আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার টিউশনির অভিজ্ঞতা........../ইমন

জ্বলে উঠার অপেক্ষায় নিভু নিভু প্রদীপ।

আমাকে পড়াতে ক্লাস ওয়ান থেকে বাসায় এক (ফররুখ মাষ্টার নামে পরিচিত ছিলেন) স্যার আসতেন। আমার পড়ালেখার প্রথম হাতেখড়ি উনার কাছেই হয়েছিল। বয়সে উনি আমার বাবার চেয়েও সিনিয়র ছিলেন। তিনি তখন বেশ কিছু টিউশনি করতেন।

স্বল্পশিক্ষিত ছিলেন বিধায় আয়ের অন্য কোন উৎস ছিল না। তাই সকাল থেকে নাকি রাত পর্যন্ত টিউশনি করতেন। যতটুকু মনে আছে তিনি আমাকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়িয়েছিলেন। উনি পড়ানোর চেয়ে গল্প করতেন খুব বেশি। এই গল্প করার বিষয়টি আমার মার কাছে ভালো না লাগলেও আমার কাছে খুব ভালো লাগত।

তিনি আমাকে গল্পে গল্পে পড়া শিখিয়েছিলেন। তখন ক্লাস থ্রি, ফোরের পড়াগুলো অনেক কঠিন লাগত। উনি আগেরদিন পড়া দিয়ে পরের দিন লিখতে বলতেন। পড়া না পেরে কতবার যে মা'র দেয়া চিকন বেতের বাড়ি খেতে হয়েছিল তার কোন হিসেব নেই। মা মানুষ গড়ার কারিগরকে বলে দিয়েছিলেন ছেলের গায়ের চামড়ার সাথে শুধু হাড্ডি থাকলেই চলবে।

তারপরও যাতে মানুষের মত মানুষ হয়। মার খেয়ে মাকে দেখালে মা বলত 'শিক্ষকদের বেত্রাঘাত খেলে বেহেস্তে যাওয়া যায়'। তো এরপর ব্যথা পেলেও বেহেস্ত যাবার লোভে কিছু বলতাম না। তবে, একটা সময়ে গিয়ে আমি স্যারের সাথে প্রতারণা করতে শুরু করলাম। স্যার আসার আগে আমি খাতায় কালি ছাড়া বলপেন দিয়ে বই থেকে দেখে দেখে লিখে ফেলতাম।

তারপর স্যার যখন লিখতে দিতেন ঠিক সেখানে কলমের কালি চালিয়ে দিতাম। পরে স্যার এটা দেখে খাতার পৃষ্টার উপরে সিগনেচার করে দিতেন। সেটা পরে মাকে দেখাতাম। মাও খুব খুশি হয়ে যেতেন যে যাক, ছেলেটা মানুষ হয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে আমার এই অভিনব প্রতারণা কেউ কোনদিন ধরতে পারে নি।

তখন আবার আমার সাথে আমার এক চাচাতো ভাই পড়ত। আমি কি গাধা, সে ছিল আমার চেয়েও বড় গাধা। নিজের পিঠ বাঁচাতে আমার কাছ থেকে দেখে প্রতারণার পদ্ধতিটা তাকেও রপ্ত করতে হয়েছিল। ক্লাস ফোরে আমাকে পড়াতে নতুন টিচার আসলেন। কিন্তু উনাকে আমার একদমই পছন্দ হতো না।

প্রথমত; তিনি চট্টগ্রামের বাইরের হওয়ায় শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন। দ্বিতীয়ত; তিনি কোন গল্প করতেন না। যাইহোক, তিনি নিজে থেকে চলে যাওয়াতে বেশিদিন উনার কাছে পড়ার দূর্ভাগ্য আমার হয়নি। এরপর শুরু হয় বাবুল স্যারের অধ্যায়। বাবুল স্যারের কাছে ফাইভ থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়েছিলাম।

তবে, ক্লাস সিক্স থেকে সেভেন পর্যন্ত বাবার অতিমাত্রায় আগ্রহের কারণে শুধুমাত্র ইংরেজী পড়তে পাশাপাশি এক ডাক্তারের বাসায় যেতে হতো। উনার কাছে tense, sentence এসব মনে রাখতে না পারার জন্যে প্রচুর মার খেতে হতো। তিনি তো আমাকে মহাগাধা উপাধি দিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আমার সাথে বাবার এক বন্ধুর মেয়েও পড়তে যেত। সে ছিল আমার ক্লাসমেট কিন্তু কখনো কথা বলার সাহস করিনি।

তো সবকিছু সহ্য হলেও এই মেয়ের সামনে আমাকে স্যারের অপমান করা পছন্দ হতো না। গাধা হতে পারি তাই বলে কি মান সম্মান বলে কিছু নেই নাকি? যাইহোক, বিধাতার কৃপায় উনার কাছে বেশিদিন পড়তে হয় নি। বাবুল স্যার কেন জানি আমাকে খুব মেধাবী মনে করতেন। উনার শিখিয়ে দেয়া টেকনিক রপ্ত করে আমি অনেক ভালো ফলাফলও করতে শুরু করি। যে ছেলে অংকে বিশের ঘর পার হতে পারেনি সে তখন ষাটের ঘরে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

তিনি বন্ধুর মতো ছিলেন। আমার মাকে নুরুল আলম স্যার বলেছিলেন 'বোমা মেরেও নাকি আমার মুখে কথা বের হতো না'। অথচ সেই আমি বাবুল স্যারের সাথে অনেক বেশি কথা বলতাম। শুধু কি বেশি কথা স্যারের বিয়ে নিয়ে যে কত ফাইজলামি করতাম। এসএসসির আগে মনে হয় ইংরেজি ছবি 'টাইটানিক' বের হয়েছিল।

স্কুলের সব ছেলেরা এই ছবি দেখে ফেলেছে। আমাদের হেড টিচার একদিন ক্লাসে এসে এই ছবি দেখতে উপদেশ বাণীও দিয়েছিলেন। ছবিতে যে সুরসুরি মার্কা একটা দৃশ্য ছিল বন্ধুদের সৌজন্যে সেটাও মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। কিন্তু কোনভাবে ছবিটি দেখার সুযোগ হচ্ছিল না। কারণ হলে গিয়ে দেখার সাহস তখনো হয়নি।

বাসায় কোন ভিসিআর ও ছিল না যে ভিডিও ক্যসেট এনে দেখবো। তারপর আমি সহ আরো কয়েকজন মিলে বাবুল স্যারকে 'টাইটানিক' দেখার কথা বলে ফেললাম। তিনি বেশ কিছুদিন পরে আমাদের উনার বাসায় যেতে বলেছিলেন। তো স্যারের বদৌলতে 'টাইটানিক' দেখা হয়েছিল বটে, 'টাইটানিক' নামের একটা জাহাজ ডুবে গেছে এ ছাড়া তেমন কিছু বুঝতে পারি নি। কারণ তখন ইংরেজি খুব একটা বুঝতাম না।

যাইহোক, যে কারণে এই লেখাটি লিখতে বসেছি সেটাই এতক্ষণ বলা হয় নি। এসএসসি ফাইনালের আগে আমার কেন জানি টিউশনি করতে মন চাইত। তো এ টিউশনির বিষয়টি আমি স্যারকে বলেছিলাম। তিনি আমার মাথায় হঠাৎ টিউশনি করার ভুত চাপল কেন সেটা জানতে চাইলে বলি 'স্যার অনেক মার তো খেয়েছি একটু মার দিয়ে দেখতাম কেমন লাগে'। তিনি আমার অভিপ্রায় শুনে অনেক হাসলেন।

তো যেভাবে শুরু হয়েছিল সেটা বলি। এসএসসি'তে আমি ভালো রেজাল্ট করে রাতারাতি তারকা হয়ে গেলাম। সবাইকে দেখিয়ে দিলাম গাধা'রা ও পারে। তখনকার অনুভূতির কথা চিন্তা করতে এখনো ভালো লাগে। জীবনের প্রথম সার্টিফিকেট পরীক্ষা বলে কথা।

আসলে এর আগে আমি কখনো এতো ভালো রেজাল্ট করি নি। স্কুলের টেষ্ট পরীক্ষার আগে থেকে হঠাৎ আমি পড়ালেখা নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে গেলাম। রাত জেগে প্রচুর পড়ালেখা করতাম। আমার এহেন সিরিয়াস পড়ালেখা করতে দেখে কিছুদিনের জন্য হলেও মা বাবার বুক গর্বে ফুলে গিয়েছিল। যাক, সে কথা এখন বাদ।

তখন বাবুল স্যার একটা কোচিং সেন্টার দিলেন। যারা ক্লাস নিতেন তাদের বেশির ভাগই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ছিলেন। তো তিনি কোচিং সেন্টারের প্রচারে লিফলেট ছাপালেন। লিফলেটে যারা ক্লাস নিবেন তাদের সাথে নিজের নামটি দেখে খুব প্রীত হয়েছিলাম। এতো বেশি হয়েছিলাম যে, দু একটা লিফলেট চুপিসারে নিজের ড্রয়ারে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম।

তারপর শুরু হল ক্লাস নেওয়ার অধ্যায়। কিছুটা উত্তেজিত এবং নার্ভাস হওয়ার কারণে প্রথম যেদিন ক্লাস নিচ্ছিলাম রীতিমত ঘামছিলাম। যতটুকু মনে আছে সিক্সের বীজগণিত দিয়ে শুরু করেছিলাম। প্লাসে মাইনাসে মাইনাস, মাইনাসে মাইনাসে প্লাস এসব নিয়ে অনেক গন্ডগোল বাধিয়েছিলাম সেদিন। এরপর সেভেন থেকে টেন পর্যন্ত ক্লাস নেওয়া শুরু করলাম।

আস্তে আস্তে সবকিছু সহজ হয়ে গিয়েছিলো তবে মাঝে মাঝে অংকের সমাধান বই ঘাটতে হয়েছিল। কোচিং সেন্টারের এক ছাত্রী তার বাসায় আমার কাছে প্রাইভেট পড়ার কথা জানিয়েছিল। ওর বড় বোন ছিল আমার ক্লাসমেট। তাই মাঝে মাঝে ওদের বাসায় যাওয়া হত। আমি কাউকে পড়াতে বাসায় যাবো সেটা কখনো ভাবিনি।

আসলে আমি চাইলেও আমার বাবা আমাকে টিউশনি করতে দিতেন না। তো এই মেয়ের মা বাবা এবং ক্লাশমেটের অতিরিক্ত মাত্রায় অনুরোধের কারণে তাকে পড়ানো শুরু করি। সে তখন ক্লাস সেভেন এ। আমি যতটুকু পড়াতাম তার চেয়ে দ্বিগুণ গল্প করতাম। মেয়ে ভালো হওয়ায় তেমন কোন সমস্যা হতো না।

তবে আমার সাথে একবার মেজাজ দেখানোর কারণে সপ্তাহখানেক পড়াতে ওদের বাসায় যায়নি। এটার কারণে তার মা তাকে বকেছিলও খুব। পরে শুনেছি সে নাকি অনেক কান্নাকাটিও করেছিল। যাইহোক, এরপর আমাকে একদিন ওর মা এসে মেয়ের জন্য স্যরি হওয়ায় লজ্জায় পড়ে আবার পড়াতে যেতে হলো। লন্ডনে আসার আগপর্যন্ত ওকে পড়িয়েছিলাম।

তারপর কোন একদিন আমি 'বাই' বলে চলে আসি। দেশে গিয়ে ওদের বাসায় গিয়ে শুনি আমি চলে আসার পরে সে নাকি অনেক ভেঙ্গে পড়েছিল। এই ছিল আমার একমাত্র টিউশনির অভিজ্ঞতা। এই টিউশনির কথা কখনো বাসায় বলিনি। পরে আমার মা কিভাবে যেন জেনেছিল।

মা তো একদিন আমাকে বলে কোন মেয়ে পড়ানোর দরকার নেই। আমার মার এই একটাই সমস্যা। তার সুদর্শন অবোধ ছেলেকে কোন মেয়ে যদি ফুসলিয়ে পটিয়ে ফেলে এই ভয়ে মা কোন মেয়ের সাথে কথা বলতেও দিতো না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।