বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী জাগরণের অগ্রদূত। সৃষ্টিতে, উন্নয়নে, নারীর আবশ্যকতা অনুধাবনপূর্বক নারীসত্তার সামগ্রিক বিকাশের পক্ষে তিনি কলম ধরেছিলেন্ শুধু লেখনিতে নয় নারীর স্বতন্ত্র মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষে তিনি সামাজিক আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন ছিল নারীর পূর্ণতা নিয়ে, পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে। তাঁর সকল উদ্যোগে শিক্ষা সর্বতোভাবে জড়িত। বেগম রোকেয়ার কাছে শিক্ষা নারী জাগরণের মৌলিক অবলম্বন বা উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
এবং এ ধারায় আমাদের নারী শিক্ষা ও নারীর অগ্রগতির প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেগম রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ সচেতন শিক্ষিত সমাজের। সেখানকার সকল কর্মকান্ডে নারীর কর্ম প্রবণতা, সামর্থ ও সচেতন অংশগ্রহণ সমান গুরুত্ব পাবে। নারী হয়ে উঠবে সমাজের একটি অনিবার্য অংশ।
প্রথমত শিক্ষা বলতে আমরা কি বুঝি?
Education শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ Educer হতে যার অর্থ Rearing বা লালন করা।
মুলত অজানাকে জানার নামই শিক্ষা। অন্য কথায় বলা যায়- মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে শৈশব কাল হতে যে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে তাই শিক্ষা।
Milton এর মতে, Education is the continuous process through which mental, physical and moral training is provided to new generation who also acquire their ideal and culture through it.
দ্বিতীয়ত নারী শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবনের প্রয়োজন
শিক্ষা সম্পর্কে পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে- “ পরম করুণাময় আল্লাহ এ কুরআনের শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এবং তাকে কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন।
”১
হাদীস শরীফে আছে-“ প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ”
অপর একটি হাদীসে বর্ণিত আছে - রাতের কিছু সময় ইলমে দ্বীনের পারস্পারিক আলোচনা করা সারা রাত জেগে ইবাদত করা অপেক্ষা উত্তম।
নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিজে শিক্ষিত হয়েছেন এবং অন্যকেও শিক্ষিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাই আমরা দেখেছি ১৯০৯ সালে স্বামীর মৃর্তুর পর তিঁনি নারী শিক্ষা বিস্তারে সমাজ সেবায় আত্ননিয়োগ করেন। কিন্তু বর্তমানে ইভটিজিং নামক সংক্রামক ব্যাধি বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন নারী শিক্ষার অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইভটিজিং সর্ম্পকিত কিছু কথা
গ্রীক শব্দ Eve অর্থ নারী teasing অর্থ উত্ত্যক্ত করা অর্থাৎ Eve teasing অর্থ নারীকে উত্যক্ত করা।
আমেরিকায় ইভটিজিং কে বলা হয় যৌন নিপীড়ন।
অতীতে বাংলাদেশে ইভটিজিং বলতে শুধু শিষ দেয়া, চোখ মারা, কাছে বা দূরে দাঁড়িয়ে অপ্রিয় বাক্য ছুড়ে দেয়া, পথ আগলে দাঁড়ানো বা অযাচিত প্রেম নিবেদনের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে এর পরিধি বিস্তৃত হয়ে অযাচিতভাবে মেয়েদের শরীরে হাত দেয়া, গায়ের ওপরে এসে পড়া, অপহরণ করা, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ধর্ষনের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
ইভটিজিং এর কারণ হিসেবে দেখা যায়
1. অভিভাবকের দায়িত্বহীনতা
2. অপ-সংস্কৃতি
3. নৈতিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয়
4. সন্তানের প্রতি অন্ধবিশ্বাস
5. অশালীন পোষাক ও চলাচল
6. ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনীহা
আজকের বাবা-মায়েরা অনেক ব্যস্ত হওয়ায় তারা ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো সময় দিতে পারে না। ফলে সেই সময়ের একাকিত্ব দূর করার জন্য অসৎ সঙ্গে মিশে এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে।
বিদেশী সংস্কৃতি বিশেষ করে পশ্চিমাদের মতো জীবনযাপনে চেষ্টা করার কারণে আজ আমাদের সমাজের এই বেহাল অবস্থা। এছাড়া বর্তমানে স্যাটেলাইট টেলিভিশনে এমন সব সিনেমা দেখানো হচ্ছে বা অনুষ্ঠান সমপ্রচার করা হচ্ছে যা থেকে তরুন সমাজ ভালো কিছু না যতটা শিখছে তার চেয়ে বেশি শিখছে বেহায়াপনা।
সৃষ্টিকর্তা মানুষের মধ্যে দুইটি শক্তি দিয়েছেন। একটি পাশবিক শক্তি এবং অপরটি মানবিক গুনাবলী । যদি কোন সমাজের মানুষের মধ্যে মানবিক গুনাবলী কমে যায় এবং পাশবিক শক্তির উত্থান ঘটে তখনই সে সমাজে বিপর্যয় নেমে আসে।
পেশি শক্তির দাপটে সমাজে অরাজকতা বেড়ে যায়। এ শক্তিকে দমন করতে তখন আরেকটি শক্তির উত্থান ঘটে। ফলে বিশৃঙ্খলা বাড়তেই থাকে। আমাদের নৈতিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইভটিজিং, সুদ, ঘুষ, অপরকে ফাঁকি দেওয়া, কাজে ফাঁকি দেয়া, খুন, ধর্ষন করার পরও নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয় না।
সন্তানের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক পর্যায়ে বখাটেদের বাবা মার কাছে অভিযোগ করলে ফল উল্টা হয়।
যার কারণে বখাটেরা টিজিং-এ আরো উৎসাহী হয়।
আমাদের সমাজের কিছু সংখ্যক মেয়েদের অর্ধনগ্ন বা আঠসাঠ পোষাক ও অবাধ চলাচল বখাটেদের আরো উচ্ছৃঙ্খল করে তোলে যার ফলসু্রতিতে ঐ সকল মেয়েরা টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। অথচ পোষাকের ব্যাপারে হযরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, “ নারীদের এমন আঠসাঠ কাপড় পরতে দিও না যাতে শরীরের গঠন পরিস্ফুটিত হয়ে পড়ে।
পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ না করায় কিশোর - কিশোরীরা নৈতিক জ্ঞান বির্বজিত হয়ে বেড়ে উঠছে যার কারণে ইভটিজিং বাড়ছে।
এছাড়া পর্ণ ছবির সহজলভ্যতা, ইন্টারনেট ব্যবহার, মোবাইল ফোনের ব্যাবহার, রাজনৈতিক প্রশ্রয়, কঠোর আইন না থাকা প্রভৃতি কারণে ইভটিজিং বেড়েই চলেছে।
ইভটিজিং প্রতিরোধে কিছু প্রস্তাব
আমাদের সন্তানদেরকে নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তাদেরকে কুরআনের আলোয় আলোকিত করে তুলতে হরে। জানাতে হবে আল্লার নির্দেশ, হে নবী! মুমিন পুরুষদের বলে দাও তার যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে বাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফজত করে। এটি তাদের জন্য বেশী পবিত্র পদ্ধতি। যা কিছু তারা করে আল্লাহ তা জানেন।
আর মুমিন নারীদিগকে বলে দাও তার যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে আর তাদের সাজসজ্জা না দেখায়, যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া। আর তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে। তারা যেন তাদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে, তবে নিম্নোক্তদের সামনে ছাড়া স্বামী, পিতা, স্বমীর পিতা, পুত্র, স্বমীরপুত্র, আপন ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, আপন ভগিনীপুত্র, তাদের আপন স্ত্রীলোকগণ, স্বীয়অধিকারভূক্ত অনুগত দাস-দাসী, যৌন কামনা রহিত পুরুষ এবং গোপন অঙ্গ সম্পকে অজ্ঞ বালক ব্যতীত। (আর নারীদিগকে আরো নির্দেশ করুন) তারা যেন পথ চলিবার সময় এমন পদধ্বনী না করে যাতে তাদের অপ্রকাশিত সৌন্দর্য পদধ্বনিতে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ২
আমাদের সন্তানদেরকে শৈশব কাল হতে নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে।
বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে বর্ণিত নৈতিক ও মূল্যবোধ সংক্রান্ত বাণীগুলো তাদের সামনে আলোচনা করতে হবে এবং সে কাজ নিজে করে দেখাতে হবে। তাহলে আমাদের সন্তানরা আমাদের অনুসরনে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, শ্রদ্ধাশীল হবে এবং তখনই সমাজ থেকে ইভটিজিং সহ অন্যান্য অপরাধও সমাজ হতে বিদায় নেবে।
.বাংলাদেশের বেশিরভাগ মেয়ে তাদের পরিবার থেকে খুব কম সম্মানই পায় এবং ছেলেরা মেয়েদের সম্পর্কে এই ধারণা নিয়েই বড় হয় যে মেয়েরা মানুষ না, ভোগের বস্তু। তাই পরিবার থেকেই প্রথমে মেয়েদের মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখাতে হবে.
বয়োসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের সাথে বন্ধুর মতো মেশা উচিৎ এবং নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের অবগত করা উচিত।
ছেলেমেয়েরা টেকনোলজি কিভাবে ব্যবহার করছে তার দিকে অভিভাবকদের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত।
পারিবারিক বা সামাজিকভাবে প্রথম অপরাধে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিৎ। যাতে এ ধরনের অপরাধের কথা দ্বিতীয় বার চিন্তাও না করতে পারে।
সমাজপতিদের নিজ থেকে এগিয়ে এসে ইভটিজিং সমস্যা রোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে।
আমাদের সন্তানদেরকে পাশ্চাত্য ঢংগে অশালীন পোষাক পরার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
ইভটিজিং এ শুধু দায়ী ছেলেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ইভটিজিং এর w¯^Kvi মেয়েদেরও এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে।
নারীকে উত্যক্ত করা এই বখাটে কিশোর-যুবকদের শিক্ষায়, খেলাধুলায়, সামাজিক, সাহিত্যিক, ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মে সম্পৃক্ত করতে না পারলে ধরপাকড়ে সাময়িক কিছু উত্তেজনা কমলেও সমস্যার সমাধান হবে না।
নারীদের জন্য পথেঘাটে ইভটিজিং কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে এর জন্য সরকারী বা বেসরকারী প্রশিক্ষন কেন্দ্র খোলা যেতে পারে।
ইভটিজারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।
পাঠ্য পুস্তকে নৈতিক শিক্ষাকে গুরুত্বের সাথে স্থান দিতে হবে।
আমরা আশা করি অচিরে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে ইভটিজিং নামক ঘৃনিত ব্যাধি সমাজ থেকে দূর হবে এবং আমরা ফিরে পাব সেই সমাজ, যে সমাজে সুদূর সান‘য়া থেকে হাজরা মাউত পর্যন্ত কোন সুন্দরী রমনী একাকী হেঁটে গেলেও তার অলংকার, তার রুপ যৌবন কেড়ে নেওয়ার কেউ ছিলো না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।