আমি ফিফা চেয়ারম্যান হতে চাই। চেয়ারম্যান হলে আমার নাম হবে জন ফু সোহেল
কৃত্রিম কিডনি তৈরি করে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছেন বাঙালি বিজ্ঞানী শুভ রায়। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসামান্য কীর্তি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। শুভ রায়ের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে। শুভ রায় এবং তার গবেষণা দলের উদ্ভাবিত কিডনি ইতিমধ্যে প্রাণীর দেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মানবদেহে পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। বিস্তারিত এই প্রতিবেদনে...
৪১ বছর আগের সেই দিনটির কথা বলতে গিয়ে অশীতিপর লীলাবতীর ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক বিন্দু হাসির রেখা, বলতে থাকেন তিনি, ‘তখন রমজান মাস। সন্ধ্যায় আমার মেয়ের কোল আলো করে এল সেই রাজপুত্তুর, আর তখনই চারদিকে রব উঠল, ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। যে আয়াটি এক সপ্তাহ ধরে আমার মেয়ের সেবা করছিলেন, তিনি নবজাতককে কোলে নিয়ে বললেন, “আইজ ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। আপনের নাতির চেহারা তো চাঁদের লাহান।
আমার মনে অয়, এই ছেলে একদিন আপনাগো মুখ উজ্জ্বল করব। ওর নাম রাখেন চান”। ’
লীলাবতী টানা অনেক কথা বলে যেন একটু হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। একটু দম নিয়ে বললেন, ‘আজ আমার মনে হয়, হাসপাতালের সেই আয়ার কথা আজ সত্যি হয়েছে, আমার নাতি শুভ রায় আজ শুধু আমাদের মুখ আলো করেনি, দেশকেও গৌরবের আসনে বসিয়েছে। ’
কী করেছেন লীলাবতীর নাতি শুভ রায়?
শুভ বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম কিডনি তৈরি করেছেন।
এই কিডনি তৈরি চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসামান্য কীর্তি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। শুভ রায় মাইক্রো ইলেকট্রো মেকানিক্যাল সিস্টেম টেকনোলজি ডেভেলপিং স্পেশালিস্ট। এর আগে ম্যাসাচুসেটসের ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির টপ হানড্রেড ইনোভেটর ২০০৩ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুল অব ফার্মাসি অ্যান্ড মেডিসিনের বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড থেরাপিউটিক সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শুভ রায় ১০ বছর আগে ৪০ জন সহকর্মী নিয়ে কৃত্রিম কিডনি তৈরির কাজ শুরু করেন। গত তিনটি বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে এ কাজে সময় ব্যয় করেছেন তিনি এবং তাঁর গবেষক দল।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দলটি ঘোষণা দেয়, তারা কৃত্রিম কিডনি তৈরি করে তা প্রাণীর দেহে প্রতিস্থাপন করে সফল হয়েছেন। আগামী পাঁচ বছরে আরও ব্যাপকভাবে বিভিন্ন প্রাণীর দেহে পরীক্ষার পর এটি মানবদেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ওই দলের প্রধান শুভ রায়।
শেকড়ের সন্ধান
শুভ রায়ের জন্ম ১৯৬৯ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায়। তাঁর বাবা অশোক নাথ রায়ের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির রোসাঙ্গগিরিতে। তাঁর দাদা নগেন দে বোয়ালখালীর স্যার কানুনগোপাড়া আশুতোষ কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন।
শুভর মা রত্না রায়ের বাড়ি চট্টগ্রাম শহরের আলকরণে।
শুভ রায়রা তিন ভাইবোনই থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ছোট ভাই জয় রায় পেশায় ভাসকুলার সার্জন, বোন চৈতী রায় অ্যানেসথেটিক।
রত্না রায় জানান, পাঁচ বছর বয়সে ঢাকায় সিদ্ধেশ্বরীর একটি বিদ্যালয়ে নার্সারিতে শুভ রায়কে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু স্বামীর পেশাগত কারণে ১৯৭৪ সালে তাঁদের উগান্ডায় চলে যেতে হয়।
সেখানে স্বামী চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। শুভ রায়ের শিক্ষাজীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে উগান্ডা ও আমেরিকায়।
জানা যায়, উগান্ডার জিনজা সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল থেকে সেকেন্ডারি পাস করেছেন শুভ রায়। সেই স্কুলে পড়াতেন তাঁর মা-ও। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান শুভ।
আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আলিয়ন্স ওহাইওর মাউন্ট ইউনিয়ন কলেজ থেকে।
শুভ কথন
শুভ রায় সম্প্রতি একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন। মুঠোফোন ও ই-মেইলে তাঁর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ হয় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে।
কৃত্রিম কিডনি তৈরির ধারণা কীভাবে এল? এমন প্রশ্নের জবাবে শুভ রায় বলেন, ‘আমার বাবা চিকিৎসক, পরিবারের আরও অনেকে চিকিৎসক। আমি কিন্তু চিকিৎসক হতে চাইনি, ভিন্ন কিছু হতে চেয়েছি, তাই প্রকৌশলবিদ্যা অধ্যয়ন করেছি।
একজন প্রকৌশলী হিসেবে অধিক কার্যকর ডায়ালাইসিস যন্ত্র তৈরি করতে আগ্রহী ছিলাম। আর তা করতে গিয়ে আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করলাম, কৃত্রিম কিডনি তৈরির সম্ভাবনার দিকটি। গত তিন বছরে সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলাম এ বিষয়ে, আমি সাফল্যের ছোঁয়া পেয়েছি বলতে পারেন। ’ প্রকৌশলী জীবনে উদ্ভাবনের নেশাটা কীভাবে হলো? এর উত্তরে বলেন, ‘আমি তো আগেই বলেছি, চিকিৎসক নয়, ভিন্ন কিছু হতে চেয়েছি। ’ তারপর যোগ করেন, তিনি সূক্ষ্ম ওয়্যারলেস সেন্সর উন্নয়নের কাজ করেছেন।
ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগীর জন্য এমন চিপস তৈরি করেছেন, যা শরীরে প্রতিস্থাপন করলে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না।
কিডনি তৈরির পূর্বাপর
ড. শুভ রায়ের তৈরি প্রতিস্থাপনযোগ্য কৃত্রিম কিডনির আকার হবে কফির কাপের মতো। এটি রক্ত থেকে বর্জ্য পরিশোধন করবে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও ভিটামিন ডি সংশ্লেষণ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায়ও সাহায্য করবে। ইতিমধ্যে ইঁদুর ও শূকরের দেহে সফলভাবে এই কৃত্রিম কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে প্রাণীর দেহে আরও ব্যাপকভাবে পরীক্ষা চালানো হবে।
এরপর মানবদেহে প্রতিস্থাপনের পরীক্ষার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিস্থাপন সম্ভব হলে কিডনি রোগীদের জন্য শতাব্দীর আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচিত হবে এটা। কারণ, গুরুতর কিডনি রোগীদের বড় অংশই বেঁচে থাকেন ব্যয়বহুল ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে। কৃত্রিম কিডনি প্রতিস্থাপিত হলে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হবে না।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার কিডনি তৈরি প্রকল্পের সদস্য ক্রিস্টেন বোল গত ৮ সেপ্টেম্বর ডেইলি মেইলকে বলেন, তাঁরা রক্ত থেকে বর্জ্য পরিশোধনের জন্য খুবই সূক্ষ্ম ফিল্টার তৈরি করবেন।
গত ৪ ডিসেম্বর দি ইকোনমিক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘ভারতে গুরুতর কিডনি-সমস্যায় ভুগতে থাকা দেড় লাখ রোগীর মধ্যে মাত্র তিন হাজার ৫০০ জনের শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়। ৬-১০ হাজার ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভর করেন। মানবদেহে শুভ রায়ের তৈরি কিডনি প্রতিস্থাপন করা গেলে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজনীয়তা দূর হবে। ’ ৩ ডিসেম্বর শুভ রায়ের কৃত্রিম কিডনি তৈরি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এশিয়ান এজ।
শুভ রায় যখন টপ হানড্রেড ইনোভেটর ২০০৩ অ্যাওয়ার্ড পান, তখন তাঁর স্ত্রী মনিকা ম্যাথুস শাশুড়ির (শুভ রায়ের মা) কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আপনি কি খুশি হয়েছেন, মা? তখন শাশুড়ি রত্না রায় ছেলের বউয়ের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলের কাজ নিয়ে আমি সব সময় খুশি।
তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হব, যেদিন আমার ছেলে নোবেল পাবে। ’
ছেলের এত বড় কীর্তির পর সে আশাটা আরও গভীরভাবে দেখেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে রত্না রায় বলেন, ‘আমি সেই দিনের প্রত্যাশায় আছি, যেদিন বিশ্বের দরবারে আরেকবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাঙালি জাতি। ’
শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ
২০০৩ সালের ঘটনা। অনেক বছর পর মেয়ে নাইয়র এসেছে বাপের বাড়িতে, সুদূর উগান্ডা থেকে। সঙ্গে এসেছে মেয়ের তিন সন্তান—শুভ রায়, জয় রায় ও চৈতী রায়।
ভাগনে-ভাগনির মন জোগাতে নানি ও মামাদের চোখে ঘুম নেই। মেয়ে রত্না রায়ের নাইয়র উপলক্ষে ইন্দুভূষণ দত্তের আলকরণের বাড়িটা সদা সরগরম।
বড় ভাগনে প্রায় ঢুঁ মারে মামা চন্দ্রশেখর দত্তের গানের ঘরে। চন্দ্রশেখর শিল্পী, তাঁর ঘরে আছে হারমোনিয়ামসহ নানা বাদ্যযন্ত্র। মামার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত বেশ প্রিয় শুভর।
দুই মামির সঙ্গেও গলায় গলায় ভাব তাঁর। ঘোরাঘুরি-ওড়াউড়ি থামছেই না।
শুভ এক দিন মামি কাকলী বিশ্বাস ও তৃপ্তি দের কাছে বায়না ধরলেন, সিনেমা দেখবেন। যেই বলা, সেই কাজ। রিকশায় করে তাঁরা ছুটলেন কাজির দেউড়ীর আলমাস সিনেমা হলে।
রাতের শো, ছবির নাম শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ। শাবনূর-রিয়াজ অভিনীত সেই ছবি দেখে খুশিতে আটখানা শুভ রায়। মধ্যরাতে হইচই করে ফিরলেন আলকরণের বাসায়। বাড়িতে ঢোকার সময়ও শুভর মুখে শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ। দুয়ারে তখন দাঁড়ানো ছিলেন মামা চন্দ্রশেখর।
ভাগনেকে নিয়ে মামার সরস মন্তব্য, ‘শুভ, তোমাকে শিগগিরই একটা শ্বশুরবাড়ি বানিয়ে দেব। ’ মামার কথায় লজ্জা পেয়ে শুভ কথা ঘোরালেন। কিন্তু সত্যি সত্যি এর কিছুদিন পরই বিয়ে হয়ে গেল তাঁর। নিজের পছন্দে মার্কিন নাগরিক মনিকা ম্যাথুসকে বিয়ে করেন শুভ।
শুভর মা রত্না রায় জানান, ‘ছেলে নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছে।
তবে অনুষ্ঠানটা হয়েছে আমাদের পছন্দে। ১৫ দিনব্যাপী সেই অনুষ্ঠান ছিল জমকালো। বিয়ে হয়েছে বাঙালি রীতিতে। আমাদের এত রীতিনীতি পালনে তার কোনো বিরক্তি ছিল না। ’
মামা উৎপল দত্ত বললেন, ‘ছোটবেলায় খুব মেধাবী ছিল শুভ রায়।
উগান্ডা থেকে বেড়াতে এলে আমাদের বাড়িতে অনেক দিন থাকত, সঙ্গে বই-খাতা নিয়ে আসত। পড়াশোনায় অসম্ভব মনোযোগ ছিল শুভর। যে যা বলত, তা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনত। ’
ভবিষ্যতের এই বিজ্ঞানীর ছায়া কি ছোটবেলায় দেখেছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শুভ রায়ের বাবা অশোক নাথ রায় বলেন, ‘দেখতাম, শুভ একটা কিছু বারবার গড়ছে, আবার ভাঙছে। নতুন কিছু তৈরির ব্যাপারে তার আগ্রহ দেখে আমি অবাক হতাম, আবার খুব মজাও পেতাম।
’
রত্না রায় কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘শুভ যে অনেক দূর যাবে, সেটা আমি জানতাম। কিন্তু সে কী কাজ করছে, সেটা নিয়ে খুব একটা কথা বলত না। সে যে কৃত্রিম কিডনি তৈরি করছে, সে ব্যাপারে আমাদের কিন্তু আগে থেকে কিছুই বলেনি। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে যখন তাঁকে নিয়ে হইচই হলো এশিয়ান এজ, ডেইলি মেইল, টাইমস অব ইন্ডিয়ার মতো পত্রিকাগুলোতে লেখালেখি হলো, তখন তাকে ফোন করলাম। কৃত্রিম কিডনি তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে সে বলল, “মা, এখনো অনেক কিছুই বাকি”।
’
জীবনের বড় অংশ বিদেশে কাটলেও শেকড়ের প্রতি, চট্টগ্রামের প্রতি দুর্নিবার টান রয়েছে শুভ রায়ের। মা-বাবা বিদেশে তাঁকে অন্য ভাষার পাশাপাশি বাংলাও শিখিয়েছেন।
দেশের কথা, চট্টগ্রামের কথা বললেন শুভ রায়, ‘ডাল-ভাত আমার খুব পছন্দ। চাটগাঁ গেলে শুঁটকি খাব না, তা তো হয় না! মা ও মামিদের হাতে রান্না করা ইলিশ ও শুঁটকি আমার কাছে পৃথিবীর সেরা খাবার। ’
চট্টগ্রাম নিয়ে আর কী স্মৃতি আছে? ‘আমার গ্রাম রোসাঙ্গগিরি গেলে আর ফিরতে ইচ্ছা করে না।
ছোটবেলায় কত গেছি। এখন কিন্তু তেমন সময় পাই না। মনে পড়ে, দাদা কানুনগোপাড়া কলেজে শিক্ষকতা করতেন। মা-বাবার সঙ্গে বোয়ালখালী গেলে আমি করলডেঙ্গা পাহাড় চষে বেড়াতাম। কর্ণফুলীতে নৌকায় চড়ে হারিয়ে যেতাম, স্নান করতাম।
খুব মনে পড়ে আমার চট্টগ্রামকে। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।