নাঙ্গলকোট এখন এক উপজেলার নাম। জাতীয় সংসদের এক নির্বাচনী এলাকার নাম। ১৯৭৯ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চৌদ্দগ্রাম ও লাকসামের অনুন্নত-অবহেলিত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে নাঙ্গলকোট থানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে এটি উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা হিসেবেও পাঁচটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
২০০১ সালে বিএনপি মনোনীত চারদলীয় জোটপ্রার্থী হিসেবে আমি অনুন্নত এ এলাকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই। নির্বাচিত হওয়ার পর নাঙ্গলকোটের উন্নয়নকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করি। নাঙ্গলকোট সদরকে পৌরসভা করা হয় সংসদ সদস্য হিসেবে আমার দায়িত্ব পালনকালে। এক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় পৌরসভা ভবন। প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে অডিটরিয়াম কাম কমিউনিটি সেন্টার স্থাপন করা হয়। রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট তৈরির পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মক্তব-মসজিদের উন্নয়নে ওই সময়ে যথাযথ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করি। ২০ শয্যাবিশিষ্ট হেলথ কমপ্লেঙ্ প্রতিষ্ঠিত হয় নাঙ্গলকোটে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ২০০৭ সালে আমি প্রায় এক বছর বিনা অপরাধে কারাবাস করি। কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর দেখি নাঙ্গলকোটের নির্বাচনী এলাকা তার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। নাঙ্গলকোটের সঙ্গে সদর দক্ষিণ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন যুক্ত করে কুমিল্লা-১০ নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নাঙ্গলকোট নির্বাচনী এলাকা সৃষ্টি হয় চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ছয়টি এবং লাকসাম উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের সমন্বয়ে। সদর দক্ষিণ উপজেলা সৃষ্টি হয় লাকসাম ও কুমিল্লা সদরের কিছু ইউনিয়ন নিয়ে। বাস্তবতা হলো, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সঙ্গে নাঙ্গলকোটের কোনো যোগাযোগ নেই। সামাজিক যোগাযোগ, অর্থনৈতিক লেনদেন, বাজার ব্যবস্থা কিছুই নেই। নাঙ্গলকোট কোনো মহাসড়ক বা আঞ্চলিক মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত নয়। নাঙ্গলকোটের মানুষের যোগাযোগের একমাত্র উপায় হলো কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক। যা লাকসামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। নাঙ্গলকোট থেকে কুমিল্লা জেলা শহরে আসতে হলে প্রথমে লাকসাম আসতে হয়, তারপর লাকসাম থেকে বাস অথবা অন্য যানবাহনে কুমিল্লা শহরে আসতে হয়।
নাঙ্গলকোট উপজেলা ভৌগোলিক কারণে অনুন্নত। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দৃশ্যমান উন্নয়ন কাজ হয়েছে। দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন ২০০৯ থেকে চলতি ২০১৩ পর্যন্ত হয়নি। নাঙ্গলকোটের সঙ্গে জেলার যোগাযোগের কোনো সরাসরি রাস্তা নেই। ২০০৬ সালে লাকসাম-নাঙ্গলকোট সড়কটি ৩০ ফুট চওড়া করার একটি প্রকল্প নিয়েছিলাম এবং নাঙ্গলকোটে একটি বাসস্টেশন স্থাপন করার প্রকল্প একনেকে পাস হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর প্রকল্প দুটি আর আলোর মুখ দেখেনি। আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম নাথের পেটুয়া-মানকমুড়া বটতলী বঙ্গঞ্জ সড়ক ২৫ ফুট চওড়া করার, সেটার বাস্তবায়ন এ সরকারের সময় করা হয়নি। যেহেতু সংসদ সদস্য লোটাস কামাল সাহেবের বাড়ি লালমাই, তিনি নাঙ্গলকোটের মানুষের জন্য কোনো রাস্তার গুরুত্ব হয়তো অনুধাবন করেন না। আমরা নাঙ্গলকোটবাসী লক্ষ্য করছি, সদর দক্ষিণ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন নাঙ্গলকোট নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে যুক্ত করার পর প্রশাসনিক ও উন্নয়ন বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে এ এলাকার মানুষ। লালমাই থেকে সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের দূরত্ব প্রায় ৭০ কি.মি. যা ফেনী জেলা এবং সেনবাগ উপজেলা তথা নোয়াখালীর সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে আমি নির্বাচন কমিশনে নাঙ্গলকোট উপজেলাকে ২০০১ সালের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে একটি স্বতন্ত্র নির্বাচনী এলাকা হিসেবে সীমানা নির্ধারণের জন্য আবেদন করি। নির্বাচন কমিশন সঠিক অবস্থা বিবেচনা করে নাঙ্গলকোট উপজেলাকে ২০০১ সালের অবস্থায় নিয়ে এবং সদর দক্ষিণ উপজেলার সঙ্গে বরুড়া উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নকে সংযুক্ত করে সীমানা নির্ধারণ করে খসড়া গেজেট প্রকাশ করে।
খসড়া গেজেট প্রকাশের পর আপত্তি গ্রহণ ও শুনানির ব্যবস্থা করা হয়। শুনানির দিন আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। আপত্তিকারীদের মধ্যে কেউই নাঙ্গলকোট উপজেলার সঙ্গে সদর দক্ষিণ উপজেলাকে যুক্ত করার জন্য আবেদনও করেননি বা তাদের বক্তব্য দেওয়ার সময় নাঙ্গলকোট উপজেলাকে নিয়ে কেন স্বতন্ত্র নির্বাচনী এলাকা করা হলো কোনো আপত্তি তোলেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অশুভ হাতের ইশারায় দুটি স্বতন্ত্র নির্বাচনী এলাকাকে একটি নির্বাচনী এলাকা করে চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। বর্তমানে এ নির্বাচনী এলাকার (কুমিল্লা-১০) আয়তন প্রায় ৪৫০ বর্গকিলোমিটার, লম্বায় প্রায় ১০০ কি.মি.। গাজীপুর সিটি করপোরেশন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সিটি করপোরেশন। আয়তন ৩২৫ বর্গ কি.মি.। মেহেরপুর জেলা ও জয়পুরহাট জেলা থেকেও বড় সীমানা নিয়ে কুমিল্লা-১০ আসনের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। কুমিল্লা থেকে নাঙ্গলকোট যাওয়ার জন্য প্রথমে সদর দক্ষিণ উপজেলা, তারপর লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা পার হয়ে যেতে হয়। জেলার ম্যাপ অবলোকন করলেই বিষয়টি সহজে অনুধাবন করা যাবে। অথচ বরুড়ার সঙ্গে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে। কুমিল্লা শহরের সঙ্গে সদর দক্ষিণ উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সদর দক্ষিণ উপজেলার ওপর দিয়ে গেছে এবং কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক সদর দক্ষিণ উপজেলার ওপর দিয়ে গেছে। নাঙ্গলকোট উপজেলার সঙ্গে সদর দক্ষিণ উপজেলার বেলঘর ইউনিয়নের সামান্য একটি অংশের সীমানা সংযুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া নাঙ্গলকোটের সঙ্গে সদর দক্ষিণ উপজেলার কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। নির্বাচন কমিশনের তুঘলকি সিদ্ধান্তের কারণে নাঙ্গলকোট উপজেলার জনগণ সদর দক্ষিণ উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত উন্নয়নবঞ্চিত ছিল। ভবিষ্যতেও যেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সেবা থেকে নাঙ্গলকোট উপজেলার জনগণ বঞ্চিত না হয়, সেটা দল-মত-ধর্ম-নির্বিশেষে সবার প্রত্যাশা। তাই নির্বাচন কমিশন তাদের চূড়ান্ত গেজেট পুনর্বিবেচনা করে নাঙ্গলকোট উপজেলা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র নির্বাচনী এলাকা ঘোষণা করবে বলে আশা করছি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।