্রু কখনও মদিনা আক্রমন করে, তবে তিন সম্প্রদায় সমবেত ভাবে তাহাকে বাঁধা দিবে। –”
উল্লেখ্য যে উক্ত মদিনা সনদে ”বিসমিল্লাহ-হির-রাহ মানির-রাহিম” বাক্যটি লিখা ছিলনা।
কারণ সনদটি ছিল সকল সম্প্রদায়ের জন্য, তাই সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা ছিল। এবং লক্ষ্যণীয় যে, সকল ধর্মের অধিকার সমান ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আসলে এটাই হচ্ছে ইসলামের বিধান ও রসূলের আদর্শ।
সেই রাষ্ট্রে মুসলিমদের জন্য ছিল ইসলামিক আইন ও বিচার ব্যবস্থা আর অমুসলিমদের উপর যেহেতু শরিয়াহ আইন প্রযোজ্য নয় তাই তাদের ছিল ভিন্ন আইন ব্যবস্থা। তাই নির্দিধায় বলতে পারি এটি ধর্ম নিরপেক্ষ সনদ বা সংবিধান।
আমরা যদি আমাদের দেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের দিকে তাকাই তবে দেখব সেটি আমাদের রসূলের মদিনা সনদ/সংবিধানের সাথে আদর্শ দিক দিয়ে অনেকাংশে একই ধরনের। যেমন ঃÑ মদিনা সনদের মত এখানেও ”বিসমিল-লাহ হির-রাহ মানির-রাহিম” বাক্যটি ছিল না কারণ সবার পঠন গত দিক দিয়ে অধিকার সমান। মানার ক্ষেত্রেও সমান অধিকার। তাই কাউ কেই ছোট করা হয়নি। যে ধর্মের লোক সংবিধান পাঠ করবে তার নিজ ধর্মের বাক্য অন্তরে পাঠ করে পড়বে।
কিন্তু আজ হিন্দু সাংসদ যখন আমাদের সংবিধান পাঠ করে তখন বিসমিল্লাহ কথাটি উল্লেখ করতে হয়। অথচ ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া বা অন্য ধর্ম বিস্বাসীদের প্রতি ইসলাম ধর্মীয় আইন চাপানো সম্পূর্ণ হারাম। কারণ- কোরআনে উল্লেখ্য যে, ”ধর্মের ব্যপারে কোন জবরদস্তি নাই। ”
আবার আমরা কোরআন হাদিস ব্যতিত কোন সাধারণ বই, যা সকল ধর্মের বর্ণের লোক পড়ে থাকে তাতে কখনই বিসমিল্লাহ লেখা থাকতে দেখি না।
মদিনা সনদটির মত আমাদের ৭২এর সংবিধানটি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ।
কারণ মদিনা সনদে উল্লেখ ছিল Ñ ”ইহুদি, নাসারা, পৌত্তলিক এবং মুসলমান সকলেই নিজ ধর্ম পালন করিবে, কেহই কাহারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে না। ”
আমাদের দেশে সে সময় ধর্ম নিরপেক্ষতার সকল গুনাগুন আমাদের আইনে ছিল।
কারণ হিন্দুদের জন্য হিন্দু আইন এবং মুসলিমদের জন্য মুসলিম উত্তরাধিকার আইন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া আরও অনেক আইন ধর্ম ভেদে পাশ করা হয়।
প্রকৃত পক্ষে এটাই হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্য।
যদি বলা যায় ইসলামিক রাষ্ট্রের কথা তবে আদর্শ তাই, যা বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটা শুধু আমার কথা নয়, রসূলের মদিনা সনদের বর্ণনা দিতে গিয়ে ’বিশ্বনবী’ গ্রন্থে কবি ও লেখক গোলাম মোস্তফা তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন ঃ-
”বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা একই রাষ্ট্রে, কিরূপে মিলিয়া মিশিয়া বাস করিতে পারে, ইসলামী রাষ্ট্র হইবে তাহার দৃষ্টান্ত। অন্য কথায় উদার মানবতা ও বিশ্ববোধই ইসলামী রাষ্ট্রের মূল প্রেরণা। যে রাষ্ট্রে শুধু ইসলাম চর্চাই হয়, সে রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্র নহে। ”
এই কথা দ্বারা আমরা বলতে পারি যে, আমাদের দেশে ৭২সালে যখন ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন হয়, তখই আমাদের রাষ্ট্রের আদর্শ ধর্মে মূল আদর্শ অনুসারেই হয়।
তাই কোন ভাবেই সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম লিখে, বিসমিল্লাহ লিখে, ধর্ম নিরপেক্ষতা কেটে পূর্বের সরকারকে ধর্মহীন বানানোর চেষ্টা করা যাবে না। ধর্ম নিরপেক্ষতা ইসলাম বিদ্বেষি কোন মতবাদ নয়। যে যাই বুঝাক আমাদের মনে রাখতে হবে ধর্ম নিজস্ব ব্যাপার, কেই কারও ধর্ম কেড়ে নিতে পারে না। তাই ধর্ম পালন নিজস্ব ব্যাপার। রাস্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমরা মনে প্রাণে সমর্থন করতে পারি, কিন্তু আমরা ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে নিজ নিজ ধর্ম পূর্ণ রূপে পালন করব, এটাই মূল ধারণা হওয়া উচিত।
আমরা মূঘল বাদশাদের রাজ্য শাসন আমলকে নিয়ে গর্ব করি। কারণ ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন যখন চলেছে তখনকার সময়কে মুসলিম স্বর্ণ যুগ বলা যায়। কারণ আর কোন দিন এমন ভাবে একচ্ছত্র ভাবে হিন্দুস্থানে মুসলিম শাসন আসবে কি’না তা বলতে পারা যায় না। না আসাটাই স্বাভাবিক। তাই মুসলিমরা গর্ব করে বিভিন্ন শাসকের উদাহরণ টানে।
অনেক মওলানা ও বক্তাগন তাদের শাসনের উদাহণ টেনে বক্তব্য দেন। হ্যাঁ, তাদের সু-শাসনের উদাহরন দেওয়া স্বাভাবিক। কেননা তারা ভালভাবে শাসন করেছে বলেই তারা দীর্ঘ দিন টিকে থেকেছে। তারা মুসলিমদের জন্য ইসলামিক আইনে বিচার করত, হিন্দুদের জন্য পৃথক আইনে। এমন অনেক উদাহরণ আছে।
এখন লক্ষ্য করুন, তারা কি কখনও তাদের শাসনামলে এই হিন্দুস্থানকে ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষনা করেছে কি’না। তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম লিখেছে কিনা। না, তা লিখার প্রয়োজন নেই তাই লিখেনি। বরং হিন্দু-মুসলিম কিভাবে সমান সুবিধা পাবে সে চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। অর্থাৎ তারা শাসক হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে।
আবার নিজ ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে ছিল কঠিন ধর্ম ভীরূ,বাদশা বাবর, হুমায়ন, শাহজাহান, আলমগীর, জাফর তাদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
তাই আমরা আজও ভারতের সংবিধানে ”সেকুলার” শব্দটি দেখতে পাই। কই, সেখানে কি সকল মুসলিম ধর্মহীন হয়েগেছে? আমরা ভারতের সেকুলারিজম দেখে খুশি হই, তবে বাংলাদেশের দেখতে চাইনা কেন? সেখানে যদি মুসলিমদের অধিকারের জন্য সেকুল্যারিজম প্রয়োজন হয় তবে আমাদের দেশে কেন প্রয়োজন নয়। এ সময়ের বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ড. জাকির নায়েক তার ”ইজ ইসলাম সলুশান ফর হিউমান” শীর্ষক আলোচনায় বলেছেন:-” এই ইন্ডিয়া একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ, সংবিধান তাই বলে। এটি হিন্দু দেশ নয়।
এখানে আমরা অর্থাৎ মুসলিমরা ইসলাম ধর্মের প্রচার প্রসার সবই করতে পারব কেউ বাঁধা দিতে পারবে না। ” এখানে তিনি সেক্যুলারিজম নিয়ে গর্ব করলেন এবং সাপোর্ট করলেন। এটা ধর্ম বিদ্বেষি এমন কথা তিনি বলেন নি।
আমি এখন আব্দুর রাজ্জাকের লেখা ”ধর্ম নিরপেক্ষতা ও মানব সমাজ” বই থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি Ñ
” প্রতিটি জাতিতে নবী পাঠিয়েছেন, এরা সবাই এক ও অসাম্প্রদায়িক। তাই কোরআনে আল্লাহকে বহুবচনে ’আমরা (নাহনু)’ রূপে পাওয়া যায়, যদিও মূলতঃ একেরই প্রকাশ হইয়াই চলিতেছে সর্বত্র।
এই রহস্য জ্ঞানই কোরআন, এই রহস্য জ্ঞানই ধর্ম নিরপেক্ষতার জ্ঞান। ”
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন – ” লোকান্তরের দৃষ্টিতে প্রত্যেকের মাঝেই ’এজিদ’ ও ’হুসাইন’ বিদ্যমান, ’এজিদ’ হইল তান্ডব এবং ’হুসাইন’ হইল ধর্ম নিরপেক্ষ। এজিদ হইল মিথ্যা এবং হুসাইন হইলেন সত্য। ”
আমাদের মনে রাখতে হবে ইসলাম ধর্ম কঠোরতায় নয়, বরং সাম্যে বিস্বাসী।
ইসলাম সৌহার্দে বিস্বাসী।
ইসলাম বর্বরতাকে ঠেলে দিতে এসেছে, গোড়ামীকে গড়তে নয়। আমাদের দেশেও তাই তেমই সাম্য প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। আমাদের দেশ স্বাধীন করতে ত্রিশ লক্ষ্য শহীদ হয়েছে শুধু একটি ধর্ম বর্ণ নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন করতে। দ্বি-জাতিতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্থান ভেঙ্গে নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে। যেখানে ধর্ম বর্ণ ভাষাগত ভেদাভেদ থাকবে না।
যেখানে প্রথম শ্রেণীর, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক থাকবে না। সে অনুসারে দেশ স্বাধীন হলো, এবং রাষ্ট্র গঠনও হলো কিন্তু বেশি দিন টিকল না। ধর্ম নিরপেক্ষতা কেটে দেয়া হলো, রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করা হলো। তাইত সেক্টর কমান্ডার সি, আর, দত্ত (বীর বিক্রম) বলেছেন – ”আমি মুক্তি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম, আর আমি আজ এদেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম লিখে আমাদের (হিন্দুদের) দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রেখেছে।
এরশাদ কি যুদ্ধ করেছে? পৃথিবীর আর কোন দেশে কি রাষ্ট্র ধর্ম বলে কোন কথা আছে? অবিলম্বে এটি কেটে দেয়া দরকার। ”
আসলেই সি, আর, দত্ত সাহেব যে কথাটা বলেছেন তা ঠিক যে বিশ্বে আর কোন দেশে রাষ্ট্র ধর্ম বলে কোন কথা নেই কোন আইন নেই। তবে এই মূহুর্তে নয়, এক সময় ছিল। এরশাদের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করার প্রেক্ষিতে আমার মনে পরে গেল সেই ঘটনাটি। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পূর্বে যখন খ্রীষ্ট ধর্মের প্রভাব চারদিকে পরছিল।
ঠিক সেই সময়ে রোম সম্রাজ্যে বেশ জোড়ে সোড়ে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রসার হচ্ছিল। সেই দেশের লোকজন আদি থেকে প্যাগান ধর্মাবলম্বি ছিল। এবং প্যাগান ধর্মাবলম্বিরা সূর্য উপাসক ছিল। কিন্তু খ্রীষ্ট ধর্মের প্রভাব দেখে রোম রাজা কোন্সটাটিন চিন্তিত হয়ে পরলেন। অবশেষে তার রাজ্য ও রাজত্ত্ব বাঁচাতে রোম সম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম খ্রীষ্টধর্মকে ঘোষণা করলেন।
কিন্তু তিনি কোন দিনই প্যাগান ধর্ম ছেড়ে খ্রীষ্টান হননি। তার মৃত্যুর পর তাকে প্রজারা জলে ব্যাপ্তিজ করিয়ে খ্রীষ্টান বানিয়েছিল। তার মনে প্রাণে কিন্তু খ্রীষ্ট ধর্ম ছিলনা, কিন্তু রাজ্য ও রাজত্ত্ব বাঁচাতে তিনি খ্রীষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম করেছিলেন। আমাদের দেশে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি এমনি কাজ করেছেন বলে আমি বিশ্বাস করি। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করে নিজেকেই কি তিনি ইসলামের কায়দা-কানূনে পরিচালিত করতে পেরেছেন? না কি নিজে পাকা মূসলিম হয়েছেন।
যে সমস্ত রাষ্ট্রের মানুষ ও রাষ্ট্রকে তিনি মুসলিম করবেন। আসলেই এটি রাজনৈতিক ফায়দা গ্রহণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমরা জানি পৃথিবীর বহু মুসলিম দেশে ধর্ম নিরপেক্ষতা মতবাদ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন-১৯২৯ সালে তুর্কি¯া’নে তাদের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা সংযোজন করা হয়। এমনকি পাকিস্থানে পিপল্স পার্টি সেকুলারিজম ভাবধারা নিয়ে রাজনীতি করছে।
তাহলে কি তারা মুসলিম নয়, পিপল্স পার্টি সমর্থক কি মুসলিম নয়?
বঙ্গবন্ধুর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হবার পর সৌদি আরব গিয়েছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য। পবিত্র হজ্ব ও মদিনায় রওজা মোবারক জিয়ারত করে দেখা করলেন সে সময়ের সৌদি বাদসা ফয়সালের সাথে। বাদশাকে জানালেন যে আপনারা এখনও সমর্থন দেননি, আমাদের সমর্থন দিন। বাদশা বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আমরা আপনাদের কি করে সমর্থন দেব ? আপনারা মুসলিম দেশ ভেঙ্গেছেন।
এবং আপনাদের দেশের নাম দেয়া হয়েছে ’পিপল্স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’,এটি কেটে যদি আপনারা লিখেন ’ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ তাহলে আমরা সমর্থন দিতে পারি।
তখন বঙ্গবন্ধু জবাবে বললেন- দেখুন ইউর এক্সসিলেন্সি, স্বয়ং আল্লাহ তা’লা তার পবিত্র কোরআনে সর্ব প্রথম সূরায় বলেছেন ”আলহামদুলিল্লাহ হি রব্বিল আলামিন। ” অর্থাৎ- প্রসংশা আল্লাহর, যিনি সমস্ত বিশ্বের প্রভূ। কই তিনিত বলেন নি ’আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল মূসলিমিন। ” যে, আল্লাহ শুধু মুসলিমদের প্রভূ।
এবং আমাদের শেষ নবী ও রসূলকে কোরআনে বলা হয়েছে-”রহমতুল্লিল আলামিন” অর্থাৎ- সমস্থ বিশ্বের রহমত সরূপ। কই তাকে ত ’রহতুল্লিল মূসলিমিন’ বলা হয়নি। যেখানে স্বয়ং আল্লাহ ও রসূল যদি শুধু মুসলিমদের জন্য না হয়ে সবার জন্য হন, তবে আমি কিভাবে শুধু মুসলিমদের জন্য হতে পারি। আর আমার দেশ স্বাধীন করতে হিন্দু-মুসলিম সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, জীবন দিয়েছে, এখন আমার দেশকে কিভাবে শুধু মুসলিমদের জন্য করতে পারি।
বাদশা ফয়সাল বললেন সরি আমার ভুল হয়েছে, আমি এভাবে কখনও ভাবিনি।
যাহোক আমরা চিন্তা করে দেখি কি করা যায়।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে বঙ্গবন্ধুর এই জবাব থেকেই সেকুলারিজমের প্রকৃত উত্তর পাওয়া যায় যে, কেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে সেকুলারিজম করা প্রয়োজন। অথচ ৭৫ পরবর্তি সরকার উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে সংবিধানে সেকুলারিজম অংশ কেটে দেয় এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ’আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাটি জুড়ে দেওয়া হয়। অথচ কোরআনে এর স্পষ্ট সতর্কতা আছে। যা নিম্নে দেওয়া হলো ঃ
’দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই।
’
-বাকারাহ ঃ ২৫৬
’আল্লাহ তা’লা কাহাকেও নির্দেশ পালনে বাধ্য করেন না, কিন্তু উহাই যাহা তাহার সামর্থে আছে। সে ছওয়াবও উহারই পাইবে যাহা স্বেচ্ছায় করে এবং সে শাস্তিও উহারই ভোগ করিবে যাহা সেচ্ছায় করে। ’
-বাকারাহ ঃ ২৮৫
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা বেশ স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে কাউকেই ধর্মের ব্যাপারে বাধ্য করা যাবে না। বাধ্য করে পালন করালে তাতে তার কোন ফায়দা আসবে না।
ধর্মের ব্যাপারে যদি বাধ্য করা হত তবে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা করতেন।
তাহলে কেউ বে-নামাজি থাকত না, সবাই ইমানদার হত। কিন্তু তিনি কাউকেই বাধ্য করে নয় বরং সেচ্ছায় এবং নিজ বিবেক বুদ্ধি দ্বারা কতদূর তাকে মানবে সেটার জন্য তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। এখন দেখি যারা বাধ্য করে আইন করেছেন তাদের ঈমানের জোড় কত বড়। একটি উদাহরণই যথেষ্ট বলে মনে করি,- যে সংশোধনিতে বিসমিল্লাহ লিখা হল এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা লেখা হল, সেই একই সংশোধনিতে তারা মদ কে দেশের জন্য জায়েজ করে দিল। বঙ্গবন্ধুর সময় মদ উৎপাদন, সেবন, বন্টন করার লাইসেন্স নিষিদ্ধ ছিল।
সেই আইন কে বিলুপ্ত করা হল। এবং মদের লাইসেন্স দেওয়ার আইন পাস করা হল। কি ঈমানের জোড় !
যিনি (জিয়া) ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে হাজার হাজার আর্মি হত্যা করেছেন, কর্ণেল তাহেরকে অন্যায় ভাবে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়েছেন, ৫৬৫জন বিমান বাহিনীর অফিসারকে ফাঁসি দিয়েছেন, শত শত আর্মি ও মুক্তিযোদ্ধাকে ফায়ার স্কোয়াডে নিয়েছেন, রাজাকার ও খুনিদের পুনর্বাসন করেছেন, রাষ্ট্রের অর্থ ধ্বংস করেছেন, বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি করেছেন, এভাবে হাজার হাজার বড় বড় অপরাধের জন্ম দিয়েছেন। যিনি বঙ্গবন্ধুর ন্যায্য বিচারকে ইনডামনিটির দ্বারা থেমে দিয়েছেন। রাজাকারদের বিচার না করে যিনি বিচারের আইন বাতিল করেছেন, আবার পুরুষ্কৃত করেছেন।
তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেশে এনেছেন এবং পার্টি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এত গুলো মানবতা বিরোধি অপরাধ যিনি করেছেন, তার ধর্মের নাম নিয়ে চলা এটা একটা ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই কারণে হুমায়ন আজাদ তার একটি বইতে লিখেছিলেন যে, জিয়া হলেন একজন রাজাকার ভক্ত মুক্তিযোদ্ধা। যারা রাজনীতির ফায়দা লুটতে ইসলামকে তুলে ধরেছেন তারাই স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছেন, যারা মন্ত্রী থাকা কালে বিসমিল্লাহ লিখেছেন তাদের ঈমানের জোড় দেখুন তারা কিছুদিন আগেও মদ সহ আটক হয়ে মদের কেসে ফেঁসে গেছেন, জেলও খেটেছেন। এটাই কি তাদের ঈমানি জোড় ?
এখন আমি মাইকেল এইচ হার্ট এর লেখা ’দ্য হান্ড্রেডস’ বই থেকে মহাম্মদ (সাঃ) এর উপর তার মন্তব্য তুলে ধরছি-
” সে সময় মদীনায় পৌত্তলিক ও ইহুদিরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল।
মহাম্মাদ মনে প্রাণে অনূভব করতে পেরেছিলেন যে, সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায় লোকের বাস সেখানে সকল সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে ইসলমী রাষ্ট্রের ভিত্তি দূর্বল হয়ে পড়বে। তাই তিনি সেখানে সকল সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে একটি সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি আন্তর্জাতিক সনদপত্র ও স্বাক্ষরিত হয়, ইসলামের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র বা সংবিধান। উক্ত সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার, জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করা হয়। ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।