জীবন কবিতার মত। আর কবিতাগুলো দুর্বোধ্য।
ত্রপাদের এপার্টমেন্টের দারোয়ান একটা বিরাট ফাজিল। প্রতিদিন এপার্টমেন্টে ঢোকার সময় ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করবে- কোন বাসায় যাবেন? মাসুক যথাসম্ভব গম্ভীরভাবে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। দারোয়ান মনে হয় আজ কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না।
মাসুক খেয়াল করেছে, সে একজন ইউনিভার্সিটির ছাত্র অথচ কেউ তাকে খুব একটা পাত্তা-টাত্তা দেয়না। এর প্রধান কারন হল, সে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করছে অথচ চেহারা থেকে শিশু-শিশুভাবটা যাচ্ছে না। মাসুক একটা খসড়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এরপর সেভ করার সময় অবশ্যই গোঁফে হাত দেয়া যাবে না।
ত্রপার প্রধান সমস্যা হল, সে অংক একদমই বোঝে না। তবে মেয়েটা খুবই সিনসিয়ার।
মাসুক কোন অংক করে দিলে সাথে সাথে উত্তরসহ মুখস্থ করে ফেলে। পড়াশুনা ছাড়াও যে জগতে অনেক কিছু করার আছে-এরকম কোন ধারনাই তার নেই।
ত্রপার বাবা একজন অনুভূতিহীন মানুষ। মাসুক কলিংবেল চাপতেই তিনি এসে দড়জা খুলে দিলেন। এই পরিবারটি একটি মাতৃতান্ত্রিক পরিবার।
ত্রপার আম্মার কড়া শাসনে ভদ্রলোক বোধহয় সব অনুভূতি-টনুভূতি হারিয়ে ফেলেছেন। বেশিরভাগ সময় তাকে ভাবলেশহীন চোখে চেয়ে থাকতে দেখা যায়। তার উপর ইদানিং তিনি শেয়ার বাজারের ধকলের মধ্যে আছেন। মার্কেট খুবই ডাউন যাচ্ছে। সালাম দিবে দিবে করেও ত্রপার বাবাকে সালাম দেয়া হলো না।
মাসুক মনে মনে বলল, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। সে ড্রইং রুমে গিয়ে বসল।
মাসুক ড্রইং রুমে বসে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল ঝড়-বৃষ্টির কোন লক্ষন নেই। যত গর্জে, তত বর্ষে না। জানালার ফাঁক দিয়ে হাওয়া আসছে।
মৃদুমন্দ হাওয়া। এই হাওয়ায় কাউকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারলে খুব ভাল হত। মৃদুমন্দ হাওয়ায় ঘোরাঘুরি করার মত মাসুকের কেউ নেই।
কিছুক্ষনের মধ্যে ড্র্ইং রুমে নাস্তা চলে আসল। নাস্তা দেয়ার কিছুক্ষন পরে আসল ত্রপার আম্মা।
হাতে হলুদ খাম। পৃথিবীতে হলুদ রঙের শুধুমাত্র দুইটা জিনিস মাসুকের পছন্দ। একটা হচ্ছে শীতকালে ক্ষেত ভরা শরিষা ফুল। আরেকটা হচ্ছে টিউশনিতে পাওয়া বেতনের হলুদ খাম। মাসুক উঠে দাঁড়িয়ে ত্রপার আম্মাকে সালাম দিল।
আসসালামু আলাইকুম।
‘ অলাইকুমুস্সালাম। মাসুক ভালো আছো?’
‘জ্বী আন্টি, আপনি ভাল আছেন?’
‘ ভাল আছি। তুমিতো নাস্তা কিছুই খাওনি, পুরোটা খাবা। প্রায়ই তুমি নাস্তা না খেয়ে চলে যাও।
কেন নাস্তা ভাল হয় না?’
‘ না আন্টি, সেরকম কিছু না। অনেক সময়ই হলের ক্যান্টিনে নাস্তা করে ফেলিতো, এইজন্য। ’
‘ যেদিন আন্টির বাসায় আসবা সেদিন ক্যান্টিনে নাস্তা করবা না। মনে থাকবে?’
‘ জ্বী, ঠিক আছে। ’
‘ ত্রপার অবস্থা কি? ওতো অংক খুবই ভয় পায় কি করা যায় বলতো?’
মাসুক এর কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না।
সঠিক উত্তর হচ্ছে, কিছইু করা যায় না। মাসুক কিছু না বলে একটু নড়েচড়ে বসল।
‘ বাবা ওকে একটু ভাল করে অংকটা বুঝায়ে দিবা। তোমরাতো বুয়েটের ছাত্র। অংকের জাহাজ।
’
ত্রপার আম্মা হলুদ খামটা মাসুকের দিকে এগিয়ে দিল। মাসুক খুবই লজ্জ্বিতভাবে খামটা হাতে নিয়ে দ্রুত পকেটে চালান করে দিয়ে এমন একটা ভাব করল যেন এখানে কিছুক্ষন আগে টাকা লেনদেনের কোন বিষয় ঘটে নাই। কালি মন্দিরের কাছাকাছি ত্রপা নামে একটা সুন্দর মেয়ে আছে। মেয়েটা অংকে খুব দুর্বল। সময় পেলেই মাসুক এমনি এমনি এসে তাকে অংক করিয়ে যায়।
ত্রপার আম্মাকে মাসুকের খুব একটা খারাপ লাগে না। কিন্তু ভদ্রমহিলা কিছুক্ষনের মধ্যে এমন একটা বাজে কথা বলবেন, শুনলে মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। কথাটা এখনই বলার সমূহ সম্ভাবনা। মাসুক কথাটা শোনার জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল।
‘বাবা শোন, তুমি থাকাতে ত্রপাকে আমার চিন্তাভাবনা অনেকখানি কমে গেছে।
ওকে নিজের বোন মনে করে পড়াবা। যা ভাল বুঝবা তাই করবা। এটা ভাই হিসেবে তোমাকে দায়িত্ব দিলাম। নাস্তা শেষ কর। আমি ত্রপাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
’
মাসুকের পায়ের তলা থেকে চুলের আগা পর্যন্ত রাগে পুরা শরীর জ্বলে গেল।
ত্রপার আম্মা চলে যাবার কিছুক্ষনের মধ্যে ত্রপা চলে আসল।
‘ আসসালামু আলাইকুম, টিচার। ’
জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়া আসছে। এই হাওয়ায় কাউকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারলে ভালো হতো।
সেটা ত্রপা হলেও কোন সমস্যা নেই। পরক্ষনে মাসুক নিজেকে ছি ছি করল। সে এসব কি ভাবছে। এসব আন্দাজ করেই বোধ হয় ত্রপার আম্মা ত্রপাকে বোন হিসেবে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। না না ভূল।
ত্রপাকে বোন হিসেবে দেখার পরামর্শ দেয়ার পর থেকে মাসুকের মাথায় এসব চিন্তা ঢুকেছে।
সমস্যা হচ্ছে ত্রপার বিষয়টা মাথায় আসলে মাসুক দুইভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ ত্রপাকে নিয়ে রোমান্টিক চিন্তাভাবনা করে। আরেকভাগ ত্রপাকে বোন হিসেবে দেখার চেষ্টা করে। অবশ্য বোন হিসেবে চিন্তাভাবনা করাটাই মাসুকের কাছে লাভজনক বলে মনে হচ্ছে।
মেয়েটা অতিরিক্ত রিজার্ভ। মাসুক সবসময় স্টুডেন্টদের কাছ থেকে ভাইয়া সম্বোধন শুনে অভ্যস্ত। ত্রপা ভাই-ব্রাদারের মধ্যে যায় নি। এ মেয়েটা সম্বোধন করে, টিচার। তাছাড়া ত্রপা কোন ফালতু গল্প গুজবের মধ্যে নাই।
তার একমাত্র আলোচ্য বিষয় ম্যাথমেটিক্স।
শ্যামলীতে মাসুকের এক ছাত্রী ছিল। ওই মেয়েটা মূলত তার সাথে গল্পগুজবই করতো, ফাঁকেফোঁকরে একটু আধটু পড়াশুনা। দুনিয়াÍ যত আলত-ুফালতু প্রশ্ন করত মেয়েটা। যেমন, ভাইয়া আপনি কি কখনো সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছেন?
‘হ্যাঁ, দেখবো না কেন? দেখেছি।
’
‘লাস্ট কি ছবি দেখেছেন?’
মাসুকের মনে পড়ল লাস্ট সে দেখেছে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘মনের মাঝে তুমি’। এই সিনেমার নাম বলাটা ঠিক হবে না। মাসুক বলল, মনে করতে পারছি না।
‘একটু মনে করার চেষ্টা করেন না ভাইয়া। ’
‘চেষ্টা করে লাভ নেই।
মনে আসবে না। শুধু গল্প করলে হবে আসো অংক শুরু করি। ’
‘ প্রতিদিনতো অংক করিই, আজকে একটু গল্প করি। ’
ত্রপার মুখ থমথমে হয়ে আছে। আজকে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হবার কথা।
অধ্যায়ের নাম জটিল সংখ্যা। এমনিতেই অংক তার কাছে কঠিন লাগে। তার উপর অধ্যায়ের নাম যদি হয় জটিল সংখ্যা তাহলে মন খারাপ হবারই কথা। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে মাসুক জটিল সংখ্যা শুরু করল।
‘দেখো চ্যাপ্টারের নাম দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
আমি আগেই বলেছি, দুনিয়াতে সংখ্যা দুই প্রকার। একটা বাস্তব সংখ্যা, আরেকটা জটিল সংখ্যা। এতদিন যে সংখ্যাগুলো দেখেছো সেগুলো হচ্ছে বাস্তব সংখ্যা। আজকে দেখবা জটিল সংখ্যা। ’
এতটুকু বলতেই বিদ্যুৎ চলে গেল।
ত্রপাদের এপার্টমেন্টে জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে। কিছুক্ষনের মধ্যে চালু হয়ে যাবে। মাসুক এবং ত্রপা চুপচাপ বসে আছে। জানালার ফাঁক দিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়া আসছে। মাসুকের মনে হল, এরকম হাওয়ায় কারো সাথে গল্পগুজব করতেও ভাল লাগার কথা।
অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পরেও জেনারেটর চালু করা সম্ভব হয়নি। জেনারেটর সমস্যা করছে। ইদানিং লোডশেডিংও হচ্ছে খুব। ডিপিডিসি প্রতিবার দুঘন্টা করে লোডশেডিং দিচ্ছে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকার কোন মানে হয়না।
মাসুক বলল, ত্রপা আমি বরং আজকে যাই, কালকে আসব।
রাস্তায় নেমে মাসুকের মনে হল এতগুলো টাকা নিয়ে রিকশায় করে হলে ফেরা ঠিক হবে না। হাইকোর্টের সামনে প্রায়ই ছিনতাই হয়। কিন্তু এই আবহাওয়ায় রিকশায় ঘোরার মজাই আলাদা।
‘এই খালি যাবা?’
‘কই যাবেন মামা?’
‘বুয়েট হল।
’
‘চিনিনা মামা । ’
চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেয়া দরকার। বুয়েট চেনে না। মাসুক শান্ত গলায় বলল, ‘ ওই যে পলাশী আছে না?’
‘ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়?’
আরে এ লোকতো বাংলার অধ্যাপক। ‘ জ্বী জনাব, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
তুমি যাবে নাকি ভাই, যাবে মোর সাথে? ’
‘ ওঠেন মামা, পঁচিশ টাকা দিয়েন। ’
মাসুক নির্বিবাদে উঠে পড়ল। ভাড়া এখন কোন সমস্যা না। সমস্যা হল ভাংতি। সেটা পরে দেখা যাবে।
চমৎকার বাতাসে রিকশায় একা একা যেতে মাসুকের খুব আফসোস হচ্ছে। সাথে কেউ থাকলে কতই না ভাল হত। ভাবতে ভাবতে চট করে মাথায় একটা কবিতার লাইন চলে এলো।
‘ রাত্রীকালে হঠাৎ কারেন্ট যাওয়ায়
খোলাদোরের ঝিরঝিরে এই হাওয়ায়...’
ত্রপাদের বাসায় কারেন্ট যাওয়ার সাথে বাতাস মিকচার হয়ে কবিতার মত হয়ে যাচ্ছে। কবিতায় বাস্তব অবাস্তব ককটেল হয়ে যায়।
যেমন, ত্রপাদের জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকেছিল। কবিতায় জানালা, দড়জা হয়ে গেছে। অবশ্য এটা কোন মহাসমস্যা না।
‘রাত্রীকালে হঠাৎ কারেন্ট যাওয়ায়
খোলাদোরের ঝিরঝিরে এই হাওয়ায়
জানি, ম্যাথমেটিক্সের সূত্রগুলি ভাবছো
শুধু ভাবছো । ’
হাইকোর্টের কাছাকাছি আসতেই মাসুকের মাথা থেকে কবিতা নিস্ক্রান্ত হয়ে গেল।
রিকাশায় আসার ডিসিশানটা একদম ঠিক হয়নি। যে কোন সময়, যে কেউ রিকশায় ঠ্যাক-ট্যাক দিতে পারে। সে রকম কোন লক্ষন দেখা দিলে সাথে সাথে রিকশা থেকে নেমে ঝাড়া দৌড় দিতে হবে। বেশ এলার্ট থাকা দরকার।
মাসুক পরক্ষনেই আবার কবিতায় দ্রবীভূত হয়ে গেল।
‘ নিরিবিলি কাছাকাছি পাওয়ায়
অবচেতন মন বলছে আমায়-
উদাস ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে ডাকছো
শুধু ডাকছো। ’
ছি ছি। মাসুক নিজেকে ধিক্কার দিল। সে এসব কি ভাবছে। যেকোন সময় ছিনতাই-টিনতাই হয়ে যেতে পারে।
চারদিক ভালভাবে খেয়াল রাখা দরকার। ঢাকা শহরে ছিনতাই দিনদিন বেড়েই চলেছে। তার উপর ইদানিং মলম পার্টিরও বেশ নামডাক শোনা যাচ্ছে।
মৃদুমন্দ হাওয়ায় রিকশায় যেতে যেতে মাসুক আবার দুই ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগ বলছে, ছি ছি ছি।
আরেক ভাগ কবিতা আওড়াচ্ছে। একটি নবজাতক কবিতা।
‘রাত্রীকালে হঠাৎ কারেন্ট যাওয়ায়
খোলাদোরের ঝিরঝিরে এই হাওয়ায়
জানি, ম্যাথমেটিক্সের সূত্রগুলি ভাবছো
শুধু ভাবছো ।
হতে পারে
নিরিবিলি কাছাকাছি পাওয়ায়
অবচেতন মন বলছে আমায়-
উদাস ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে ডাকছো
শুধু ডাকছো। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।